অনেক দিন পর আবার এলাম ঢাকা চিড়িয়াখানায়। সেই ছোটবেলার মতো এখনো চিড়িয়াখানা আমার ভারি পছন্দ। আজ ছুটির দিন হলেও ভেতরটা দেখলাম বেশ ফাঁকা। ভালোই হলো, বেশ মজা করে দেখা যাবে। একটু এগোতেই চলে এলাম বানরের খাঁচার সামনে। এখানে বানরের দলের যা কাজ তা অর্থাৎ বাঁদরামিতে ব্যস্ত তারা। একটা মহানন্দে তাড়া করছে আরেকটাকে। একটা আবার এক সঙ্গীর মাথা থেকে উকুন আনছে মহা উৎসাহে। বানরদের খুব বেশি সময় দেওয়া গেল না। এখনো যে চিড়িয়াখানার অনেক চিড়িয়ার সঙ্গেই দেখা করা বাকি।
বাংলাদেশে আরো বেশ কয়েকটি চিড়িয়াখানা থাকলেও সবচেয়ে বড় এই ঢাকা চিড়িয়াখানাটাই। চিড়িয়াখানায় যেতে হলে তোমাকে যেতে হবে মিরপুর। সেখানেই যে এর অবস্থান। কবে এই চিড়িয়াখানার জš§ জানো? সেই ১৯৭৪ সালে। ১৮৬ একর জায়গার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এই প্রাণিশালা। এরই মধ্যে দেখা হয়ে গেছে চিত্রা হরিণ আর সম্বরের সঙ্গে। এদের অবশ্য কোনো খাঁচায় রাখা হয়নি, রাখা হয়েছে বেশ বড় একটি ঘেরের মধ্যে। চিত্রা হরিণ তো তোমরা সবাই চেন। সুন্দরবন আর নিঝুম দ্বীপে এরা অনেকই আছে। তবে সম্বর হরিণের কথা হয়তোবা অনেকেরই অজানা। বিশাল তাগড়া দেহের একেকটা সম্বরের ওজন কয়েক মণ। আর এটাই কাল হয়েছে এদের। একসময় বাংলাদেশের অনেক বনেই আরামসে ঘুরে বেড়াত এরা। কিন্তু মাংসের লোভে মানুষ এদের মেরে প্রায় সাফ করে ফেলেছে। অবশ্য এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম আর সিলেটের গহিন বনে এদের দেখা যায়, তবে কালেভদ্রে। বিশাল শিংয়ের একটা সম্বর দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল। দেখলাম বিশালকায় মদনটাক পাখি আর শকুন। একসময় গরু মারা গেলেই দেখা যেত শকুন। এখন চিড়িয়াখানা ছাড়া এদের দেখা পাবে না বললেই চলে।
তোমার নিশ্চয়ই এখন জানতে ইচ্ছা করছে পৃথিবীর প্রথম চিড়িয়াখানাটার জš§ কবে? হু, চিড়িয়াখানার ইতিহাস অবশ্য অনেক প্রাচীন। যদিও তখন এটির ইংরেজি নাম ‘জু’ হয়নি। বরং জুলজিক্যাল গার্ডেন হিসেবেই পরিচিত ছিল। ২০০৯ সালে মিসরের হিরাকোনাপলিসে একটি খননকাজ চালানোর সময় বেরিয়ে আসে প্রাচীন এক চিড়িয়াখানার গুপ্ত খবর। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালে জায়গাটায় ছিল সমৃদ্ধ এক প্রাণিশালা। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় হাতি, জলহস্তী, বনবিড়ালসহ নানা জাতের প্রাণীর হাড়গোড়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর চীনা সম্রাজ্ঞী তাংকির ছিল একটি হরিণশালা। রাজা ওয়েনের ছিল এক হাজার ৫০০ একরের বিশাল এক চিড়িয়াখানা। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন লিং-ইউ, যার অর্থ বুদ্ধিমত্তার বাগান। এ ছাড়া এভাবে প্রাণী সংগ্রহের বাতিক ছিল ইসরায়েলের রাজা সলোমন, আসিরিয়ার আশুরবানিপাল আর ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদরেজারের। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রিসের বেশির ভাগ শহরেই চিড়িয়াখানার দেখা মিলত। তোমরা নিশ্চয় মহাবীর আলেকজান্ডারের নাম শুনেছ। বিভিন্ন অভিযানের সময় আটক করা বন্য প্রাণী পাঠিয়ে দিতেন গ্রিসে। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম হেনরি উডস্টকে তাঁর প্রাসাদে প্রাণী সংগ্রহাগার বানিয়েছিলেন একটি। এতে ছিল সিংহ, চিতাবাঘ আর উট। মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের সেরা সংগ্রহ ছিল টাওয়ার অব লন্ডনে। ১২০৪ সালে এটি তৈরি করেন রাজা জন। এদিকে রাজা তৃতীয় হেনরি বিয়ের উপহার হিসেবে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন তিনটি চিতাবাঘ। এগুলো স্থানান্তর করা হয় টাওয়ার অব লন্ডনের বুলওয়াকে। পরে যার নাম হয় লায়ন টাওয়ার। ১৬ শতকে রানি প্রথম এলিজাবেথের সময় সাধারণ মানুষের জন্য উš§ুক্ত করে দেওয়া হয় লন্ডন টাওয়ার। লন্ডন চিড়িয়াখানা তৈরি হওয়ার পর টাওয়ার অব লন্ডনের প্রাণীগুলোর ঠিকানা হয় সেটি।
এখানে এত ভিড় কেন? হবে না, এ যে বাঘের খাঁচা। বাঘ মানে একেবারে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বেশ বড় খাঁচাটা। এর মধ্যে আছে দুটি জন্তু। সম্ভবত এত ভিড়ভাট্টা পছন্দ হয়নি মহারাজাদের। সমানে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর হঠাৎ হঠাৎ চারপাশে জড়ো হওয়া ছেলেপুলের আÍা শুকিয়ে দিচ্ছে গর্জন করে উঠে। বাঘের খাঁচার কাছেই ভালুকের খাঁচা। বিশাল কালো শরীর দেখে ভয় পেয়ে যেতে হয়। আমাদের দিকে কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে। সম্ভবত মনে মনে বলছে, একটিবার খাঁচা থেকে বের করে দিয়ে দেখ বাপু, দেখাচ্ছি কত ধানে কত চাল। দেখা হলো সিংহের সঙ্গে। পৃথিবীতে দুই জাতের সিংহ আছে, জানো মনে হয়। একটা আফ্রিকান সিংহ আরেকটা ভারতীয় সিংহ। এগুলো হলো ভারতীয় সিংহ। দেখা মেলে ভারতের গির জঙ্গলে। ছোট্ট একটি চিতাবাঘ দেখলাম কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখে শুয়ে পড়ে কেমন আদর খাওয়ানোর ভাব দেখাচ্ছে। বন কাঁপানো এই প্রাণীর মেজাজ-মর্জি এত ঠাণ্ডা হলো কবে থেকে!
দেখা হলো সাপের ঘরও। কাচের ঘেরের ওপাশে বিশাল একটা অজগর দেখে ভয়ে মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল ছোট্ট এক ছেলে। অজগরটা কিন্তু নট নড়ন-চড়ন। অবশ্য অজগর এমনই। একবার পেটে কিছু পড়লে পরের কয়েকটা দিন একেবারে চুপচাপ। সাত চড়েও তখন রা নেই। অজগর অবশ্য বাংলাদেশের বনগুলোতে এখনো আছে। দেখতে চাইলে যেতে পারো সুন্দরবন, হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা কিংবা রাঙামাটির পাবলাখালীর জঙ্গলে। তবে ময়ূর দেখলাম বেশ মজায়ই আছে। বেশ বড়, উঁচু একটা ঘেরের মধ্যে রাখা হয়েছে এদের। ভেতরে বড় অনেক গাছও আছে। কোনোটা আয়েশ করে বসে আছে গাছে, কোনোটা আবার ঘোরাফেরা করছে মাটিতে। এমন স্বাধীনতা অবশ্য বাংলাদেশের চিড়িয়াখানার খুব বেশি প্রাণী পায়নি। আনন্দে যে আছে এটা বোঝানোর জন্যই একটা উড়ে গিয়ে বসল দূরের আরেকটা গাছে। আর পেখম তুলে নেচে দেখাল। মজার ঘটনা কি জানো, পেখম থাকে কেবল পুরুষ ময়ূরের, স্ত্রী ময়ূরের না। অর্থাৎ ময়ূরজগতে পুরুষরাই বেশি সুন্দর।
এখন পৃথিবীতে যেসব চিড়িয়াখানা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো হলো অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা চিড়িয়াখানা। ১৭৫২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই চিড়িয়াখানা। মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় ১৭৬৫ সালে। স্পেনের মাদ্রিদে একটি চিড়িয়াখানা তৈরি হয় ১৭৭৫ সালে। প্যারিসের লোকরা তাদের শহরে প্রথম চিড়িয়াখানা দেখে ১৭৯৫ সালে। এদিকে রাশিয়ার কাজান চিড়িয়াখানার যাত্রা শুরু ১৮০৬ সালে। আমেরিকায় প্রথম চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৪ সালে।
জলহস্তী যে ছোটদের ভারি পছন্দ এর প্রমাণ পাওয়া গেল জলহস্তীর ডোবার কাছে গিয়ে। একটাকে পাওয়া গেল বেষ্টনীর কাছেই। থকথকে কাদার মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাকিগুলো অলস সময় কাটাচ্ছে পুকুরে। জলহস্তীর খাবার হলো লতাপাতা ও ঘাস। মাংসাশী না হলেও মেজাজ খারাপ হলে ছেড়ে কথা কইবে না। কাজেই বেশি কাছে না যাওয়াই ভালো। তারপর যে বিশাল শরীর, গায়ের ওপর এসে পড়লে একেবারে ভর্তা হয়ে যেতে হবে। কুমিরের চেহারাটা মোটেই সুবিধার নয়। দেখলেই কেমন ভয় লাগে। কিন্তু কুমির যেখানে আছে সেখানে দেখলাম অনেক ভিড়। ঢাকা চিড়িয়াখানায় মিঠা পানি আর লোনা পানির কুমির দুটিই আছে। আর আছে ঘড়িয়াল। এখন নিশ্চয়ই জানতে চাইবে ঘড়িয়ালটা আবার কী। এমনিতে এরা কুমিরের মতোই দেখতে। তবে কিছু পার্থক্যও চোখে পড়বে। যেমন এদের সরু, লম্বা চোয়াল কুমির থেকে ঘড়িয়ালকে আলাদা করতে সাহায্য করবে তোমাদের। ঘড়িয়ালের আরেক নাম কিন্তু মেছো কুমির। নাম শুনেই বুঝতে পারছ, মাছ এদের ভারি পছন্দ। আমাদের পদ্মা আর যমুনা নদীতে একসময় অনেক ঘড়িয়াল ছিল। এখনো মাঝেমধ্যে যে এদের দেখা মেলে না তা নয়। তবে সমস্যা হলো, জালে আটকা পড়লেই জেলেরা একে পিটিয়ে মেরে ফেলে। উল্লুক দেখেও ভারি মজা হলো। বিপন্ন এই প্রাণীর দেখা পাবে লাউয়াছড়াসহ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বনে। লম্বা লম্বা হাত-পা দিয়ে খাঁচার মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম জিরাফ, মেনড্রিল, বাঁশ ভালুক, হায়েনা আরো কত কী!
চিড়িয়াখানায় যখন এলামই, তখন এখানকার প্রাণী জাদুঘরটা ঘুরে গেলে কেমন হয়। অতএব, ঢুঁ মারলাম। এখানে কিন্তু বেজায় ভিড়। থাকবে নাই বা কেন। বাঘ, চিতাবাঘ, মেঘলা চিতা, সিভেট আরো কত জাতের প্রাণীর স্টাফ করা শরীর যে এখানে দেখলাম তার ইয়াত্তা নেই। স্টাফ করা শরীরটা আবার কী? কোনো প্রাণী মারা গেলে তার চামড়াটা প্রথমে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। তারপর শরীরের মাপের একটি ডামি বানিয়ে তার ওপর চড়ানো হয় চামড়া। ব্যস, তৈরি হয়ে গেল প্রাণীটির স্টাফ করা দেহ। দ কারিগরের হাতে পড়লে স্টাফ করা একেকটা প্রাণী দেখলে মনে হয়, যেন সত্যিকারের প্রাণীটিকেই সামনে দেখছ। যেকোনো সময় লাফ দিয়ে পড়বে গায়ের ওপর। তবু আমাদের এখানে স্টাফ করাটা অবশ্য এতটা ভালো হয়নি। আর দেখলাম ফরমালডিহাইড দ্রবণে সংরণ করা সিংহ, বাঘ, চিতাবাঘ, জিরাফের বাচ্চা। দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোনো এক ডাইনি বুড়ি এদের আটকে রেখেছে কাচের জারের ভেতর। যেকোনো সময় জীবন ফিরে পেয়ে জীবন্ত করে তুলবে প্রাণী জাদুঘরের পরিবেশ।
ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক
চিড়িয়াখানার তুলনায় সাফারি পার্কে অনেক মুক্ত পরিবেশে থাকার সুযোগ মেলে জীবজন্তুর। এখানে বনে ঘুরে বেড়ানো প্রাণী দেখার সুযোগও মিলতে পারে। বাংলাদেশের একমাত্র সাফারি পার্কটি আছে কক্সবাজারের ডুলাহাজারায়। ফাসিয়াখালী বনের একটা বড় অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে পার্কটি। এখানে ঘুরতে গিয়ে তাই দেখা হয়ে যেতে পারে বুনো হরিণ, শুয়োর কিংবা নানা জাতের পাখপাখালির সঙ্গে। সাফারি পার্ক হলেও বাঘ ও সিংহের মতো প্রাণী কিন্তু এখানে ছাড়া অবস্থায় পাবে না। তবে এদের দেখবে বেশ বড় একটা ঘেরের মধ্যে। তেমনি ভালুকও দেখতে পাবে অনেক বড় একটা ঘেরে। সেখানে মাঝেমধ্যেই গাছে চড়ে বসে থাকে এরা। তবে সাফারি পার্ক এলাকার পাশেই মাঝেমধ্যে বন্য হাতির পাল চলে আসে। অবশ্য এদের দেখতে যাওয়ার ঝুঁকি নেবে কি না সেটাই প্রশ্ন।