ভেষজ গাছের চাষ এ খরচ খুব কম আবার বাজার মূল্য বেশি। আমাদের আশেপাশে যত উদ্ভিদ আছে তার সবই ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাই ভেষজের বাণিজ্যিক চাষ আমাদের জন্য বেশ সম্ভাবনাময়। রফতানির নতুন পণ্য হিসেবেও আমরা ভেষজ চাষ বাড়াতে পারি। আপাতত থাকলো ভেষজের বাণিজ্যিক চাষ শুরু নিয়ে কিছু কথা। পর্যায়ক্রমে কোন ভেষজ কীভাবে চাষ করবেন সেটার বিস্তারিত থাকবে আমাদের অ্যাগ্রিকালচার টিপস মেনুতে। নিয়মিত আপডেট পেতে সাইটটি বেল আইকনে ক্লিক করে Allow বাটনে ক্লিক করে সাবসক্রাইব করে রাখুন।
ভেষজ গাছ কোথায় লাগানো যায়
আমাদের দেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, মাটি সবই ভেষজ গাছের চাষ উপযোগী। যে কোন মাটিতে এমনকি পতিত জমিতে, সমতল ভূমিতে পাহাড়ি এলাকায়, পাহাড়ের ঢালে, চর এলাকায়, বেড়ি বাধে, বাড়ির আনাচে কানাচে, বাড়ির আঙ্গিনায়, অবহেলিত জমিতে, টবে, ছাদে, বারান্দায়, রাস্তার আশে পাশে, ফসলের জমির আইলে, জলাশয়ের পাড়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, হাওড় এলাকাসহ সর্বত্র বিভিন্ন ভেষজ গাছের চাষ করা যায়। এতে একদিকে যেমন দেশের ফসলী জমি নষ্ট হবে না। অন্যদিকে প্রতি ইঞ্চি জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। দেশের ওষুধ শিল্পে বর্তমানে যে পরিমাণ ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহৃত হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশই স্থানীয়ভাবে জোগান দেয়া সম্ভব হবে।
বয়স আটকে রাখার উপায় : ব্যবহার করুন ভেষজগুলো
দাঁতব্যথা কমায় যেসব ভেষজ
ভেষজ গাছের চাষ কিভাবে শুরু করা যায়
ভেষজ গাছের চাষ করতে তেমন কিছুই লাগবে না। নিয়মিত পরিচর্যা করলেই চলবে। তবে সবার আগে বাজারে বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন হারবাল কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে অথবা পাইকারি দোকানগুলোতে যোগাযোগ করতে হবে। তাদের সঙ্গে আলাপ করে চাহিদা মতো গাছ রোপণ করাই ভালো।
যেসব ভেষজ গাছের চাহিদা বেশি তার মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি বাড়ির আঙিনায় লাগাতে পারেন। ঘৃতকমল, উলটকম্বল, পদ্মগুরুস, তুলসী ও বাসকের চাষ অল্প জায়গায় করা সম্ভব। উৎপাদনও হয় অল্প সময়ের মধ্যে। এসব গাছের ফলন বিক্রি করা যায় লাগানোর এক মাসের মাথায়। ঘৃতকমলের পাতাগুলো ছিড়ে বিক্রি করতে হয়।
আর উলটকম্বলের ডাল কেটে বিক্রি করতে হয়। লতার মতো পদ্মগুরুসের লতা বিক্রি হয়। আর তুলসী, পাথরচুনা, পাথরকুচি, জিনসেং, অশ্বগন্ধা, বাসক, চিরতার গাছ বিক্রি হয়। এদের চাষও খুব সহজ। তবে বেল, আমলকী, হরীতকী, বহেরার মতো ভেষজ গাছের ফলন পেতে বেশ সময় লাগে। তাই দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা থাকলে এগুলো রোপণ করা যায়।
চুল নিরাপদে হাইলাইট করুন অব্যর্থ ভেষজ উপায়ে
ভেষজ গাছের বীজ, চারা, কলম কোথায় পাওয়া যায়
ভেষজ গাছের চারা সংগ্রহ করতে সরকারি হর্টিকালচার কিংবা নার্সারির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। এখান থেকে গাছের পরিচর্যা এবং চাষ পদ্ধতি জানা যাবে। এ ছাড়া সিলেট, রাজশাহী ও নাটোরে আছে বিভিন্ন ভেষজ গাছের নার্সারি। সেখান থেকেও এসব গাছের বীজ বা চারা সংগ্রহ করা যাবে।
ভেষজ গাছ বাজারজাতকরণের উপায়
ভেষজ গাছের কাঁচামাল বিক্রির দোকানে হাজারো উপাদান বিক্রি হয়। এসব দোকানে যেসব উপাদান বেশি বিক্রি হয়, তার মধ্যে ঘৃতকুমারী, মিসরি দানা, পাথরচুনা, পাথরকুচি, আকালমেঘ, বাসকপাতা, তুলসীপাতা, অশ্বগন্ধা, জিনসেং, উলটকম্বল অন্যতম। এ ছাড়া কাঁচা বেল, পদ্মগুরুস, শিমুলের মূল, শতমূল, চিরতা, তালমাখনা, ইসবগুল, তোকমার দানা বিক্রি হয়। এসব দোকানে শুধু গাছের ফল কিংবা মূলই নয়, বিভিন্ন ভেষজ গাছের গুঁড়া পাউডারও বিক্রি হয়। তবে এসব ভেষজ গাছের উপাদানগুলো বেশি আসে সিলেট, রাজশাহী ও নাটোর থেকে। নাটোরের খোলাবাড়িয়ায় রয়েছে ভেষজ উদ্ভিদের পাইকারি ও খুচরা দোকান।
ভেষজ গাছের চাষ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা
বিশ্ববাজারে ব্যাপকহারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভেষজ উদ্ভিদ রফতানির বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদা কাজে লাগিয়ে চাষ করতে পারলে ভেষজ উদ্ভিদ দেশের রফতানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বখাদ্য সংস্থার হিসাব মতে, বর্তমানে বিশ্বে শুধু ঔষধি উদ্ভিদেরই ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। প্রতি বছর চাহিদা বাড়ছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে। বিশাল এ বাজারের অধিকাংশই এখন ভারত ও চীনের দখলে। এসব দেশ নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে।
জানা গেছে, ভেষজ উদ্ভিদ রফতানি করে ভারত প্রতি বছর প্রায় ১ হাজার কোটি রুপি আয় করে। পাকিস্তান রফতানি করছে ২১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারের ভেষজ উদ্ভিদ। এ খাতে থাইল্যান্ডের রফতানি আয় ১৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সরকার গঠিত উদ্ভিদ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এ পর্যন্ত রফতানিযোগ্য ১০৬ টি উদ্ভিদের তালিকা প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহার্য ২৫ টি উদ্ভিদের চাহিদা, পরিমাণ, উৎপাদন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেশে প্রায় ৬শ’ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদের উৎপাদন হচ্ছে। ডেবটেকের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪২২টি আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি প্রতিষ্ঠান ওষুধ উৎপাদনে ঔষধি উদ্ভিদ ব্যবহার করে।
দেশের পথে-প্রান্তরে, বনে-জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা জাতের ঔষধি উদ্ভিদের বিশাল সমারোহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। আমলকি, হরীতকী, বহেড়া, ঘৃতকুমারী, চিরতা, নিম, অর্জুন, অশোক, বাসক, অশ্বগন্ধা, পুদিনা, থানকুনি, বেল, ভুঁই কুমড়া, শিমুল, তোকমা, তুলসি, মনসা, ওলট কম্বল, একাঙ্গী, যষ্ঠিমধু, বিহিদানা, শতমূলি, আগর, স্বর্পগন্ধা, কালোমেঘ, মেথি, মৌরি, মেহেদি, লেমন প্রাস, করমচা, আকন্দ, পাথরকুচির মতো ঔষধি উদ্ভিদ যুগ যুগ ধরে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে অসুখে-বিসুখে এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষায় বহুল ব্যবহৃত।
বর্তমানে ভারত ও নেপাল থেকে বিপুল পরিমাণ ঔষধি উদ্ভিদ আমদানি করা হয়। এসব দেশ থেকে যেসব ঔষধি উদ্ভিদ আমদানি হয় বাংলাদেশে তার অধিকাংশই উৎপাদিত হয়। যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা গেলে ভেষজ উদ্ভিদ রফতানি করে বাংলাদেশও বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে।
ভেষজ উদ্ভিদের চাষ হতে পারে স্বাবলম্বী হওয়ার উপায়
আমাদের দেশের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদাও দিনদিন বেড়ে চলেছে। এ প্রেক্ষাপটে ভেষজ গাছের চাষ স্বাবলম্বি হওয়ার জন্য অন্যতম একটি অবলম্বন হতে পারে। কেননা ভেষজ উদ্ভিদ চাষের জন্য মূলধন কম লাগে। পতিত জমিতে চাষ করা যায় আবার তেমন একটা সার ঔষধ লাগে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার প্রয়োজন হয় না। এর বাজারজাতকরণে তেমন একটা ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় না। রাস্তার পাশে, জমির আইলে পুকুর পাড়ে এমনকি বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন ভেষজ গাছ লাগানো যায়। এক মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এসব গাছই হতে পারে আয়ের অন্যতম উৎস।
সম্ভাব্য পুঁজি : ৫০,০০০ টাকা থেকে ২,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত মূলধন নিয়ে শুরু করা যায়।
সম্ভাব্য লাভ : মাসে ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
ভেষজ গাছ চাষ করে কি রকম আয় হয় : ঘৃতকমলের ডাল ৪৫ কেজির একটা বান্ডিল বিক্রি হয় প্রায় হাজার টাকায়। উলটকম্বল ১০ কেজির বান্ডিল ৩০০ টাকা। পদ্মগুরুসের কেজি ৮০-১০০ টাকা, শিমুলের মূল ১০০ টাকা, শতমূল ২৫০ টাকা কেজি, কালো মেঘ ২০০০ টাকা কেজি।
সুবিধা: গ্রামাঞ্চলে কৃষি জমিতে বাণিজ্যিকভাবে নার্সারী করা যায় তেমনি শহরে বাড়ির ছাদেও নার্সারী করা যায়।
প্রয়োজন যা : ভালো জাতের মাতৃগাছ, বীজ, দোআঁশ মাটি, পলিথিন, কাস্তে, কোদাল, চারা রোপনের জন্য জায়গা ।
প্রস্তুত প্রণালি : দেড় থেকে দুই বিঘা পরিমাণ উঁচু জমি। বেলে দোআঁশ মাটি সব ধরনের গাছ উৎপাদনের উপযোগী বলে এমন মাটি আছে সেই জায়গা নির্বাচন করতে হবে। জমিতে সেচ দেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে। দুই বিঘা জমি কে চাষের উপযোগী করতে তিন থেকে চার ট্রাক পরিমাণ মাটির সাথে এক ট্রাক পরিমাণ গোবর মিশিয়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে এক মাস। অন্য জায়গায় ভালো জাতের মাতৃগাছ নির্বাচন করে টবে কিংবা মাটিতে আলাদা করে রোপন করতে হবে। এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রাফটিং, কাটিং বা লেয়ারিং করে চারা উৎপাদন করতে হবে। উৎপাদিত চারা পলিথিন বা টবে রাখতে হবে।
বাজারজাতকরণ : গাছ লাগানোর জন্য গ্রাম, শহর সব জায়গার মানুষই এখন সচেতন। এছাড়া সৌখিন মানুষ বাড়ির বারান্দা কিংবা অফিসের সৌন্দর্য আনতে গাছের চাষ করেন। তাই এর চাহিদা সর্বত্র। ক্রেতা নিজেই পণ্য নিতে নার্সারীতে আসেন। তবে ভ্যানগাড়িতে করে ফেরি করে গাছের চারা বিক্রি করা যায়।