চীনের মহাকাশজয়ের গর্বের প্রতীক থিয়ানওয়েন-১ - Mati News
Friday, December 5

চীনের মহাকাশজয়ের গর্বের প্রতীক থিয়ানওয়েন-১

মানুষ যুগের পর যুগ আকাশে তাকিয়েছে প্রশ্ন নিয়ে। রাতের আঁধারে ছড়িয়ে থাকা অনুচ্চারিত নক্ষত্রলিপি যেন প্রশ্নের পর প্রশ্ন রেখে যায় মানুষের মনে। ‘কী আছে ওখানে?’ ‘পৃথিবীর বাইরে কি আছে আর কোনো জীবনের আলো?’ এই অনন্ত প্রশ্নকে চীনারা দিয়েছেন এক কাব্যিক নাম—থিয়ানওয়েন, যার অর্থ হলো মহাকাশকে প্রশ্ন। আর চীনা কবি ছু ইয়ুয়ানের প্রাচীন কবিতা থেকে নেওয়া নামটি এখন চীনের মহাকাশ অনুসন্ধান অগ্রযাত্রার আধুনিক প্রতীক। এই নামেই চীন পরিচালনা করছে মহাকাশ অনুসন্ধান কার্যক্রম। মঙ্গল গ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু, এমনকি বৃহস্পতি পর্যন্ত অভিযাত্রার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে চীনের মিশন থিয়ানওয়েন।

চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন সিএনএসএ ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের গ্রহ অনুসন্ধান প্রকল্প হিসেবে থিয়ানওয়েন নামটি ঘোষণা করে।  এ কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হলো সৌরজগতের গ্রহগুলোর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস অনুসন্ধান, পানি, খনিজ ও জৈব উপাদানের চিহ্ন খোঁজা, ভিনগ্রহের বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশগত পরিবর্তন বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ মানুষের মহাকাশ ভ্রমণের পথ প্রস্তুত করা।

zhurong tianwen 1 china

আনুষ্ঠানিকভাবে এ মিশন শুরু হয় থিয়ানওয়েন-১ –এর মাধ্যমে। ২০২০ সালের ২৩ জুলাই অরবিটার, ল্যান্ডার ও চুরোং নামের একটি রোভারসহ থিয়ানওয়েন-১ পৌঁছায় মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে।

এটি ছিল একটি ব্যতিক্রমী মিশন। কারণ এটি একসঙ্গে তিনটি লক্ষ্যই পূরণ করেছে। প্রথমত, এটি সফলভাবে মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করেছে, মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল ও পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করেছে এবং চুরোং রোভার মঙ্গলের মাটিতে নেমে চালিয়েছে অনুসন্ধান।

মঙ্গলের ইউটোপিয়া প্ল্যানিটিয়া অঞ্চলে সফলভাবে অবতরণ করে রোভার চুরোং। মঙ্গলের মাটি, শিলা, বরফ ও আবহাওয়ার নমুনা বিশ্লেষণ করেছে ওটা। মঙ্গলে বরফের সম্ভাব্য স্তর এবং প্রাচীন নদী প্রবাহের অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রমাণ সংগ্রহ করে বিজ্ঞানমহলে আলোড়ন তোলে চুরোং।

এই মিশনের মাধ্যমেই মূলত বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে মঙ্গলে সফল ল্যান্ডিং করে চীন। তবে চীন এ মিশনে কিছু দিক দিয়ে আবার বিশ্বের প্রথম। যেমন, চীন প্রথম দেশ যারা একই মিশনে কক্ষপথ-অরবিটার ও রোভার মিশন সম্পন্ন করেছে। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চীন প্রথম চেষ্টাতেই মঙ্গলে সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করতে পেরেছে।

চীনের মহাকাশ যাত্রায় থিয়ানওয়েন-১ মিশনের নাম চির অমলিন থাকবে আরও কয়েকটি কারণে। ছয়টি স্পেসক্রাফটযুক্ত মঙ্গল জয় করা এই প্রোবটির ওজন ৫ টন। মহাকাশে যাওয়া সবচেয়ে ভারী প্রোবগুলোর মধ্যে একটি এটি।  লং মার্চ ৫ হেভি লিফট রকেটে করে এটাকে উৎক্ষেপণ করতে হয়েছিল।

উৎক্ষেপণের প্রায় সাত মাস পর, ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করে থিয়ানওয়েন-১। অরবিটারটি মঙ্গলগ্রহের পৃষ্ঠতল স্ক্যান করে কয়েক মাস ধরে। তারপর ঠিক করা হয় ল্যান্ডার ও রোভারের অবতরণ অঞ্চল।

২০২১ সালের ২২ মে ২৪০ কেজি ওজনের রোভার চুরোং নামে মঙ্গলের মাটিতে। এটি হলো বিশ্বের দ্বিতীয় রোভার, যার মধ্যে ছিল মঙ্গলের শব্দ রেকর্ড করার যন্ত্র।

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট চুরোং আনুষ্ঠানিকভাবে তার দায়িত্ব সম্পন্ন করে এবং ইউটোপিয়া প্লানিটিয়ার দক্ষিণ অংশের দিকে যাত্রা চালিয়ে যায়।

১৮ আগস্ট ২০২১ তারিখে, চুরোং মঙ্গলে ৯০ দিন অতিক্রম করে। চীনা বিজ্ঞানীরা পরে চুরোংকে মঙ্গলের আরেকটি অঞ্চল অনুসন্ধানের জন্য নতুন অভিযানের ঘোষণা দেন।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের শেষের দিকে, একবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে থিয়ানওয়েন-১ অরবিটার এবং চুরোং রোভার দুটোই সেইফ মোডে চলে যায় এবং যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে দুটি ডিভাইসই আবার সক্রিয় মোডে ফিরে আসে।

পরের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের ২০ মে, মঙ্গল গ্রহের আসন্ন বালিঝড় ও শীতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হাইবারনেশন মোডে রাখা হয়েছিল চুরোংকে। কিন্তু এরপর থেকে রোভারটি আর কোনো সংকেত পাঠায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, মঙ্গলের ধূলিঝড়ের কারণে চুরোংয়ের সোলার প্যানেল বালিতে ঢাকা পড়ে যাওয়ায় রোভারটি সক্রিয় হতে পারেনি।

রোভার কাজ না করলেও থিয়ানওয়েন-১ মিশনের মঙ্গলকে ঘিরে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা থিয়ানওয়েনের অরবিটারের কিন্তু চোখ এখনও খোলা। সম্প্রতি ওই অরবিটারের ক্যামেরায় ৩আই/অ্যাটলাস নামের একটি মহাজাগতিক বস্তু ধরা পড়েছে। হাই রেজোলিউশনের ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণের সময় ধূমকেতু সদৃশ বস্তুটি থেকে প্রায় ৩ কোটি কিলোমিটার দূরত্বে ছিল চীনের মার্স অরবিটার। এটি এখন পর্যন্ত ৩১/অ্যাটলাসের সবচেয়ে কাছের পর্যবেক্ষণগুলোর একটি।

এই পর্যবেক্ষণ ছিল মার্স অরবিটার থিয়ানওয়েন-১ মিশনের বাড়তি কাজের অংশ। গবেষকদের মতে, মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে ঘুরতে থাকা অবস্থায় এমন বস্তু শনাক্ত করার সক্ষমতা ভবিষ্যতের থিয়ানওয়েন-২ মিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবে।

এই অরবিটারে আছে একগাদা গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক সব যন্ত্রপাতি।

  • থিয়ানওয়েন-১ অরবিটারে আছে মডারেট রেজুলেশন ইমেজিং ক্যামেরা। দৃশ্যমান বর্ণালী অর্থাৎ আমরা সাধারণ ক্যামেরায় তোলা ছবি যেমন দেখি, এতেও ঠিক তেমন ছবি ওঠে। ৪০০ কিলোমিটার দূর থেকে প্রতি পিক্সেলে ১০০ বাই ১০০ বর্গমিটার ছবি তুলতে পারে এটি।
  • এর দ্বিতীয় ক্যামেরাটির নাম হাই রেজুলেশন ইমেজিং ক্যামেরা। ২৫৬ কিলোমিটার দূর থেকে প্রতি পিক্সেলে আড়াই বর্গমিটারের রেজুলেশন রয়েছে এর।
  • অরবিটারে আরও আছে একটি মার্স অরবিটার ম্যাগনেটোমিটার। মঙ্গল গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্রের মানচিত্র তৈরির কাজ করে এটি।
  • অরবিটারে থাকা মার্স মিনারেলোজিক্যাল স্পেকট্রোমিটার হলো একটি দৃশ্যমান ও নিকট-ইনফ্রারেড ইমেজিং স্পেকট্রোমিটার, যার শনাক্তকরণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য দশমিক ৪৫ থেকে ৩ দশমিক ৪ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি মঙ্গলের পৃষ্ঠের খনিজ গঠন বিশ্লেষণ, বিভিন্ন ধরনের পৃষ্ঠমাটির বিস্তার নির্ণয় এবং গ্রহটির স্তরবিন্যাস ও কাঠামো অনুসন্ধান করছে।
  • মার্স অরবিটার সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন রাডার যন্ত্রটি ডুয়েল পোলারাইজেশন রাডার প্রতিধ্বনি সিস্টেম ব্যবহার করে মঙ্গলের পৃষ্ঠে থাকা পানি বা বরফের লক্ষণ অনুসন্ধান করতে পারে।
  • এ ছাড়া মহাকাশ পরিবেশে উপস্থিত আয়নগুলোর প্রবাহ পরিমাপের জন্য আছে মার্স আয়ন অ্যান্ড নিউট্রাল পার্টিকেল অ্যানালাইজার এবং উচ্চ-শক্তির ইলেকট্রন, প্রোটন, আলফা-কণা ও অন্যান্য আয়নের শক্তি-বর্ণালি বিশ্লেষণের কাজ করছে মার্স এনারজেটিক পার্টিকেল অ্যানালাইজার।

থিয়ানওয়েন সিরিজের দ্বিতীয় মিশন—থিয়ানওয়েন-২। চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন ২০২৫ সালের ২৮ মে তারিখে এ মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণ করে। মহাজাগতিক নমুনা সংগ্রহের এই মিশন এখন ছুটে চলেছে তার লক্ষ্যে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *