শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় আর পাঁচটা বাড়ির মতোই সাদামাটা একটা বাড়িতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর জঙ্গি। যাকে অনেক দিন ধরে খুঁজছে সেনা জওয়ানরা। বাড়িগুলি একে অন্যের গায়ে লাগানো। পাঁচিলটাও শেয়ার করেছে একে অন্যের সঙ্গে। ফলে, জওয়ানরা কিছুতেই সেই জঙ্গিকে পাকড়াও করতে পারছে না। গুলি চালালে আশপাশের বাড়ির ক্ষতি হতে পারে। জঙ্গিটি ঠিক কোন বাড়িটাতে আস্তানা গেড়েছে, সেটাও পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। তাই আশপাশের কোন বাড়িটার মধ্যে দিয়ে গিয়ে জঙ্গির বাড়িটায় ঢোকা যাবে, জওয়ানরা সেটাও বুঝতে পারছেন না।
শরীরের ক্যানসার কোষ (টিউমার)-এ ‘আর্মি অপারেশন’ চালানোর ক্ষেত্রেও অসুবিধাটা হয় এমনই। ক্যানসারে কাবু কোষকে মারতে গিয়ে সুস্থ, স্বাভাবিক কোষও মারা যায়। গুরুতর জখম হয়।
অম্বরীশের কৃতিত্ব, তিনি টার্গেটেড ক্যানসার থেরাপির ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা মেটানোর দিশা দেখিয়েছেন। যা সহযোগীদের নিয়ে অম্বরীশ পুরোপুরি সফল ভাবে করে দেখিয়েছেন ইঁদুরের ওপর। যার পরের ধাপ মানুষের ওপর পরীক্ষা বা হিউম্যান ট্রায়াল।
টার্গেটেড ক্যানসার থেরাপিতে একেবারে সরাসরি ক্যানসারে কাবু কোষ বা টিউমারে পাঠানো হয় ওষুধ। যাতে রক্তের মধ্যে দিয়ে টিউমার কোষে পৌঁছনোর রাস্তায় তা পথ ভুলে না চলে যায় সুস্থ, স্বাভাবিক কোষে। বিশ্বের নানা প্রান্তেই চালু রয়েছে এই ক্যানসার থেরাপি। কিন্তু এই থেরাপিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধ টিউমারে না গিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক কোষে পৌঁছয়। তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে। ওষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় সুস্থ, কোষের ক্ষতি হয়। তাদের স্বাভাবিক বাড়-বৃদ্ধি থমকে যায়। তার থেকে অন্য রোগ বা উপসর্গের জন্ম হয়।
টার্গেটেড ক্যানসার থেরাপি করা হয় কী ভাবে?
ন্যানো-মোটর পার্টিকল বা অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা-পদার্থ দিয়ে। যা জৈব (অরগ্যানিক) বা অজৈব (ইনঅরগ্যানিক) যৌগ দিয়ে বানানো হয়। সেই ন্যানো-মোটর পার্টিকলগুলির মধ্যে ওষুধ পুরে দেওয়া থাকে। আর ন্যানো-মোটর পার্টিকলের বাইরের গায়ে লাগানো থাকে নানা ধরনের অ্যান্টিবডি পদার্থের অণু। ন্যানো-মোটর পার্টিকলগুলি ধমনীর রক্তস্রোত সাঁতরে গিয়ে পৌঁছয় ক্যানসারে কাবু কোষ বা টিউমারে। বা তার আশপাশের কোষে। সঙ্গে সঙ্গে ন্যানো-মোটর পার্টিকলের বাইরের গায়ে লাগানো অ্যান্টিবডি পদার্থের অণু সেই ক্যানসারে কাবু কোষ বা টিউমারের গায়ে স্টিকারের মতো লেগে যায়। যেন আঠা দিয়ে তাকে সেঁটে দেওয়া হল টিউমারের গায়ে। আর তখনই ন্যানো-মোটর পার্টিকলগুলির ভেতর থেকে ওষুধ বেরিয়ে এসে ক্যানসারে কাবু কোষের ওপর পড়ে। তাতেই ক্যানসারে কাবু কোষ নিস্তেজ, নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
টার্গেটেড ক্যানসার থেরাপির অসুবিধাগুলি কী কী?
অম্বরীশ জানাচ্ছেন, মূলত তিনটি ক্ষেত্রে সমস্যা হয় এই ধরনের থেরাপিতে।
প্রথমত, এই থেরাপিতে যে ন্যানো-মোটর পার্টিকলগুলি শরীরের ভেতরে পাঠানো হয়, সেগুলি অনেক সময়েই টিউমার কোষের বদলে সুস্থ, স্বাভাবিক কোষগুলির ওপর ওষুধ ঢেলে দিয়ে আসে। তাতে খুব ক্ষতি হয় সুস্থ, স্বাভাবিক কোষগুলির।
যে ভাবে ন্যানো-মোটর পার্টিকল দিয়ে টিউমার কোষে পাঠানো হয় ওষুধ। দেখুন ভিডিয়ো
দ্বিতীয়ত, এই থেরাপিতে ওষুধের পরিমাণ কতটা কম রাখলে সুস্থ, স্বাভাবিক কোষের কোনও ক্ষতি হবে না, তা আগেভাগে বলে দিতে পারা যায়। কিন্তু সেই ওষুধের পরিমাণ কতটা বেশি হলে সুস্থ কোষের ক্ষতি কতটা বেশি হবে, আগেভাগে তা আঁচ করার কোনও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি এখনও বিজ্ঞানীদের জানা নেই।
তৃতীয়ত, এই থেরাপিতে ন্যানো-মোটর পার্টিকলগুলির বাইরের গায়ে যে অ্যান্টিবডি পদার্থের অণু লাগানো থাকে, সেগুলি রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সুস্থ কোষের গায়ে সেঁটে গেলে স্বাভাবিক কোষগুলির ক্ষতি হয়।
অম্বরীশের কৃতিত্ব কোথায়?
অম্বরীশ ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা ন্যানো-মোটর পার্টিকলগুলিকে রিমোটে চালানো গাড়ির মতো ব্যবহার করেছেন। যে ভাবে এক দিন বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াবে সেল্ফ-ড্রিভেন কার বা, চালকহীন গাড়ি। তারা আপনাআপনিই চলবে। সিগন্যালে থামবে। আবার সিগন্যাল খুললে চলতে শুরু করবে।
অম্বরীশ যে ন্যানো-মোটরগুলি বানিয়েছেন, সেগুলি ধমনীর রক্তস্রোতে দক্ষ সাঁতারুর মতো সাঁতার কেটে এগোবে তাদের লক্ষ্য ক্যানসারে কাবু কোষের দিকে। তাই সেগুলিকে ‘ন্যানো-সুইমার্স’ও বলা হয়। আবার যান্ত্রিক ভাবে তারা রক্তস্রোতে এগোয় বলে তাদের ‘ন্যানো-মোটর’ও বলা হয়। গবেষকরা ইঁদুরের শরীরে ১০ কোটি ন্যানো-মোটর পাঠিয়ে পরীক্ষায় সফল হয়েছেন।
ক্যানসারের চিকিৎসায় শরীরের ভেতরে পাঠানো ন্যানো-মোটর
অম্বরীশদের বানানো এই ন্যানো-মোটরগুলি দেখতে অবিকল স্ক্রু-এর মতো। আকারে খুব ছোট। লম্বায় বড়জোর এক মাইক্রন। আর চওড়ায় মেরেকেটে ৫০ থেকে ২০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে।
অম্বরীশদের আরও কৃতিত্ব, তাঁরা ওই ন্যানো-মোটরগুলির বাইরের গায়ে কোনও অ্যান্টিবডি পদার্থের অণু লাগাননি। তার বদলে লাগিয়েছেন কোনও জৈব বা অজৈব যৌগের অণু।
ন্যানো-মোটরের বাইরের গায়ে অ্যান্টিবডি না লাগানোর সুবিধাটা কী?
অম্বরীশের কথায়, ‘‘অ্যান্টিবডিগুলির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হল, সেগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই টিউমার কোষের বদলে রক্তস্রোতে ভেসে গিয়ে সুস্থ কোষগুলির গায়ে সেঁটে যায়। এতে সুস্থ, স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি হয়। আমরা যেহেতু অ্যান্টিবডি ব্যবহার করছি না, তাই সেই আশঙ্কা প্রায় থাকলই না বলা যায়।’’
এটা অবশ্যই অভিনব পদ্ধতি টার্গেটেড ক্যানসার থেরাপির ‘ইন-ভিভো ট্রিটমেন্ট’ (শরীরের ভেতরে চিকিৎসা)-এর ক্ষেত্রে।
অম্বরীশদের বাড়তি কৃতিত্ব, তাঁরা ওই ন্যানো-মোটরগুলির বাইরের গায়ে লাগানো জৈব বা অজৈব পদার্থগুলিকে এমন ভাবে বেছেছেন, যাদের চৌম্বক ধর্ম (ম্যাগনেটিক প্রপার্টিজ) রয়েছে। মানে, বাইরে থেকে কোনও চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা গেলে, ন্যানো-মোটরের বাইরের গায়ে লেগে থাকা পদার্থগুলি চুম্বকের মতো ব্যবহার করে। ফলে, আমরা যেমন ভাবে চাইছি, যে দিকে তাদের পাঠাতে চাইছি, বাইরে থেকে চৌম্বক ক্ষেত্রের মাধ্যমে ন্যানো-মোটরগুলিকে ঠিক সেই ভাবেই, সেই দিকেই চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। ফলে, ন্যানো-মোটরগুলি আর টিউমারের বদলে সুস্থ, স্বাভাবিক কোষে পৌঁছবে না। শরীরের ভেতর রিমোটে তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যা এর আগে বিশ্বের আর কোথাও করে দেখানো সম্ভব হয়নি।
যে ভাবে টিউমার বা ক্যানসারে কাবু কোষকে বন্দি করে ন্যানো-মোটর
‘ইন-ভিট্রো ট্রিটমেন্ট’-এও সাফল্যের চেষ্টায় অম্বরীশরা
ইন-ভিট্রো ট্রিটমেন্ট বলতে বোঝায় কোনও ওষুধ আবিষ্কারের জন্য গবেষণাগারে পরীক্ষানিরীক্ষা করা। আমাদের শরীরে অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই আমাদের শরীরের পক্ষে খুব জরুরি। তাদের কাজে লাগে আমাদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াগুলিকে ঠিকঠাক রাখতে। কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া অবশ্য আমাদের ক্ষতিও করে। ধরা যাক, আমাদের রক্তে ১০ রকমের ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। তাদের মধ্যে দু’টি খুব ভাল ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আমরা কোনও ওষুধ বানাতে চাইছি। তখন রক্তের নমুনা নিয়ে সেখান থেকে আমাদের ১০ রকমের ব্যাকটেরিয়া থেকে ভাল দু’টি ব্যাকটেরিয়াকে বেছে নিতে হবে। আলাদা করে নিতে হবে। সেই কাজটার জন্যেও ন্যানো-মোটর ব্যবহার করা হয়। সে ক্ষেত্রে ন্যানো-মোটরগুলির বাইরের গায়ে যে পদার্থের ‘কোট’ লাগানো থাকে, তাদের ওপর আলো (দৃশ্যমান আলো বা ইনফ্রারেড রে) ফেলে তাদের ‘চিমটে’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। মানে, আলো ফেললেই ওই পদার্থগুলির যেন দু’টি ‘হাত গজিয়ে যায়’। অনেকটা চিমটে বা টুইজার-এর মতো। তখন সেই ‘চিমটে’ দিয়ে রক্তের নমুনায় থাকা ১০ রকমের ব্যাকটেরিয়া থেকে ভাল দু’টি ব্যাকটেরিয়াকে আলাদা করে বেছে নেওয়া যায়। তাদের বাকি ব্যাকটেরিয়াগুলি থেকে পুরোপুরি আলাদা করে আটকে ফেলা যায়।
অম্বরীশ অবশ্য জানাচ্ছেন, এই কাজে তাদের সাফল্য এখনও আসেনি পুরোপুরি। তাঁদের আরও গবেষণা চালাতে হবে।
ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, বেঙ্গালুরু ও ইনস্টিটিউট ফর মলিকিউলার বায়োসায়েন্স