ধ্রুব নীলের বাংলা থ্রিলার উপন্যাস রক্তদ্বীপ পর্ব-৩
খেপা ঝড়
ঢাকায় আসার পর তুষারের মনে হলো আইনস্টাইন সঠিক। সময় আপেক্ষিক। দ্রুত চলে যেতে লাগল।
কুসুমচর থেকে আনা কীটপতঙ্গখেকো গাছের চারাগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে ল্যাবরেটরিতে। এর মাঝে নতুন কোনো প্রজাতি আবিষ্কার হয় কিনা সে আশায়। একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বোটানির ওপর পার্টটাইম ক্লাস নেয়। তা ছাড়া সিনিয়ররা তাকে পছন্দ করে বলে যখন তখন ল্যাব ব্যবহার করতে পারে তুষার। আপাতত গবেষণার দায়িত্বটা বুঝিয়ে দিয়েছে পারমিতাকে। এ দুই কলিগ এখনো নিজেরা নিজেদের সম্পর্কের বিষয়ে পরিষ্কার নয়। যদিও মিলন এটাকে প্রেম স্বীকৃতি দিয়েছে, তথাপি দুজন একসঙ্গে গাছপালা নিয়ে গবেষণা করাটাই বেশি উপভোগ করছে। কুসুমচর থেকে ফেরার পঞ্চম দিনের মাথায় পড়ানোর চাপ আর একটা জমজমাট থ্রিলার গল্প লেখার চাপে দ্বীপটার কথা ভুলতেই বসেছিল। মনে করিয়ে দিল মিলনের ফোনকল।
‘তোর মাথা থেকে ভূতটা গায়েব হয়েছে কিনা কনফার্ম কর। নইলে তোকে কিডন্যাপ করে আটকে রাখা ছাড়া গতি নেই।’
‘হা হা হা। ভুলেই বসেছিলাম কুসুমচরের কথা। আবার মনে করিয়ে দিলি। অমাবস্যার আর কদিন বাকি পাঞ্জেরি?’
‘ফাইজলামি করিস না! তুই মর, আমার আপত্তি নাই। সঙ্গে আমাকে নিয়া মরতে পারবি না!’
‘তুই তাহলে সবার সঙ্গে অন্য কোথাও…।’
‘খবরদার। তুই মাথা থেকে এটা ঝাড়। আমার টেনশন লাগছে। আমার যদি হার্ট অ্যাটাক হয় তোরে খাইছি!’
‘তোর হার্ট টাইটানিয়াম-গোল্ড অ্যালয় দিয়ে বানানো। কিসসু হবে না দোস্ত। সময় হলে মনে করিয়ে দিস।’
‘সময় হলে তোকে আমি বেঁধে রাখতে আসব।’
‘আমার ধারণা তুই আকুলি বিকুলি করছিস যাওয়ার জন্য। এক কাজ কর, এক্সপেরিমেন্টটা নিয়ে ভাব। একটা অ্যান্টি-ভূত পোশাক বানানো যায় কিনা দেখ। তোর না পরিচিত পুলিশ আছে। তাকে বল পিস্তল নিয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে। ভূতের সঙ্গে ফাইট হবে।’
‘আসি আগে! দাঁড়া।’
মিলনের দেখা নেই আরো চারদিন। শেষের দিকে দ্বিধায় পড়ে গেল তুষার। ক্যালেন্ডার বলছে অমাবস্যার চারদিন বাকি। পারমিতা যথারীতি ঘটনার মধ্যে ভুতুড়ে কিছু খুঁজে পায়নি। তার মতে, ঘটনাগুলো সাধারণ এবং লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি কারণ বেশিরভাগই মারা গেছে হয় খাঁড়ির পানিতে না হয় সমুদ্রের কিনারে। জোয়ারের পানিতে লাশ ভেসে গেছে এবং পাথুরে সৈকতে খুঁজলে হাড়গোড় মিলবেই। তবে দ্বীপ থেকে আনা গাছগুলো নিয়ে সে খানিকটা চিন্তিত। গাছগুলো নুইয়ে পড়েছে। পানি, আলো, সার-মাটি সব ব্যবস্থাই করেছিল। কিন্তু তাজা হওয়ার লক্ষণ নেই।
পরদিন সকাল। কড়া নাড়ার শব্দ শুনেই তুষার বুঝল কে এসেছে। ঢুকেই ফ্রিজ খুলে আগে একটা আপেল বের করে কামড় বসাল মিলন।
‘ব্যবসা থেকে ছুটি নিলাম।’
‘খুব ভাল। জামা কাপড় কিছু এনেছিস সঙ্গে? নাকি আমারগুলোই নিবি?’
‘জামা কাপড় আনবো কোন দুঃখে। আমরা তো কোথাও যাচ্ছি না।’
ক্লিন শেভ করা মিলনকে দেখাচ্ছে জেমস বন্ডের মতো। আক্ষেপ, এখনো বন্ডগার্ল জুটল না কপালে।
‘ব্যাগ গোছানোই আছে। ব্যবস্থা কিছু নিয়েছিস? ভূত তাড়ানোর মন্ত্রের বই কিংবা রসুন টসুন? দেশি রসুন লাগবে নাকি ইন্ডিয়ানটা চলবে?’
মিলন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রোদ পোহাচ্ছে। দশ তলার বারান্দা থেকে নিচে তাকাল।
‘বারান্দা থেকে এই জঞ্জাল সহ্য করিস কী করে?’
‘এই জন্য ভাবছি একটু ঘুরে টুরে আসা দরকার। দুদিন পর অমাবস্যা।’
‘কেন? এর পরই বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চাস? ভাবিকে নিয়ে সেন্ট মার্টিন থেকে ঘুরে আয়।’
হাসল তুষার। মিলনের কথার সুর বদলেছে। তারমানে অ্যাডভেঞ্চারের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করে নিচ্ছে। এখন ভাবছে নিরাপত্তা নিয়ে।
‘হুমম।’
চোখ বুঁজে বারান্দার ইজি চেয়ারে ঝিম মেরে বসল। দোল খাচ্ছে আর ভাবছে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কাকে যেন ফোন করে বিড়বিড় করে কিছু বলল। তুষার উঠে ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে পাউরুটিতে মাখন লাগাচ্ছে। লঞ্চ ছাড়বে রাতে। হাতে সময় আছে। সাগর এখন উত্তাল। কুসুমচর পর্যন্ত কোনো লঞ্চ যাবে না। ইঞ্জিন নৌকা আসাযাওয়া করে দুয়েকটা। আপাতত স্পিডবোটই ভরসা।
‘ভাবিকে ফোন করে বলি।’
‘দুর! ফোন করার কিছু নাই। অযথা টেনশন। ভূতের চেয়ে ওর বড় ভয় সমুদ্রে।’
‘না মানে, বিদায় টিদায় নেওয়া উচিৎ। বাঁচার তো চান্স নাই।’
‘হুম, ঠিক! দে ফোন! করুক টেনশন!’
দুপুরে খেয়ে লম্বা ঘুম দিল মিলন। তুষার গেছে ল্যাবে। পারমিতার সঙ্গে গল্প করতে। কথার ফাঁকে ছুটি চাওয়াটাই উদ্দেশ্য।
‘যাবে যাও, কথা ঘোরাতে হবে না। তবে তোমার এক্সট্রা ক্লাস আমি নিতে পারব না!’ কপট রাগ পারমিতার গলায়।
‘না মানে, একটা এক্সপেরিমেন্ট।’
‘যাও! একা একা ভূত তাড়াও। মিলনের আইডিয়া তাই না?’
শ্লেষটা স্পষ্ট। তবে মিলন যে তুষারের প্রাণের দোস্ত সেটাও জানে।
‘ওই তো জেদ করছে। না গেলে বেচারা…।’
‘ভূতটুথ নিয়ে আমার টেনশন নেই। কিন্তু সমুদ্রের অবস্থা ভালো না। তুমি সাঁতার জানো তো?’
‘লাইফজ্যাকেট আছে। সাঁতারও পারি।’
‘শেষ কবে পানিতে নেমেছিলে?’
হাসল তুষার। সম্মতি মিলেছে। পারমিতাও অন্যদিকে চোখ সরাল। তুষার জানে ওই মুখে এখনো যথেষ্ট রাগ, অভিমান মেশানো।
‘যাব আর আসব। এক রাতের মামলা।’
‘তোমার গাছগুলো সব মরে যাচ্ছে। মাটিটা পাঠিয়েছি আরেকটা ল্যাবে। দেখা যাক, কোনোটা টেকে কিনা। তুমি শিওর দ্বীপটাতে তুমি ড্রাগন ট্রি দেখেছো? এটা ফাঁস হলে কিন্তু বিপদ। কাউকে গল্প করতে যেও না। পরে ছুটবে সবাই। দ্বীপটা হয়ে যাবে গাছ চোরাকারবারিদের বাজার।’
এরপর টুকটাক কথাবার্তা সেরে দ্রুত আবার বাসার দিকে ছুট লাগাল তুষার। কিছু যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে হবে। জিপিএস লোকেটর, স্যাটেলাইট ফোনসহ কিছু টুকিটাকি। বুথ থেকে টাকাও তুলে নিল। স্পিডবোটটাকে কয়েকদিনের জন্য ভাড়া করবে ভাবছে। কিন্তু এতসব আয়োজন কীসের জন্য সেটা ঠিক নিজেও জানে না।
লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে বাদাম চিবুচ্ছে মিলন। শীত শীত লাগলেও হাফ হাতার গেঞ্জি পরে আছে দুই বন্ধু। বড় লঞ্চে পানির দুলুনি অতটা টের পাচ্ছে না। নিচে তাকিয়েই বুঝতে পারল নদীর মেজাজ ভাল নয়। কদিন পর সমুদ্রেও সতর্ক সঙ্কেত দেখা যাবে।
‘প্ল্যানটা কী?’
মিলন গলা যতটা সম্ভব কঠোর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তুষার আছে আমুদে মেজাজে। একটা প্ল্যান আছে তার।
‘প্ল্যান কিছুই না। সবাইকে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেব। এরপর আমরা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব। দেখি কে তাড়া করে।’
‘আমি কালামকে ফোন করেছি। তুই তো মনে হয় চিনিস না। আমার পুলিশ বন্ধু। ইনকেইস যদি কোনো সিরিয়াল কিলার হয়। অবশ্য ও আসতে পারবে কিনা শিওর না। তারপরও সব জানিয়ে রেখেছি।’
‘হুম। দৈত্য দানোর বেলায় রিভলবার কাজে আসবে না।’
তুষারের কথা গায়ে মাখাল না মিলন। পকেট থেকে একটু পরপর নিজের হাতে আঁকা কুসুমচরের ম্যাপটা বের করে দেখছে। সঙ্গে ব্যাগও নিয়েছে দুটো। তাতে কী আছে খোদাই জানে!
বড় বড় ঢেউ কেটে এগিয়ে চলছে স্পিডবোটে। চালকসহ তিনজন। শব্দের চোটে কেউ কারো কথা শুনছে না।
সূর্য উঠে গেল কুসুমচরের দেখা পেতে। বোটের শব্দ থামতেই যেন ঝপ করে নীরবতার চাদর পড়ল কানের পর্দায়। চালক তরুণ বয়সী। নাম ইকবাল। মিলনের পরিচিত। কুসুমচরে আগেও কয়েকবার এসেছিল।
‘কিরে, সবাই ভেগেছে নাকি? নৌকা টৌকা কই?’
মাইলখানেক দূরে একটা নৌকা দুলছে। বড়শি ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে একজন। হামু হবে হয়তো।
মিলন সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাঁটা দিল। ইকবালও আসছে সঙ্গে। দুয়েকটা দিন সঙ্গেই থাকবে ছেলেটা। পশ্চিম সৈকত ধরে থেকে আগের সেই চেনা পথ। বুড়ো নিশিকান্ত আর চিরুর দেখা পেল। তুষার দেরি না করে চিরুর দিকে বাড়িয়ে দিল চকোলেটের বাকশো। হাসিটা খুব একটা চওড়া হলো না তার। অজানা ভয় ছেয়ে আছে মুখে। প্রথম দেখায় নিশিকান্ত বেশ উৎফুল্ল দেখালেও পরক্ষণেই আবার নুইয়ে গেল বৃদ্ধ।
‘আসো আসো। হাতমুখ ধোও। ও চিরু, খাওন দে, খাওন দে।’
বুড়োকে শান্ত হতে বলে মিলন পেছনের কলতলায় গেল। খুব একটা কথাবার্তা বলছে না। কোথায় যাচ্ছে সেটাও বলল না। আগামীকাল অমাবস্যা। চোখমুখ এখন থেকেই শক্ত করে বসে আছে। নিশিকান্তের জন্য কিছু কাপড় উপহার এনেছে তুষার। উপহার পেয়েও বুড়োর বিষণœতা কাটেনি। সব গোছগাছ করে রেখে দিল পরে পরবে বলে।
দুপুরে খেয়েই বের হল দুই বন্ধু। তার আগে সমুদ্রে দাপাদাপি করে গোসলও সেরে নিল। ইকবাল ঘুমুচ্ছে। ভূতপ্রেত বা অপঘাতে মৃত্যু বাবদ তার মাথাব্যথা নেই।
মিলনদের সঙ্গে চিরু আছে।
‘চিরু মিয়া সবাই গ্রাম ছেড়ে পলাইতাসে ক্যান কও দেহি।’
‘পলাইসে আর কই। সব মরসে।’
‘মানে কী!’
‘আপনেরা যাওনের পর থেইকাই মরা শুরু। দশ বিশডা না জানি ত্রিশ চল্লিশ জনও মরসে।’
‘তোমরা পালাওনি যে?’
‘আমগোরে নৌকায় জায়গা দিলে তো। আর নানাজান যাইব না। যাগো গরু ছাগল আর টেকাটুকা ছিল তারা নৌকায় জায়গা পাইসে।’
মন খারাপ হলো দুই বন্ধুর। এমনটা জানলে দুজনকে ঢাকায় নিয়ে রেখে আসত। তাতে অবশ্য বুড়ো রাজি হতো বলে মনে হলো না।
‘চিন্তার কারণ নাই চিরু মিয়া। এবার দানো আসুক আর না আসুক তুমি আমাদের লগে ঢাকায় যাইতেসো।’
বুড়োর মতো চিরুও মুখ ভার করে রইল। কোনো এক কারণে কুসুমচরের কাছে সেও যেন আটকা পড়ে আছে।
‘ওরে মিলন, এক মাইল হয়ে গেল। কারোর মাথামুণ্ডুর দেখা পেলাম না। বাড়িঘরে জিনিসপত্র রেখেই ভেগেছে দেখছি। অবশ্য পুরনো হাড়ি আর বাঁশের মাচা তো আর নৌকায় বয়ে বেড়াবে না কেউ।’
নিজেই নিজের ব্যাখ্যা শুনল তুষার। মিলন ভাবছে অন্য কিছু। রাস্তায় অনেকগুলো ডাব পড়ে থাকতে দেখল। অচেনা ফলও আছে। কয়েকটা মরা ছাগল দেখল। মরার কারণ জানাতে পারল না চিরু।
তুষার অবাক, কোনো দুর্গন্ধ পাচ্ছে না। মনে হলো যেন মমি করা হয়েছে মৃতদেহগুলোকে। দক্ষিণ থেকে উত্তর চষা হয়ে গেল। এর মাঝে দুতিনটা পরিবারের দেখা মিলেছে। একটি পরিবার বোঁচকা নিয়ে তৈরি। মুখে আশঙ্কা নিয়ে মিলনের কাছে জানতে চাইল পরের লঞ্চ কখন আসবে। মিলন আশ্বাস দিয়েছে লঞ্চ না আসলেও স্পিডবোটে করে তাদের পৌঁছে দেওয়া হবে গন্তব্যে।
দেখা পেল একজোড়া বুড়ো বুড়ির। উঠোনে বসে রোদ পোহাচ্ছিল। মিলন আর তুষারকে দেখে হাসল। ভয় নেই দুজনের।
‘বুড়িমা। পড়ে আছো কেন? যাবে না?’
তুষারের কথায় হাসি আরো চওড়া হলো। চিরু জানাল এ দুজনকে হুড়–ম বুড়ো-বুড়ি নামে চেনে সবাই।
‘যামু নাহ! মরলে মরসি।’
বুড়ো বলল, ‘আর বাঁইচা কাম নাই। কুসুমচরে জম্মো, এইখানেই মরণ। তোমরা এইখানে আইলা? চইলা যাইও। কাইলকা আবার ভরা কটাল।’
চিরু জানতে চাইল ভরা কটাল মানে কী। মিলন বুঝিয়ে দিল অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় চাঁদের টান বেশি থাকে, তাই জোয়ারও বড় হয়।
‘ও.. দানো তাইলে জোয়ারের পানিতে ভাইসা আসে?’
‘হতেও পারে।’ ঠোঁট কামড়াল তুষার। একটা না একটা সম্পর্ক তো আছেই। পূর্ণিমা আর অমাবস্যা নয়, সম্ভবত এই ভুতুড়ে কাণ্ডের সঙ্গে চাঁদের সম্পর্ক আছে। অথবা চাঁদের টানের।
‘হুমম।’
‘তুই এখনো হুম হাম করলে হবে? আজকের দিনটাই হাতে আছে। বুদ্ধিটা কী?’
‘তুই ব্যাগ থেকে মাইকটা বের করে একটু এনাউন্স করে দে। সবাই যাতে কাল নৌকায় চড়ে বসে।’
‘এনাউন্স করা লাগবে না। আছেই দুই বুড়ো বুড়ি। ওদের আর চিরু আর নিশিকান্ত কাকাকে হামুর নৌকায় তুলে দিলেই হবে। স্পিডবোটও আছে। ওটা চিন্তার বিষয় না।’
‘আমার আসলেই কোনো বুদ্ধি নেই। আমি নিজে ঘটনার মুখোমুখি হতে চাই। ঘটনা না দেখা পর্যন্ত কিছু বোঝা যাবে না। তোর পুলিশ বন্ধুর কী অবস্থা। আসবে?’
‘জানি না। তোর ওই ফোন দিয়ে কি মোবাইলে কল করা যাবে? পেলি কোথায় এটা?’
তুষার পকেট থেকে অ্যান্টেনাওয়ালা বিদঘুটে ফোনটা বের করল। জিনিসটা ওর হাতে অবৈধ। এক বন্ধুর কাছ থেকে কদিনের জন্য বলে কয়ে ধার চেয়েছে। একটা নম্বর টিপল।
‘হ্যালো। হুম আমি।’ নিশ্চিত হলো মিলন, অপরপ্রান্তে পারমিতা।
‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। গাছগুলো আবার তাজা হচ্ছে। আরো কিছু স্যাম্পল কালেক্ট করো। দেখি বাগান বানানো যায় কিনা।’
‘সাবধান, তোমার বাগান আবার তোমাকে যেন আবার খেয়ে না ফেলে!’
‘হ্যালো হ্যালো। তুষার। শুনতে পাচ্ছি না। জোরে বল।’
‘বলছিলাম কেমন আছো, দুপুরে খেয়েছো?’
‘আমার দুপুরের খাওয়া নিয়ে আবার ভাবা শুরু করলে কবে থেকে! ভালো কথা, সমুদ্রে ট্রলার বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। ঝড়টড় আসবে। স্পিডবোট আরো রিস্কি।’
‘হ্যালো হ্যালো। লাইনে এত ডিসটার্ব কেন!’
খানিক পর আবার শোনা গেল পারমিতার গলা।
‘হুম। ল্যাবের ভেতর নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছিল। এখন বাইরে।’
‘এখানে সব আজব ব্যাপার স্যাপার।’
‘আমার কাছে বড় আজব ঘটনা এখন তোমার এই ট্যুর। ঝড়ঝাপটার মৌসুমে স্পিডবোট নিয়ে..।’
‘সঙ্গে এক্সপার্ট ড্রাইভার আছে। স্পিডবোট লাফিয়ে লাফিয়ে চলে।’
‘উড়ে উড়ে যেতে বলবে। পানিতে না থাকলেই ভাল।’
পারমিতা আবার ল্যাবে ঢুকল। এমন সময় লাইন আবার কেটে গেল। তুষারও কলব্যাক করল না। চুপচাপ বসে থাকল খানিকক্ষণ। মুখে প্রকাশ না করলেও ভেতরে আচমকা দারুণ টেনশন করছে। এতো টেনশন করার পাত্রী সে নয়। ল্যাব থেকে গাছগুলোকে বাসায় নিয়ে রাখতে হবে। সূর্যের আলো দরকার। রাতে আবার মাইক্রোবায়ালা স্টাডি বাকি। কিন্তু তুষারকে নিয়ে আচমকা ভয় চেপে বসেছে।
এখন আর তেমন কিছু করার নেই। অপেক্ষা ছাড়া। তুষার ঘুরে ঘুরে কিছু ফুলের বীজ আর চারাগাছ ব্যাগে ভরল। দ্বীপের ভূতের চেয়েও এখানকার গাছপালা নিয়ে তার আগ্রহ বেশি।
মিলন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়েছে কয়েকবার। বন্ধু কি ভূতের সঙ্গে ফাইট করতে এসেছে নাকি গবেষণা করতে সেটা ভাবছে। তুষার বুঝতে পেরে হাসল। আশ্বস্ত হলো মিলন। ওই হাসির মানে হলো তুষারের একটা প্ল্যান আছেই।
রাতে খেতে বসেছে সবাই। নিশিকান্তের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকায় এখনো বেশ শক্তপোক্ত শরীর। নিজেই রান্না করে।
‘বাবারা আমার একটা কথা। তোমরা অতিথি। তোমাদের বড় পছন্দ। কাইল সক্কালেই কিন্তু তোমরা চিরুরে নিয়া চইলা যাবা।’
কিছু বলল না তুষার ও মিলন।
‘শোনো, আবার নিশির খেপা ডাক আসতেসে।’
নতুন শব্দ শুনে সচকিত দুই বন্ধু। ইকবালের যথারীতি গল্পে কান নেই। তুষার ও মিলনের উৎসুক দৃষ্টি দেখে গল্পটা বলতে অনেকটা বাধ্যই হলেন নিশিকান্ত।
‘আমার বয়স তখন বিশ। প্রথম কুসুমচরে আসি। ওইটা এই কুসুমচর কিনা আমি নিশ্চিত না। দেশে তখন যুদ্ধ।’
‘কিন্তু আপনি তো বলেছেন বেশিদিন হয়নি।’
‘আমি চইলা গেছিলাম মাঝে। পরে আবার আসছি।’
‘ঘটনা বলেন।’ তাগাদা দেয় মিলন।
‘পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেইকা বাঁচতে ট্রলারে কইরা এতদূর চইলা আসবে কেউ ভাবে নাই। আইসা দেখে এখানে আগে থেকেই অনেকে আছে। যারা ছিল তাদের অনেকে যুদ্ধের কথা জানতোই না। শান্তিতেই ছিল তারা। তয় তখনও ছিল নিশির ডাক ছিল।’
‘মানে ওই সময়ও পূর্ণিমা আর অমাবস্যায়..।’
‘হ বাবারা। কিন্তু আমরা আসার পর থেইকা নিশি খেইপা গেল বেদম। এক সপ্তাহ না যাইতেই দাদারে খাইল। তারপর মা গেল। আমার পরিবার বলতে গেলে শেষ। বাঁইচা ছিল খালি আমার বাপ। উনি ছিলেন খেপা কিসিমের। ডরাইতো না কিছু। ঘটনার দিন রাইতে গেলাম মাছ মারতে। সে কি বেদম ঝড়। সব উল্টাইয়া পাল্টাইয়া যায়। কিন্তুক…।’
বিরতি দিলেন নিশিকান্ত।
‘আমি ছিলাম দূর সাগরে। ঝড়ে আমার নৌকা একটুও নড়ল না।’
‘ঝড়টা শুধু কুসুমচরে ছিল?’
‘কুসুমচর মানে, হ তা কুসুমচরই ছিল নাম। ওইখানে দেখি ঝড়। সাগর পুরা ঠাণ্ডা। কুসুমচর উল্টাইয়া পুল্টাইয়া যাইতেসে। গাছগুলা পাগলের লাহান উড়াউড়ি করসিল। সব ভাইসা গেল। মানুষগুলা সব পাগলের মতো সাগরে লাফাইয়া পড়ল। চোখের সামনে কুসুমচর ডুব দিল।’
‘মানে ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে গেল?’
‘আরে নাহ। ঢেউ তো ছিল না। আমি তো নৌকায় বসা। সাগর একেবারে ঠাণ্ডা। না দেখলে বুঝবানারে বাপু। আস্ত কুসুমচর ডুইবা গেল।’
‘এরপর?’
‘এরপর আমি নৌকায় ভাসতে ভাসতে টেকনাফ আইসা পড়ি। কয়দিন লাগসিল মনে নাই। শুধু এইটুক জানি নৌকা লইয়া খুব বেশি মানুষ পলাইতে পারে নাই। হুড়–ম বুড়াবুড়িরে দেখসিলাম নৌকায় উঠতে পারসিল। তহন তো আর ইঞ্জিন নৌকা ছিল না। যে যেমনে পারসে ভাইসা পড়সে। দিনকতক কাঁচা মাছ খাইয়া ছিলাম। তারপর একদিন যুদ্ধ শেষ হইলো। আমরা পাহাড়ি এলাকায় এই কাম ওই কাম কইরা ছিলাম কিসুদিন। এরপর মন টিকল না। বাইর হইয়া পড়লাম নৌকা লইয়া। ঘুরতে ঘুরতে আবার কুসুমচর পাইয়া গেলাম। আইসা দেখি আমার আগেই অনেকে আইসা হাজির। পুরা গেরাম হইয়া গেসে। আগের কোনো চিহ্নই নাই।’
‘এমনও তো হতে পারে ওটা সেই কুসুমচর না।’
আমিও তাই ভাবসিলাম। কিন্তুক ওই বটগাছটা আছে না। ওই যে।’ পুবের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখায় নিশিকান্ত। ওটা যেমন দেখছিলাম ওই রকমই আছে। ওইটা দেইখাই আমি নিশ্চিত হই।’
‘কিন্তু!’ খাবার আটকে গেল তুষারের।
‘আমিও জানি। ডুইবা গেলে গাছ টিকনের কথা না। কিন্তু এটাই সত্য। এমনও হইতে পারে আমরা সবাই ভাইগা যাওনের পর পানি নাইমা যায়। আবার উইঠা পড়ে কুসুমচর।’
তুষার দুয়ে দুয়ে চার মেলাচ্ছে। মিলন টি ব্যাগ আর চিনি দিয়ে চা বানাতে ব্যস্ত। কাপ হাতে দুই বন্ধু গেল আগের সেই কক্ষে। ইকবাল গেছে স্পিডবোটে। চিরুও তার সঙ্গে ঘুমুবে নাকি। এদিকে বুড়ো নিশিকান্ত তার মাদুর পাতা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
‘বুড়ো বানিয়ে বলছে?’ মিলনের কথায় যুক্তির গন্ধ।
‘মনে হয় না। স্মৃতি উল্টেপাল্টা হওয়ার মতো শরীর নয় উনার। কুস্তিতে তুইও উনার সঙ্গে পারবি না।’
নিজের মাসলটা আরেকবার পরখ করে নিল মিলন।
‘হুমম। কালকেই ভূতের সঙ্গে মোকাবেলা হবে। এখন দরকার জম্পেশ ঘুম।’
‘তুই ঘুমা। আমি চা খেয়েছি। ঘুম আসবে বলে মনে হয় না।’
তুষার শুয়ে পড়ল। ঘুমুতে বেশিক্ষণ লাগলো না। দুঃস্বপ্নও দেখতে শুরু করে দিল এর মধ্যে। জঙ্গলে হাঁটছে একা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আশপাশে ফিসফাস শব্দ। কারা যেন কিছু বলতে চাইছে। একবর্ণ বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে কথাগুলো তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে। জঙ্গলের আরো গভীরে ঢুকল। একটা গাছ। অক্টোপাসের মতো শুঁড়। অনেকগুলো। ওটার পাশে একটা আলো। না একটা মানুষের মতো। চেহারাটা চেনা চেনা।
‘কে! কে ওখানে!’
‘আমি! আমি! ভয় পাস না খোকা!’
‘তুমি এখানে কী করছো আম্মা! তোমার না শরীর খারাপ!’
‘তুই পালা তুষার। পালা! জলদি পালা!’
ধড়ফড় করে উঠে বসল তুষার। সেলফোনে সময় দেখল। রাত দুটো। ধাতস্থ হতে সময় লাগবে। মায়ের চেহারাটা ভাসছে। মারা গেছেন বছর দুয়েক হলো। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও স্বপ্নে এসে সতর্ক করে দিয়ে গেলেন।
এতদিন দুশ্চিন্তা ছিল না তুষারের। মনে মনে অনেক থিয়োরি তৈরি করে রেখেছিল। এখন এই গভীর রাতে গহীন দ্বীপে আচমকা মনে হলো তার কোনো তত্ত¡ই খাটবে না। দ্বীপ ছেড়ে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
‘মিলন! মিলন!’ ফিসফিস করে ডাক দিল তুষার। অন্যদের ঘুম ভাঙাতে চায় না। সেলফোনের টর্চ জ্বালাতেই বুকে ছ্যাঁৎ করে উঠল। পাশে কেউ নেই। বের হয়ে গেছে মিলন!