রক্তের রোগ থ্যালাসেমিয়া হয় বংশগতভাবে। এতে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায় ও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ রোগ হলে রোগীরা রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায়ও ভোগেন। এতে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানিও ঘটতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক আছে প্রায় ২৫ কোটি। বাংলাদেশে প্রতি ১৪ জনে একজন বাহক। দেশে বছরে ৬ হাজার শিশু জন্মাচ্ছে বিভিন্ন রকমের থ্যালাসেমিয়া নিয়ে।
ত্রুটিপূর্ণ জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়, যা হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। এতে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ব লোহিত রক্তকণিকার ভাঙনের কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা যায়।
মা অথবা বাবা, অথবা মা-বাবা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে ২৫ শতাংশ আর ওই শিশুর বাহক হয়ে জন্মানোর আশঙ্কা থাকে ৫০ শতাংশ। চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারের কারও থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকার
থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের—আলফা ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। ১৬ নম্বর ক্রোমোজমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জিনের ত্রুটির কারণে আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং ১১ নম্বর ক্রোমোজমের ত্রুটিপূর্ণ জিনের ফলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়।
আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার ২ রকম—আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর ও মাইনর। প্রথমটি অনেক মারাত্মক। বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রেও মেজর ও মাইনর ধরন আছে। থ্যালাসেমিয়া বিভিন্ন হিমোগ্লোবিনোপ্যাথির সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে। আমাদের দেশে হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া আলফা থ্যালাসেমিয়া অপেক্ষা বেশি মারাত্মক।
থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ
বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পায়। অবসাদ, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি ইত্যাদি দেখা যায়। ধীরে ধীরে প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীরে অতিরিক্ত লোহা জমা হওয়া, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, জন্ডিস, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, মুখের হাড়ের বিকৃতি, শারীরিক বৃদ্ধির গতি কমে আসা, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদিও প্রকাশ পায়।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধের উপায়
সন্তানের থ্যালাসেমিয়া জেনে নেওয়া যায় গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসের মধ্যেই। বিয়ের আগেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া উচিত, যেন দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে না হয়। কারণ, দুজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি। সাধারণত বাহকের মধ্যে রোগের লক্ষণ থাকে না। তবে কোনো ক্ষেত্রে বাহক যখন গর্ভাবস্থায় থাকেন, তখন রক্তশূন্যতা দেখা দিলে তা আয়রন, ফলিক অ্যাসিড বা অন্য কোনো ওষুধ সেবনেও ভালো হয় না।
পরামর্শ
শরীরে লোহার ঘাটতি হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আয়রনসমৃদ্ধ কিছু খাবার হলো কলিজা, লাল মাংস, চিংড়ি, পালংশাক, আমন্ড, খেজুর, শতমূলী ইত্যাদি।
ভিটামিন সি-এর অভাবেও হিমোগ্লোবিন কমে যেতে পারে। ভিটামিন সি ছাড়া আয়রন পুরোপুরিভাবে শোষণও হয় না। পেঁপে, পেয়ারা, কমলা, লেবু, স্ট্রবেরি, গোলমরিচ, ব্রোকলি, আঙুর, টমেটোতে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে।
ফলিক অ্যাসিড এক প্রকার ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। লাল রক্তকণিকা তৈরিতে এটি প্রয়োজনীয় উপাদান। সবুজ পাতাযুক্ত সবজি, কলিজা, শিমের বিচি, বাদাম, কলা, ব্রোকলিতে প্রচুর ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়।
হিমোগ্লোবিন বাড়াতে বিটের রস খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। এতে রয়েছে প্রচুর আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ফাইবার ও পটাশিয়াম।
দিনে একটি করে আপেল খেয়ে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখা যায়। আয়রনের উৎস আপেলে আরও নানা পুষ্টি উপাদান রয়েছে। প্রতিদিন খোসাসহ একটি আপেল খান।
আয়রন, ক্যালসিয়াম, শর্করা ও আঁশসমৃদ্ধ ডালিম রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়।