class="post-template-default single single-post postid-23566 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

হরর গল্প : মৃত্যুছায়া

ধ্রুব নীলের হরর গল্প 

‘কেউ মারা যাবে কিনা সেটা আমি আগেভাগে বলে দিতে পারি। চেহারা দেখলেই বুঝতে পারি।’
‘আপনার নামটা কী যেন…।’
‘সিদ্দিকুর রহমান। আমার বয়স পঞ্চাশ। ডায়াবেটিস আছে।’
সিদ্দিকুর রহমানকে দেখেই বোঝা যায় তিনি অস্বস্তিতে আছেন। মাথা নিচু করে পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খোঁটার চেষ্টা করছেন। টাইলস শক্ত হওয়ায় পারছেন না। অস্বস্তিতে পড়ার কারণ হলো তিনি এর আগে কোনোদিন মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আসেননি। তার ধারণা, মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আসবে মাথা খারাপ হওয়া লোকজন। তার মতে, তার মাথা পুরোপুরি ঠিক আছে। তা না হলে টানা বিশ বছর ব্যাংকের চাকরি করতে পারতেন না।
ডা. কায়সার বয়সে তরুণ। চেম্বারে রোগী কম। সিদ্দিকুর রহমানের দিকে তাকিয়ে প্রথমে একটা কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। মুখে নকল হাসি টেনে বললেন, ‘আপনার ডায়াবেটিস আছে কিনা সেটা দিয়ে তো আমার কাজ নেই। আমার কাজ মনের কারবার নিয়ে। তবে ডায়াবেটিস খুব খারাপ জিনিস। শরীরের পার্টস ঠিক থাকে না। মন মেজাজও নষ্ট করে দেয়। বাই দ্য ওয়ে, আপনার সমস্যাটা বলুন। কেউ মারা যাবে সেটা আগেভাগে বলতে পারাটা তো সমস্যা না। অন্য কোনো সমস্যা আছে?’
সিদ্দিকুর রহমানের ভেতর ঝিলিক দিয়ে গেল চিন্তাটা। তাই তো! খামোকা ডাক্তারের কাছে এসেছেন। ভিজিটের পাঁচশ টাকাই লস।
‘তবে আমি ইন্টারেস্টেড। এমনিতে রোগী টোগি নাই, আপনাকে হাতছাড়া করাটা ঠিক হবে না। একটা কিছু টেস্ট ফেস্ট লিখে দিতেই হবে। কী বলেন? হা হা হা। চা খাবেন?’
‘জ্বি খাবো। চিনি কম দিলে চলবে। একেবারে চিনি ছাড়া আবার খাইতে পারি না। হা হা হা।’
সিদ্দিকুর রহমানের মনে হলো একটা বড় ভার নেমে গেছে মাথা থেকে। তার আসলে কোনো রোগ টোগ নেই। তিনি ঠিকই আছেন। কেউ মারা যাবে এটা হয়তো তার মতো আরো অনেকেই বুঝতে পারে। শুনেছেন আশপাশে কারো মৃত্যু আঁচ করতে পারলে রাস্তার কুকুরও নাকি কাঁদে। শুধু কুকুর না, কাকও নাকি অন্যরকম শব্দ করে ডাকতে থাকে। তিনি তো মানুষ। কুকুর কাকের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।
‘বলুন দেখি। এ পর্যন্ত কার কার মৃত্যু আগেভাগে টের পেয়েছেন। শৈশব থেকে শুরু করুন। আমার মনে হচ্ছে আপনি ছোটবেলায় আপনার ঘনিষ্ট কারো মৃত্যুর বিষয়ে আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।’
‘জ্বি ঠিক ধরছেন। আপনার অনেক বুদ্ধি। আমার বয়স তখন চাইর-পাঁচ। আমার নানার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার দূরে। নানা যেদিন মারা যান, সেদিন আমি সকালে টের পাই। জামা-কাপড় পরে মাকে বলছিলাম, আম্মা চলেন, আমাদের নানাবাড়ি যাইতে হইব। এরপর বহুত দিন আর এসব নিয়ে কথাবার্তা ছিল না। তারপর আচমকা একদিন আমার বড় বোনের স্বামীর চেহারায় আমি লাশ দেখি।’ কথাটা বলেই নকল কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কারের ভান করলেন সিদ্দিকুর। যেন মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে গেছে।
‘একটু বুঝিয়ে বলুন।’
‘ইয়ে মানে। আমার বড় বইনের স্বামী মানে আমার দুলাভাই সিরাজ মিয়া। তার চেহারায় একদিন আমি লাশের ছায়া দেখি।’
‘আচ্ছা।’
‘ধরেন, একটা চেহারা হলো নরমাল। আরেকটা হলো আন্ধার আন্ধার। একটু কেমন জানি। লোকটা হাসলেও আমার কাছে মনে হইতেসিল একটা লাশ হাসতেসে। আমার খুব ভয় লাগে ওইটা দেখলে। বুঝলেন ডাক্তার সাহেব।’
সিদ্দিকুর রহমানের মনে হলো তিনি ডাক্তার দেখাতে আসেননি। তিনি এসেছেন তার বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে।
‘ভয় লাগারই কথা। একটা লাশ হাসবে, এটা কল্পনা করা আসলেই ভয়াবহ।’
‘আপনি ডাক্তার, আপনি বিষয় ধরতে পারবেন। আমি পরিষ্কার দেখলাম। কিন্তু কাউকে কিছু আর বললাম। তখনো বুঝি নাই আমার ওই বিষয়টা। ভাবলাম এটা হয়তো এমনিই। কিন্তু তার এক সপ্তাহ পরেই দুলাভাই মারা গেলেন। সৌদি আরবে রোড এক্সিডেন্টে।’
‘তারপর?’
‘এরপর আরো অনেকের চেহারায় আমি লাশ মানে মরার বিষয়টা দেখতে পাই। অবশ্য ওরা সবাই মারা গেছে কিনা সেই খবর আর নেই নাই।’
‘গ্যাপটা কতদিনের? মানে চেহারায় লাশের ছাপ দেখার কতদিন পর মারা যায় লোকটা।’
‘তা ধরেন এক সপ্তাহ বা এক মাস লাগে। আমার বাবার বেলায় এক দেড় মাস লাগসে।’
আবার মাথা নিচু করে মুখ কালো করে ফেললেন সিদ্দিকুর। ডা. কায়সার বুঝতে পেরেছেন সিদ্দিক সাহেব এখন মনে মনে ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতাটা কল্পনায় দেখছেন। মানুষ তার ভয়ানক অভিজ্ঞতাগুলোকে বারবার কল্পনা করতে পছন্দ করে। এটা মস্তিষ্কের ডিফেন্স মেকানিজম। বার বার একটা কিছু কল্পনা করে সেটাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে অবচেতন মন।
‘তখন আমি ভার্সিটিতে। বাবার মুখে লাশের ছায়া দেখার পর আমার তিন দিন ধরে ঘুম টুম হয় না। এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ পর মনে হইলো সব নরমাল। আর এমন একটা ব্যাপার কাউরে বলাও যায় না। বললে আরো উল্টা টেনশন। কী দরকার..।’
‘তারপর?’
‘তারপর খবর আসে বাড়ি থেকে। স্ট্রোক করসিলেন আব্বা। এরপর আমার মাথা কিছুদিন আউলা ছিল। মানে…।’
‘মানে বুঝেছি। আউলা মানে আউলা। তারপর?’
‘এর অনেক দিন পর আমি আর কারো দিকে তাকাইতাম না। অনেকে মনে করতো আমি বুঝি ট্যারা। অন্যদিকে তাকাইয়া কথা বলি। কিন্তু এমন করে আর কয়দিন চলে বলেন।’
‘আপনি আমাকে এখনো সমস্যার কথা বলেননি।’
‘জ্বি বলবো। সমস্যা গুরুতর। আপনার কাছে কেন আসছি সেটা আমি জানি না।’
‘সমস্যা বলুন।’
‘কদিন আগে আমি আমার এক ঘনিষ্টজনের মুখে লাশের ছায়া দেখতে পাই।’
‘ঘনিষ্টজনটা কি আপনার স্ত্রী?’
‘জ্বি। ঠিক ধরেছেন।’
‘আপনার স্ত্রী কি অসুস্থ?’
‘হুম। তবে অসুখ গুরুতর না। আলসারের একটু সমস্যা আছে। আর অ্যাজমা আছে। বুকে মাঝেসাঝে ব্যাথা ট্যাথা করে। আমাদের বাচ্চাকাচ্চাও নাই। বাসায় মানুষ বলতে আমরা দুই জন।’
‘আপনাকে আমার কাছে আসার বুদ্ধিটা দিল কে?’
‘জ্বি কেউ দেয় নাই। আমার ধারণা আমার মাথা নষ্ট তাই উল্টাপাল্টা এসব ঘটতেসে। আর আমার এক ভায়রারে জিজ্ঞেস করতেই আপনার কথা কইল। আমার বাসা কাছেই।’
‘আমার কাছে তো আপনার মাথা নষ্ট মনে হচ্ছে না।’
‘অবশ্য এর জন্য শরিফেরও দোষ আছে।’
‘সে কে?’
‘আমার পুরানা বন্ধু। একসঙ্গে ভার্সিটিতে পড়সি। ও আমার বিষয়টা জানতো। শান্তি দিত না একটুও, বুঝলেন। আমারে নিয়া ঢাকা মেডিক্যাল, পিজি হাসপাতালও দৌড়াদৌড়ি করসে। ক্যান্সার ওয়ার্ডের সামনে গিয়া আমারে জিগাইত, এইখানে কে কে মারা যাইবো ক। আমিও বলতাম। ওর আবদারে না করতে পারতাম না। তারে নিয়া আবার আরেক কাহিনী।’
এটুকু বলে থামলেন সিদ্দিকুর রহমান। ফ্লাস্ক থেকে কাপে নিজেই চা ঢাললেন। গল্প ভালো করে সাজিয়ে বলতে পারেন না তিনি। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিলে সুবিধা হয়। তখন একটা বাক্যের সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক না থাকলেও চলে।
‘শরিফরে নিয়া আমার অনেক স্মৃতি। তখন বয়সও কম। আমি চেহারা দেখে বলে দিতাম কে তাড়াতাড়ি মারা যাবে। সেটা নিয়া আবার বাজি ধরাধরি চলতো। ঘটনা ভয়াবহ। ও মনে করতে লাগল আমারে দিয়াই সে কোটি কোটি টেকা কামাইতে পারবে।’
‘ও কোথায়?’
‘ও মরে গেছে বছর আটেক আগে। সেও এক ঘটনা।’
‘আমার হাতে অনেক সময়। বলতে থাকেন। এই নেন বিস্কিটের প্যাকেট। নোনতা বিস্কিট।’
বিস্কিট হাতে সিদ্দিকুর খুব সাবধানী। গল্পের চেয়ে বিস্কিট ভেজানোর পর সেটা সময়মতো মুখে দেওয়াতে তার মনযোগ বেশি।
‘শরিফকে নিয়া একদিন ঘুরতে ঘুরতে আচমকা তার মুখে দেখি লাশের ছায়া পড়ছে। আমি কী মনে করে তারে বলতে গিয়াও বললাম না। কিন্তু শরিফ খুব ধুরন্ধর। সে আমার মুখ দেইখাই বুঝে ফেলল ঘটনা ঘটসে।’
‘হুম। তারপর?’
‘তারপর বিশেষ কিছু না। আমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসি। শরিফরে কইলাম আমার কাছ থেকে দূরে থাক। ও ভয় পাইয়া যায়। তোতলাইতে থাকে। ওই দিন রাইতেই শুনি ও মারা গেছে।’
‘কিভাবে মারা গেল?’
‘হার্ট অ্যাটাক করসিল।’
‘আপনার কি কখনো মনে হয়নি যে ঘটনাগুলো কাকতালীয় হতে পারে? এমনও হতে পারে শরিফ মনে করলো সে মারা যাবে এই আতঙ্কেই তার হার্ট অ্যাটাক হলো।’
‘আমি সেটা জানি না। এখন আপনি দেখেন কিছু করা যায় কিনা। আমার মাথা থেকে জিনিসটা সরাইয়া দেন। আমি এখন বিশ্বাস করি জিনিসটা ভুয়া। লাশের ছায়া টায়া সব ফালতু কথা। কিন্তু মন মানে না। বাসায় বউয়ের চেহারার দিকে তাকাইলেই কলিজা ছ্যাঁৎ কইরা ওঠে। তাকাইতে পারি না।’
সিদ্দিকুর রহমানের চেহারার দিকে তাকিয়েছেন ডাক্তার কায়সার। তার চেহারা কোনো ছাপ টাপ নেই বললেই চলে। ডা. কায়সার ভেবেছিলেন নিজের স্ত্রীর প্রসঙ্গ আসলে হয়তো লোকটার গলা আর্দ্র হবে। কিন্তু বিশেষ কিছু ঘটল না।
ডা. কায়সার উঠে দাঁড়ালেন। একটু পর পর পায়চারি করাটা তার অভ্যাস। ছোট চেম্বারে সেই সুযোগ নেই। বাইরের করিডোরে হাঁটেন তিনি। তবে সিদ্দিকুরের কারণে এখন বের হতে পারছেন না। মনে মনে খানিকটা হতাশও। এমন রোগের চিকিৎসা তার জানা নেই। সাধারণ অবসেশনের ক্যাটাগরিতেও ফেলতে পারছেন না। লোকটা এমনিতে নির্বিকার ঘরানার। মানসিক জোর আছে। অটো সাজেশন কাজে লাগালে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। বড় কথাটা হলো সে নিজেও মানতে শুরু করেছে যে ব্যাপারটা অযৌক্তিক। নিজেই নিজের অর্ধেক চিকিৎসা করে ফেলেছে।
‘আপনি এক কাজ করুন। যখনই মনে হবে আপনি কারো মুখে মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে একটা ক্ষমতা এনে দেবেন।’
মনযোগ দিয়ে শুনছেন সিদ্দিকুর।
‘কী ক্ষমতা?’
‘আপনি ভাববেন আপনার লাশের ছায়া মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। মুখ থেকে ওই ছায়াটাকে মনে মনে আপনি সরিয়ে ফেলবেন।’
‘সরিয়ে কোথায় রাখবো?’
‘সরিয়ে আপনি সেটাকে একটা বোতলে ভরে ফেলবেন। কিংবা সেই ছায়াটাকে বাসার সামনের ডাস্টবিনে ফেলে আসবেন। দুর্গন্ধময় কোনো নর্দমায়ও ফেলে দিতে পারেন।’
সিদ্দিকুর নিচের দিকে তাকিয়ে ফ্লোর খুঁটতে খুঁটতে মাথা নাড়লেন।
‘আপনে আসলে বিশ্বাসই করেন নাই। তবে আপনার বুদ্ধিটা আমার মনে ধরসে।’
‘দেখুন, বিশ্বাস অবিশ্বাস বড়ই বিচিত্র জিনিস। জগতে এমন সব ঘটনা ঘটে, যেখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসেরও কোনো দাম নাই। আপনি কোয়ান্টাম ফিজিক্স পড়েন নাই। পড়লে বুঝতেন জগৎ কেমন আজগুবি হতে পারে।’
‘তা ঠিক তা ঠিক।’
‘আপনার কাছে আপনার স্ত্রী বড় নাকি লাশের ছায়া বড়?’
সিদ্দিকুর রহমান আহত দৃষ্টিতে একবার ডা. কায়সারের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিলেন নিজেকে। দুর্বলতা কিছুতেই দেখাতে চায় না তার মতো মানুষগুলো।
‘জ্বি সত্য। কিন্তু ছায়া সরামু কেমনে সেটাই ভাবতেসি। এর আগে বহুত চোখ ডলাডলি করসি। লাভ হয় নাই।’
‘এ কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। এর জন্য আমাকে হাউস ভিজিটে যেতে হবে। এক্সট্রা পাঁচশ টাকা ভিজিট। টোটাল এক হাজার।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘আপনি ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে রেখে যান। আমি রাতেই চলে আসবো।’
সিদ্দিকুরের চোখের দিকে তাকালেন কায়সার। লোকটার আকুলতা ধরা পড়েছে তার চোখে। দুর্বলতা ধরতে পেরে খুশি হলেন মনে মনে।
সিদ্দিকুর ঠিকানা লিখেই পকেটে হাত দিলেন।
‘ভিজিট একবারে দিলেই হবে।’
‘জ্বি আচ্ছা। আমি যাই তাহলে।’
হনহন করে বের হয়ে গেলেন সিদ্দিকুর রহমান।

বাসায় আসার পর থেকেই সিদ্দিকুর রহমানের মনে হলো ভুল হয়ে গেছে। একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসলেই হতো। ডাক্তার এসে পড়লে হাজারটা প্রশ্ন শুরু করবে রেনু। রেনুর প্রশ্নের বাতিক আছে।
‘ডাক্তার কেন আসবে? তোমার কী হয়েছে আবার? দেখি, জ্বর টর তো নাই।’
‘সামান্য জ্বরের জন্য ডাক্তার বাসায় আসবে কেন? ডাক্তার আসবে অন্য কারণে।’
‘আরে আমারও তো কিছু হয় নাই! শুধু শুধু আবার ডাক্তার কেন আসবে? কী আশ্চর্য কথাবার্তা তোমার। অন্য দিকে তাকিয়ে আছো কেন? আমার দিকে তাকাও!’
‘চুপ কইরা বসো। ডাক্তার আসতেসে, থানা থেকে পুলিশ আসতেছে না। শান্ত হইয়া বসো।’
‘কী বল তুমি! শান্ত হয়ে বসবো কেন? কী হলো তোমার! আমার কিন্তু প্রেসার বাড়ছে!’
সিদ্দিকুর রহমান উঠে গেলেন। গত দুদিন ধরে রেনুর দিকে তিনি সরাসরি তাকাচ্ছেন না। আজ অবশ্য চেম্বার থেকে ফেরার পর একবার হুট করে তাকিয়ে ফেলেছেন। তাকানোর পরই একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছেন। লাশের ছায়ার একটা মাপজোক আছে। তার মনে পড়ে গেল শরিফের চেহারায় খুব কড়া ছিল ছায়াটা। ছায়া দেখার দিনই সে মারা যায়। রেনুর মুখের ছায়া অত কড়া না। মাঝারি মানের। সম্ভবত আর সপ্তাহখানেক আছে হাতে। সিদ্দিকুর রহমান পান সিগারেট খান না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাই কোনো কাজ পেলেন না। কাজ ছাড়া বেশিক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাটা বিরক্তিকর। রেনু এর মধ্যে খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। ডাক্তারের জন্য রান্নাবান্না নিয়ে ভাববে। ভাবুক। সময় পার হোক। সিদ্দিকুর রহমানের হাঁসফাঁস লাগলে তিনি বসে বসে সেকেন্ড গুনতে থাকেন। তার মতে এই সেকেন্ড হলো সর্বরোগের ওষুধ। সেকেন্ড গুনতে গুনতে এক দিন মহাকাল পেরিয়ে যাবে। সব নিরব নিথর হয়ে যাবে। শান্ত মনেই আবার নিজের রুমে ফিরে এলেন সিদ্দিকুর।

ডাক্তার কায়সার এলেন দশটার দিকে। এসেই বলে দিলেন তিনি রাতের খাবার খেয়ে এসেছেন। সিদ্দিকুর রহমান একা একাই খেতে বসলেন। রেনু এখন খাবেন না। ডাক্তার বিদায় না নেওয়া পর্যন্ত তার টেনশন কমবে না।
‘জ্বি আপনিও খান।’
‘না না আমি খেতে আসিনি। আমি এসেছি আপনার স্বামীর ভ‚ত তাড়াতে। হা হা হা। আমি মানসিক রোগের ডাক্তার।’
রেনুও হো হো করে হেসে উঠল। সিদ্দিকুর রহমানের বিকার নেই। তিনি খাওয়া চালিয়ে যাচ্ছেন। স্ত্রীর হাসিটা তার কাছে নকল মনে হলো না।
সিদ্দিকুরের খাওয়া শেষ হতেই চা এলো। ডা. কায়সার এর মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা চালিয়ে গেছেন রেনুর সঙ্গে। ভাবী ভাবী বলে ডাকছেন। সিদ্দিকুরের মনে হলো নাহ, ডাক্তার আসলেই একটা কাজের জিনিস। লোকটা আসার পর থেকেই মনটা হালকা লাগছে খুব।
চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসেছেন সিদ্দিকুর ও ডা. কায়সার। রেনু থালাবাসন মাজামাজিতে ব্যস্ত। অন্যদিন হলে কাজটা সিদ্দিকুরই করতেন। গত কয়েকদিন ধরে তিনি ঘরের কোনো কাজই করছেন না। কিছু করতে গেলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
‘ভাবী, থালাবাসন পরে ধোয়া যাবে। আপনি এদিকে আসেন। চেয়ারটায় বসেন।’
সিদ্দিকুর রহমান একটা চেয়ারে বসা। তার পাশে ডা. কায়সার। সিদ্দিকুর রহমানের মুখোমুখি বোকার মতো বসে আছে রেনু। ডাক্তার বলেছে চুপচাপ বসে থাকতে। তাই থমথমে মুখে চোখ বন্ধ করে আছে। সিদ্দিকুর রহমানের অস্বস্তি বাড়ছে।
‘জ্বি আপনি তাকান।’
অনিচ্ছা সত্তে¡ও রেনুর মুখের দিকে তাকালেন সিদ্দিকুর।
‘এবার সেই ক্ষমতাটা নিয়ে আসুন। আর আমি যা যা বলবো সেটা সেটা কল্পনা করবেন।’
রেনু কী ভাবছে কে জানে। সিদ্দিকুর সেটা নিয়ে চিন্তিত না। এদিকে ডা. কায়সারের গলার স্বরও বদলে গেল। সিদ্দিকুরের মনে হলো তিনি এক গভীর পুকুরে ডুব দিয়েছেন। পুকুর থেকে তাকে ডাক্তার কায়সার ছাড়া আর কেউই তুলতে পারবে না।
‘রেনুর চেহারায় লাশের ছাপ। ছাপটা মুখোশের মতো লেপ্টে আছে তার মুখে। আপনার ক্ষমতাটা হলো দূর থেকে চাইলে আপনি লোকের মুখোশ খুলে দিতে পারেন। খুব সহজ কাজ। মুখোশের চারপাশে আপনার ক্ষমতার বলয় তৈরি হয়েছে। সেই বলয় দিয়ে মুখোশটাকে আঁকড়ে ধরেছেন আপনি। মুখোশ খসে পড়েছে। আলো-আঁধারিতে ঢাকা সেই লাশের ছায়া মুখোশটা চোখ বুঁজে আছে। মুখোশটা শূন্যে ভাসছে। সরে আসছে.. সরে আসছে.. মুখোশটা আরো সরে গেল। মুখোশটা রেনুর মুখ থেকে একেবারে সরে গেল। মুখোশটাকে আপনি শূন্যে ভাসিয়ে রেখেছেন। মুখোশটা এখন ফেলে দেবেন। মুখোশটা ছুড়ে ফেলুন। ছুড়ে ফেলুন!’
‘জ্বি মুখোশটা পড়তে চায় না। শূন্যে ঝুলতাসে।’
‘মুখোশটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলনু।’
‘হয় না।’
‘মুখোশটাকে সরিয়ে ফেলুন। দূরে কোথাও। কোনো একটা বাক্সের ভেতর।’
‘ছায়াটা কোনো বাক্সের সঙ্গে মিল খাইতেসে না। ওইটা আবার ফিরা যাইতে চায়।’
‘লাশের ছায়ার মুখোশ আপনার নজর থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না সিদ্দিকুর সাহেব। আপনার অনেক ক্ষমতা। আপনি ক্ষমতা কাজে লাগান। লাশের ছায়াটাকে ভেঙেচুরে ফেলুন।’
সিদ্দিকুর এদিক ওদিক মাথা নাড়ছেন। রেনুও চোখ মেলে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। সিদ্দিকুর ভ্রƒ কুঁচকে কী যেন ভাবলেন। এরপর তাকালেন ডা. কায়সারের দিকে। শূন্য দৃষ্টি। যেন বহুদূরে কোথাও তাকিয়ে আছেন।
‘সিদ্দিকুর সাহেব? সিদ্দিক ভাই?’
খানিক পর সম্বিৎ ফিরে পেলেন সিদ্দিকুর। উঠে এলেন গভীর পুকুর থেকে। বোকা বোকা চেহারায় তাকালেন স্ত্রীর দিকে। হাসলেন। আনন্দের ঝলমলে হাসি। রেনুর মুখ থেকে সরে গেছে লাশের ছায়া! চিৎকার করে উঠলেন সিদ্দিকুর, ‘কাজ হইসে! ডাক্তার সাহেব কাজ হইসে!’
‘ব্রাভো! ব্রাভো! উফফ, ইচ্ছে করছে নিজেকে একটা মেডেল দিয়ে দেই। কী বলেন!’
সিদ্দিকুর রহমান দ্রুত পকেট হাতড়ে বের করে আনলেন এক হাজার একটা নোট। স্ত্রীর দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়েই আছেন তিনি। টাকাটা বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তার কায়সারের দিকে। নোটটা পকেটে ঢুকিয়ে ডাক্তার কায়সারও দাঁড়ালেন না আর। বের হয়ে গেলেন দ্রুত।

ষোলো দিন পরের কথা। সিদ্দিকুর রহমান তিন দিনের ছুটি পেয়েছেন। তার গ্রামের বাড়ি বলতে কিছু নেই। ছুটি পেয়ে রেনুকে নিয়ে ঢাকাতেই বের হয়েছেন ঘুরতে। চিড়িয়াখানায় যাবেন। রেনু মহাখুশি। সাজগোজ করছে সময় নিয়ে।
‘তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে জীবনেও সাজতে দেখোনি?’
‘নাহ, এমনি।’
‘হুহ। এমনি! এমনি এমনি কেউ এমন করে তাকায়!’
‘তোমারে দেখলে কী সমস্যা। আমি তো রাস্তায় দাঁড়াইয়া অন্য কাউরে দেখতেসি না।’
‘কদিন আগে তো আমার দিকে তাকিয়ে কথাও বলতা না।’
‘ওই সময় তো তোমার মুখে…।’
‘হিহিহি… কী লাশের ছায়া দেখা যেত? তোমার মাথা নষ্ট। তোমার ওই ডাক্তার বন্ধুরও নষ্ট। ভালো কথা লোকটাকে তো আর আসতে দেখলাম না।’
‘ফোন দিসি কয়েকবার। ধরে নাই।’
বাসা থেকে বের হলেন দুজন। যাওয়ার পথে ডা. কায়সারের চেম্বারটা পড়ে। রিকশা দাঁড় করিয়ে উঁকি দিলেন সিদ্দিকুর। বন্ধ চেম্বার। সামনে সাইনবোর্ড ঝুলছে, ‘ভাড়া হবে’।
বিমর্ষতার একটা চাদর যেন আঁকড়ে ধরল সিদ্দিকুরকে।
‘শরীর ভাল লাগছে না রেনু। চলো বাসায় যাই।’
‘চলো চলো। এই গরমের মধ্যে বান্দর-হনুমান দেখে কাজ নাই। বাসায় বসে সিনেমা দেখি।’

সিদ্দিকুরের মাথার ভেতর চলতে শুরু করলো ষোলো দিন আগের রাতের ঘটনার দৃশ্যগুলো। রেনুর মুখ থেকে লাশের ছায়াটাকে সরিয়ে রাখার জায়গা পাচ্ছিলেন না। বার বার মনে হচ্ছিল মুখোশকে রাখতে তো একটা চেহারার দরকার। যেন তেন মুখোশ তো আর না, লাশের ছায়া বলে কথা। সিদ্দিকুর তাই আলগোছে ছায়া-মুখোশটাকে রেখে দিয়েছিলেন ডা. কায়সারের মুখের ওপর। পরে আর ডাক্তারের দিকে ফিরেও তাকাননি। কারোর মৃত্যুর দায়ভার নিতে মোটেও প্রস্তুত নন তিনি।

[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি  পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!