মেহের আফরোজ শাওন। অভিনেত্রী; নন্দিত লেখক-নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী। আজ হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তার চলে যাওয়ার এক দশকের নানা ঘটনা ও বতর্মান নিয়ে গতকাল কথা বলেছেন শাওন।
জন্মদিন উপলক্ষে কী আয়োজন থাকছে?
শাওন : রাত ১২টা ১ মিনিটে (১৩ নভেম্বর প্রথম প্রহর) বাসায় কেক কাটব। উনার (হুমায়ূন আহমেদ) কিছু কাছের মানুষ আছেন, প্রকাশক, ভক্ত—তারা প্রতিবারই আসেন। তারা আসবেন। এরপর রাতেই নুহাশ পল্লীতে চলে যাব। ১৩ নভেম্বর ভোরবেলা কবরে ফুল দেব। ওখানকার যারা কর্মচারী আছেন, তারা সবাই মিলে কেক কাটেন, দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়। এমনিতেও নুহাশ পল্লীতে প্রচুর মানুষ আসেন কবরে ফুল দিতে। এভাবেই দিনটি কাটবে। এর বাইরে আর তেমন কিছু নেই। এটা আমাদের প্রতিবছর যা হয়, সেটাই।
১৩ নভেম্বর ঢাকায় ‘হুমায়ূন মেলা’সহ কিছু আয়োজন হবে। সেগুলোতে আপনি থাকবেন?
শাওন : না, এগুলোতে আমি যুক্ত নই।
হুমায়ূন আহমেদ নিজে দুটি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি করে গেছেন। যেগুলো আপনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সেগুলোর খবর কী?
শাওন : ২০০৮ সালে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই ‘গৌরীপুর জংশন’ চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন। ‘নির্বাসন’ নামের আরও একটি করেছিলেন। এ ছাড়া আমি ‘নক্ষত্রের রাত’ নামে একটি চিত্রনাট্য করেছি। সবই আছে। কিন্তু আমি জানি না, কী করব। ২০১৮ সালের পর ব্রেক নিয়েছি। এটা যে সচেতনভাবে নিয়েছি, তা বলতে পারব না। ২০১৯-এ যখন নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে পরিচালনা বিষয়ে পড়লাম, তখন মনে হলো, এটা আমাকে এগিয়ে দেওয়ার কথা হলেও, তা আরও পিছিয়ে দিয়েছে। কারণ আগে না জেনে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অনেক কিছু করেছি। এখন আত্মবিশ্বাস আছে। কিন্তু এখন সচেতনভাবে কাজ করার বিষয়টি সামনে এসেছে। এ কারণে মনে হয়, কাজ শুরু করতে পারিনি।
নিষাদ-নিনিত বা সংসারের ব্যস্ততাও কি এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে?
শাওন : একজনের বয়স ১৬ ও অন্যজনের ১২। এ সময়টা তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বয়ঃসন্ধিকালের কিছু বিষয় তো। মানসিকভাবে তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। করোনার মধ্যে যদি বড় ক্ষতি হয়ে থাকে তবে সেটা হয়েছে বাচ্চাগুলোর। আমার দুটো ছেলেই মানসিকভাবে খুব ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে গেছে। স্কুল বন্ধ, অনলাইন ক্লাস, আবার নতুন সিলেবাস, পড়াশোনার চাপ—সব মিলিয়েই এটা হয়েছে।
বাবা-মা দুজনে যে কাজগুলো করে, গত ১০ বছর ধরে আমি একাই সেটা করে আসছি। নিজেকে একটু ক্লান্তও লাগে। কিন্তু এটাও ঠিক, আমি যদি সত্যিকারের কোনো স্বপ্ন দেখে থাকি, সেটা হলো নির্মাণের স্বপ্ন। সুতরাং আমি করতে পারব কিনা জানি না, তবে আর একটা হলেও ছবি বানাব।
হুমায়ূন আহমেদের কথা হয়তো প্রায় মনে পড়ে। তখন কোন কাজটি করতে ইচ্ছে করে। উনি তো আপনার গান বেশ পছন্দ করতেন…
শাওন : হ্যাঁ, উনাকে প্রায়ই মনে পড়ে। এটার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কখনো নিঃস্তব্ধ হয়ে বসে থাকি, কখনো গান গাই। আবার কখনো গলা ছেড়ে প্রচণ্ড কাঁদি। তিনি গানের পাশাপাশি আমার অনেক কিছুই পছন্দ করতেন। আমার রান্না, আমার কথা বলা, তার রচনা আমি পাঠ করলে সেটা পছন্দ করতেন। নতুন কোনো লেখা বন্ধুদের শোনাতে হলে তিনি আমাকে দায়িত্ব দিয়ে দিতেন।
কখনো অভিমান হয় না?
শাওন : প্রচণ্ড অভিমান হয়। বাচ্চা দুটো নানাভাবে আমাকে জ্বালাচ্ছে-পোড়াচ্ছে। বাবা থাকলে এগুলো শেয়ার করা যেত। একজন বকা দিলে, আরেকজন আদর করার সুযোগ পায়। আমাকে দুটো দিকই সামলাতে হচ্ছে। একটা অভিমান আমার মধ্যে খুব ভর করে যে, আমাকে এই পৃথিবীর জঞ্জালের মধ্যে কেন ফেলে রেখে গেল হুমায়ূন আহমেদ? রাগও করি। আবার ভাবি, তার জন্য যা দরকার ছিল তিনি তা করে গেছেন। দরকার ছিল। পৃথিবীর জঞ্জাল, বাচ্চাদের বয়ঃসন্ধি এগুলো তো তার জন্য নয়। তিনি তো সৃষ্টিই করে যাবেন।
এ অভিমান বুকে চাপলে তখন হুমায়ূন আহমেদকে কী বলতে ইচ্ছে হয়?
শাওন : বলতে ইচ্ছে হয়—তুমি একটা স্বার্থপর। আমার ঘাড়ে সব দায়িত্ব দিয়ে তুমি মজা নিচ্ছ।
শুধু কি বাচ্চাদের কারণেই এতটা অভিমান?
শাওন : না, তা নয়। আজকে যখন হুমায়ূন আহমেদের সিনেমাগুলো আটকে পড়ে থাকে কোনো এক চ্যানেলের কাছে, আজকে যখন তার চরিত্রগুলো নিয়ে তার কাছের মানুষগুলো বাণিজ্য করে, হুমায়ূন আহমেদের আঁকা ছবিগুলো চুরি করে যখন আটকে রাখে, তখন অভিমান হয়। মনে হয়, এগুলো সর্ট আউট করে তিনি রেখে যেতে পারতেন। হুমায়ূন আহমেদ কড়া যদি নিয়ম করে যেতেন, তবে ভালো হতো।
মানে লড়াইটা আপনার একটা করতে হচ্ছে এখন—এটাও অন্যতম ক্ষোভ আপনার…
শাওন : না, এখন আমার সঙ্গী আছে। এটা আলাদা করে আমি বলতে চাই, লড়াইয়ে বহু বছর আমি একা ছিলাম, এখন আর নই। এখন হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ক লড়াইয়ে আমার সঙ্গে আছেন নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ, নুহাশ হুমায়ূন ও বিপাশা আহমেদ।
কিন্তু আমরা তো দেখি তারা আপনার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন…
শাওন : একটা সময় আপনারা দেখতেন তারা বিপরীতে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, গত দুই বছরে বিপরীত আপনারা কিছুই দেখেননি। তাদের নিশ্চুপ থাকতে দেখেছেন। একটা ইস্যুতে আমি গ্রামীণফোনকে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছিলাম যেখানে তাদের সবার স্বাক্ষর ছিল। আমরা আর কেউ একা লড়াই করি না। সিদ্ধান্ত নিতে হলেও একসঙ্গে নিই। এটা অবশ্যই অনেক বড় প্রাপ্তি।
অবশ্যই সেটা প্রাপ্তি বলা যায়। তাহলে কি এখন তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নুহাশ পল্লীতে যায়?
শাওন : তারা তো সবসময়ই সেখানে যাতায়াত করে। ফিজিক্যালি ফুল দেওয়াটা ওরা হয়তো বিশ্বাস করে না। আমি কিন্তু সেটা করি। যতদিন আমি বেঁচে থাকব সেটা করব। যদি আমি অসুস্থ বা দেশের বাইরে না থাকি। তবে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি কোনো আঘাত এলে বা সৃষ্টির প্রতি আঘাত এলে ওরা থাকে—এটা আমি নিশ্চিত করছি।