বসন্তকে আসার জন্য বৈশাখের মতো এসো এসো বলে ডাকতে হয় না। বসন্ত আসা-যাওয়া করে তার মর্জিমতো। কারও জীবনে একটু তাড়াতাড়ি আসে, কারও বা আসেই না। বসন্তের সুলুকসন্ধানে নেমেছেন নন্দিতা সাবরিনা
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক…। ফুল না ফুটলে বসন্তকে মেনে নেবে তো আজকের ভাইরাল সমাজ? একটা ফুলও ফোটেনি, এ আবার কীসের বসন্ত! ‘ভুয়া’ দুয়োধ্বনি দিয়ে বসন্তকে এলাকাছাড়া করা হোক! ওইরকম দুচারটা গোলাপ-গাঁদা সারাবছরই ফোটে। পলাশ, শিমুল ফোটেনি? ভালো কথা, কোনটা পলাশ কোনটা শিমুল? আচ্ছা, এবারের বসন্ত কত তারিখে পড়েছে যেন? ওহ, গত চার বছর ধরেই তো পহেলা ফাল্গুন মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি। আহা! ১৪ তারিখ! ভালোবাসার দিবস। ভালোবাসার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধারেরও দিবস। যতই হলুদ, কমলা মেখে সেজেগুজে বের হোন, ভ্যালেনটাইনীয় প্রশ্নের তীর ছুটে আসবেই। সুতরাং, মুখে যতই বলুন বসন্ত এসে গেছে, পঞ্জিকা সংস্কারের খপ্পরে পড়ে বসন্ত আসলে ফেঁসে গেছে।
ফুল না ফুটলেও ধরে নিলাম পেছনের দরজা দিয়ে বসন্ত আসতে পারে। তবে ভালোবাসা দিবসের সেই সুযোগ নেই। গাছের ডালে ফুল না থাকুক, গদখালি থেকে ট্রাকে চড়ে হাইব্রিড গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, কসমস এলেই হলো। সেসব গত কয়েক দিনে ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের বাজারে বাজারে। অনলাইনেও জমেছিল এবার ফুলের বিকিকিনি। কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি সেন্টারগুলোও ম ম করেছে চিড়েচ্যাপ্টা গাঁদা, গন্ধরাজে। আর আজতো মফস্বলের সংবাদদাতারা ক্যালকুলেটর নিয়ে বসবেন গদখালি, যশোর, ঝিকরগাছায় এবার কত কোটির ফুল বিকলো। যত কোটির বেচাকেনা, ততই যেন পড়তা যাবে সেই বছরের ভালোবাসায়!
এবার অবশ্য শেষ মুহূর্তে ফুলচাষীদের মুখে বিষাদের ছায়া। পাইকারি বাজারে পিসপ্রতি গোলাপের দাম শুরুতে ২৫-৩০ টাকা থাকলেও সেটা আচমকা নেমে গেছে ১০-১৫ টাকায়। ইচ্ছেমতো দামদর হাঁকাতে না পেরে তাদের কেউ কেউ অভিশাপ দিচ্ছেন এই বলে যে, আমদানি করা ফুলে কিন্তু ভালোবাসা হবে না বলে দিলাম!
তাই বলে অভিজাত শহরের সদ্য টিউশনিতে ঢোকা তরুণ-তরুণীরা যে চাইলেই আজ এক গোছা গ্লাডিওলাস বাগাতে পারবেন, ব্যাপারটা তেমনও নয়। বাজারের চোখে আলু যেমন, গোলাপও তেমন। মধ্যস্বত্ত্বভোগের জ্যামিতিক সূত্রানুযায়ী আজ শহরের প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা বসন্তপ্রেমীদের হাত পর্যন্ত যেতে ফুলের দাম ছাড়াবে তিন অঙ্ক। এক কেজি পেঁয়াজের দামে দু’খানা গোলাপ বাগাতে পারলেই উচাটন মনে লেগে যাবে দখিনা হাওয়া। অথচ ‘ও পলাশ ও শিমুল’রা গড়াগড়ি খাবে রাস্তায়। তবু একটা দিক দিয়ে বাঁচা গেল বলতেই পারেন। ২০২০ সালের আগের বছরগুলোর মতো পরপর দুটো দিন আর ফুল-চকোলেট, বসনে বা রিকশার আসনে খরচ করতে হচ্ছে না। এক তারিখেই দুই পাখি কাত।
বাংলা তারিখ নিয়ে এ ‘ঝামেলা’ পাকাপোক্তভাবে মেটেনি যদিও। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বৈশাখটা এখনও একদিন হোঁচট খাচ্ছে। পর পর দুদিন দুটো বসন্ত ও দুটো পহেলা বৈশাখ পালনের ব্যাপারটা ‘কেমন যেন’। বঙ্গের সংস্কৃতি বাবদ যে অবাঙালিদের আগ্রহ ছিল তাদের কাছে মনে হবে, এ কোন বিভাজনরে বাবা!
অবশ্য যারা বলছেন, পঞ্জিকা সংস্কারের নামে বসন্তের একটা দিন কমিয়ে দেওয়া হলো, তাদের জন্য সুখবর—এ বছর অধিবর্ষ হওয়ায় ফাগুনের মেয়াদও এক দিন বাড়বে। এই ফাঁকে ভাইরাল ভিডিও নির্মাতাদের জন্য একখানা ফ্রি আইডিয়া দেওয়া যাক। ইন্টারনেট থেকে তথ্য টুকে নিয়ে বসন্ত উদযাপনে আসা কোনো নিষ্পাপ মুখের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারেন—এই যে হলুদ জামা আর ফুলের ব্যান্ডেনা পরে খুব যে বসন্ত উদযাপন করছেন; তো বলুন দেখি, এ বছর ফাল্গুন মাসে কত দিন? আগামী বছর কত দিন হবে?
এ প্রশ্নের মোক্ষম উত্তর কী হতে পারে, বইমেলায় দ্বিপক্ষীয় আসরে তা নিয়ে কথা হচ্ছিল তরুণ লেখক ও গণযোগাযোগের শিক্ষার্থী জুবায়ের ইবনে কামালের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বসন্ত, বৈশাখ এসব কোনো তারিখ নয়। এগুলোকে বলে প্রাণের উৎসব। প্রাণের উৎসব মনে রাখতে হয় ইংরেজি তারিখ দিয়ে। কারণ তিন-চার দিন পরই আমরা বাংলা তারিখ ভুলে যাব। তার মানে এই নয় যে বসন্তকে অবহেলা করা হচ্ছে। যেদিনই গাছে শিমুল-পলাশ দেখবো, মনের ভেতর ফুঁ দিয়ে যাবে দখিনা হাওয়া।’
সুতরাং বাইরের তাপমাত্রা যতই হোক, ‘ফিলিং লাইক’ বলে একটা ব্যাপার সত্যিই আছে! যখন মনের ভেতর বসন্ত, তখনই বসন্ত। সেই সূত্রে ফুল না ফুটলেও…।
পরিশেষে, প্রকৃতি কিন্তু পঞ্জিকার ধার ধারে না। সুতরাং পঞ্জিকার খাঁটি প্রবর্তক কে, তা নিয়ে যে আকবর-শশাঙ্ক তর্ক চলমান আছে সেটাকে উৎসবের চাদরে মুড়িয়ে একপাশে রেখে দেওয়া যাক। বসন্তে যদি আমাদের গুটিয়ে থাকা হৃদয় না-ই খুলিলো, তবে এর সঙ্গে গুটিবসন্তের পার্থক্য রইল কোথায়? আর ভালোবাসা দিবস? উজবেকিস্তান, পাকিস্তানের মতো প্রজ্ঞাপন জারি করে কি আর প্রেমকে আটকানো যায়? জীবননান্দ দাশ তো বলেই গেছেন—প্রেমের পায়ের শব্দ আকাশে বেঁচে আছে! সুতরাং এই বসন্তে হৃদয়কেও প্রস্ফূটিত করুন। তখন আর লিপ ইয়ার লাগবে না, এমনিতেই বেড়ে যাবে বসন্তের মেয়াদ।