আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট ১৯১৪ সালে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা মেন্ডিং ওয়াল। যেখানে তিনি বলেছিলেন— ‘ভালো দেয়াল ভালো প্রতিবেশী তৈরি করে’। এটি মূলত নিউ ইংল্যান্ডের স্বাধীনচেতা মানসিকতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে ১৬২০ সালে প্রথম ব্রিটিশ অভিবাসীরা এসেছিলেন।

তাদের বিশ্বাস ছিল, কঠোর পরিশ্রমের পর সন্ধ্যাবেলা যখন কেউ নিজের বারান্দায় বসে বিশ্রাম নেবে, তখন পাশের প্রতিবেশীর অনাহূত কথোপকথনে ব্যাঘাত ঘটবে না—ওই নিশ্চয়তাই দেয় দেয়াল। পাশাপাশি, গবাদি পশুরাও থাকবে যার যার মালিকের জমিতে।
১৯১৪ সালের এই কবিতার প্রকাশকালও ইঙ্গিতবহ। ওই সময় বিশ্বযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। আমেরিকা তখনো নিজেদের গণ্ডির মধ্যে থাকতেই স্বস্তি বোধ করত।
কিন্তু চীনা সংস্কৃতি বরাবরই আলাদা। চীনের কবিতা ও জীবনদর্শনে প্রতিবেশী, বন্ধুত্ব ও সামাজিক বন্ধনকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালে চীনের শহুরে জনসংখ্যা প্রথমবার গ্রামীণ জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। তখন অনেকেই আফসোস করে বলেছিলেন— ‘মানুষের সঙ্গে মানুষের সরাসরি মেলামেশা কমে যাচ্ছে, সামাজিক সৌজন্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে।’
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল ২০০৫—যখন স্মার্টফোন রাতারাতি সবার হাতে পৌঁছে যায়। তখন মানুষ বলত ‘কফিশপে দেখা হবে’, আর এখন বলে ‘অনলাইনে দেখা হবে।’
আজকের দিনে রাস্তায় অপরিচিত কারও চোখে চোখ পড়লে অনেকেই অস্বস্তি বোধ করে। মেট্রোরেলে বসে থাকা পাশের যাত্রীকে এড়িয়ে চলাটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যেন চোখে চোখ পড়লেই মনে হয়, ‘তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? তোমার কি নিজের স্ক্রিন নেই?’
এভাবেই আমাদের স্মার্টফোন হয়ে উঠেছে রবার্ট ফ্রস্টের সেই ‘দেয়াল’, যা আমাদের নিজের মতো করে থাকার একটি অলীক আরাম দেয়।
এমনটা সবসময় ছিল না। চীনের প্রাচীন কবিরা বরং প্রতিবেশী ও অপরিচিত মানুষের সৌজন্যবোধকে এক অনন্য সম্পদ হিসেবে দেখতেন।
একটি চীনা প্রবাদে বলা হয়েছে— ‘বাড়ির জন্য দশ লাখ, ভালো প্রতিবেশির জন্য এক কোটি’। অর্থাৎ, নিজের বাড়ির চেয়ে ভালো প্রতিবেশীর মূল্য অনেক বেশি—অন্তত স্মার্টফোন আসার আগ পর্যন্ত!
চীনা কবি তু ফু ৭৫৭ সালে তার কবিতা ছিয়াং ভিলেজে লিখেছিলেন, যখন তিনি ছাং’আন নগরীর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নিজের গ্রামে ফিরছিলেন। পরিবার, বন্ধু আর প্রতিবেশীদের ভালোবাসাই ছিল তার পথ চলার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তার কবিতাটির বাংলা অনুবাদ দাঁড়াবে অনেকটা এমন—
লাল পশ্চিমা মেঘ—খাড়া সুবিশাল।
নিচে অস্তগামী সূর্য, মাঠে পায়ের ছাপ।
টালির দরজা, কাঠের ফটক,
চড়ুইদের কিচিরমিচির—
শত মাইল পেরিয়ে ফিরে আসা এক পথিকের জন্য।
বিস্মিত স্ত্রী ও সন্তান—
আমাকে দেখে মোছে চোখের জল।
বিশৃঙ্খল সময়, বিপদের দিন,
তবু ফেরা মানেই শান্তি, এক অদ্ভুত প্রাপ্তি।
প্রতিবেশীরা দেয়ালের ওপার থেকে উঁকি দেয়,
তাদের চোখে কৃতজ্ঞতা, আনন্দ অশ্রু।
রাত গভীর হলে, মোমবাতির মৃদু আলোয়
আমি আর আমার স্ত্রী—
পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে
ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি, স্বপ্নে হারাই।
এখন প্রশ্ন হলো, সেই দিনগুলো চিরতরে হারিয়ে গেছে? নাকি একদিন আমরা আবার দেয়ালের চেয়ে মানুষের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করবো?
[চায়না ডেইলিতে প্রকাশিত থমাস পাসেকের নিবন্ধ অবলম্বনে]