বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই যদি শিল্পকারখানায় সরাসরি গিয়ে ক্লাস করা যায় তবে চাকরিতে নতুন করে শিখতে হবে কমই। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীরা প্রতি সেমিস্টারেই কোনো না কোনো বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখে আসেন এ খাতের যাবতীয় প্রক্রিয়া। লিখেছেন মাহবুব আলম রিয়াজ। সূত্র: দৈনিক কালবেলা
বস্ত্র ও টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে এখন শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় আছে বাংলাদেশ। জাতীয় আয়ের অনেক বড় একটা অংশ নির্ভর করছে এ শিল্পের ওপর। মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগেরও বেশি আসে দেশে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। আর ওই শিল্প-কারখানাগুলোতে বস্ত্র প্রকৌশলীরা উদ্ভাবন বা উৎপাদন বাড়াতে অনন্য অবদান রাখছেন। চাকরিতে প্রবেশের আগে স্নাতক পর্যায়ে প্রশিক্ষিত করতেই যদি শিক্ষার্থীদের প্রতি সেমিস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে ভিজিটে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে তারা শুরুতেই এ শিল্পের খুঁটিনাটি সম্পর্কে ধারণা পাবে। যা মনে থাকবে বহুদিন।
স্পিনিং মিল দিয়ে শুরু
বস্ত্র প্রকৌশলবিদ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রারম্ভিক জ্ঞান অর্জন হয় ন্যাচারাল টেক্সটাইল ফাইবার সম্পর্কে। এর পর শেখানো হয় ফাইবার থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সুতা তৈরি নিয়ে। তুলা হতে সুতা বানানো হয় স্পিনিং মিলে। স্পিনিং মিলের কাঁচামাল তুলা আমদানি করা হয় অন্যান্য দেশ থেকে। কাপড় তৈরি করতে যে পরিমাণ তুলা প্রয়োজন হয় তা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে কিনে আনতে হয়। টেক্সটাইল ফাইবার হতে হলে আঁশের ন্যূনতম দৈর্ঘ্য, শক্তি, সূক্ষ্মতা, নমনীয়তা, আর্দ্রতার ধারণক্ষমতা ইত্যাদি গুণ থাকতে হবে। এসব সূক্ষ্ম বিষয় বজায় রাখতেই প্রকৌশলীদের বিশেষ সক্ষমতার প্রয়োজন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে নিজ চোখে তা দেখে অনেক কিছু শেখা যায়।
বুটেক্সের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী আইয়ুব আনসারী কাউছার বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশের পোশাক কারখানাগুলোর যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে জানা গেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ছে। নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কীভাবে বেশি অর্ডার নিয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে, সেই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এ ধরনের ট্যুরে।’
দক্ষদের কাছ থেকে শেখা
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরের মাধ্যমে লিডার, নীতিনির্ধারক, প্রকৌশলী বা অন্যান্য পেশাজীবীর কাছ থেকে বাস্তব জ্ঞান পাওয়া যায়। কারখানায় কীভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তা সরাসরি শেখা যায়। ইন্ডাস্ট্রিতে পোশাক তৈরির শুরুটা হয় স্পিনিং প্রসেস ও শেষ হয় ফিনিশিংয়ে। মধ্যবর্তী উইভিং, নিটিং, ডাইং, প্রিন্টিং, সুইং, ইন্সপেকশন এসব থাকে। প্রতিটি সেকশনে কর্মচারী বা সেকশন ম্যানেজার দায়িত্বে থাকেন। প্রতিটি প্রক্রিয়ার শুরু, নজরদারি, কোয়ালিটি ঠিক রাখা ইত্যাদিও শেখা যায় সরেজমিনে। আধুনিক সব মেশিনের কোনটির সাহায্যে কী করা হয়, কীভাবে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে, কীভাবে সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ে কাজ হচ্ছে সেটাও শেখা যায়।
বুটেক্সের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী অর্জন রায় বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় প্রায়োগিক শিক্ষার মাঝে বেশ দূরত্ব রয়েছে। সেই দূরত্ব ঘোচাতে ইন্ডাস্ট্রি ভিজিটের বিকল্প নেই। তা ছাড়া মার্কেট ও তার সঙ্গে যে মেশিনারিজ প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হচ্ছে তা ইন্ডাস্ট্রিতে না গেলে বোঝা যায় না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেশিন আনতে যে সময় যায়, ততদিনে ইন্ডাস্ট্রির মেশিনগুলো পুরোনো হয়ে যায়।’
ম্যানেজমেন্ট ও লিডারশিপ
পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, কোয়ালিটি বজায় রাখা ও তদারকি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন ম্যানেজাররা। কীভাবে সময় বাঁচিয়ে কর্মচারী, প্রকৌশলী, ম্যানেজারের কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন করে ইন্ডাস্ট্রির লক্ষ্য অর্জন করা যায় তা নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তারা নির্ধারণ করেন। অধীনদের কাজে যাতে একঘেয়েমি না আসে, সেই ব্যাপারে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগও কাজ করে।
চাকরির জন্য প্রস্তুতি
শিক্ষার্থীরা মিল বা ইন্ডাস্ট্রি ভিজিট করে এক্সিকিউটিভ, ম্যানেজার বা ডিরেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিং বাড়াতে পারে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থাও করা যায় এ ধরনের ভিজিটে। দেশের ইন্ডাস্ট্রিতে যে গুরুত্বপূর্ণ পদে বিদেশিরা আছে, সেসব পদের জন্য মূলত কী যোগ্যতা থাকা চাই, সে সম্পর্কেও জানার সুযোগ থাকে ইন্ডাস্ট্রি ভিজিটের ফলে। আবার অনেক সময় নতুন প্রযুক্তি বা বিশ্বে এখন কোন ট্রেন্ড চলছে সেটাও জানা যায়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপারেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এ ধরনের কারখানার প্রধান উপকরণ কিন্তু পানি। এ কাজে পানির ব্যবহার কীভাবে কমানো যায় তা নিয়ে সারা বিশ্বেই চলছে তুমুল গবেষণা। পানি দূষণের কথা বিবেচনা করলেও দেখা যাবে সবচেয়ে বেশি দূষিত পানি তৈরি হয় পোশাক কারখানাগুলোতে। কীভাবে জিরো লিকুইড ডিসচার্জ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কারখানায় ব্যবহৃত পানি রিসাইক্লিং করা যায়, তা জানতে ইন্ডাস্ট্রিগুলো পদক্ষেপ নিচ্ছে।’