আসাদুজ্জামান খান মুকুল
বিশ্ব অর্থনীতি এখন অদ্ভুত এক টানাপোড়েনে আছে। কোথাও যুদ্ধ, কোথাও নিষেধাজ্ঞা, আবার কোথাও মূল্যস্ফীতির দাপট। জ্বালানির দাম বাড়ছে,বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সুদের হার লাফিয়ে উঠছে, ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এসে এই ঢেউ আছড়ে পড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে জ্বালানি বাজারে তীব্র অস্থিরতা। তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। পণ্য উৎপাদন ও আমদানির খরচ বাড়ায়, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যের অনিশ্চয়তা আমাদের রপ্তানিতেও প্রভাব ফেলছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, সব মিলিয়ে অর্থনীতি যেন হাঁপাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও কম নয়। হঠাৎ বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা- এসবই কৃষি উৎপাদনে ক্ষতি করছে অপুরণীয়। কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত, বাজারে পণ্যের সরবরাহ কমছে, আর সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
বিশ্বে এখন সম্পদের বৈষম্যও রয়েছে ভয়াবহ পর্যায়ে। আমরা বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখতে পাই- বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় অর্ধেকই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বের এক শতাংশ বা তার কিছু কম ধনী মানুষ। আবার কোনো কোনো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র কয়েক ডজন বিলিয়নিয়ারের হাতে রয়েছে বিশ্বের দরিদ্র অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ।
বাংলাদেশেও চিত্রটা খুব ভিন্ন নয়। ২০২৪ খ্রিঃ সালে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, দেশের ১০ শতাংশ মানুষ এখন ৮৫ শতাংশ সম্পদের মালিক। তিনি বলেন, উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরূপ হয়েছে, কিছু কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ সরকারের প্রাপ্যকর রাজস্বখাতে পরিশোধ করছেনা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর করফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। আর আমলা, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। কথাগুলো শ্রুতিকটু হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জ্বালানি ঘাটতি, কর-জিডিপি অনুপাতের দুর্বলতা- সব মিলিয়ে অর্থনীতির চাকা ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তবু মানুষ কাজ করে যাচ্ছে। যার যার অবস্থানে থেকে কঠোর শ্রমের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা কিছুটা সচল রেখেছে। এই মানুষগুলোই আসলে দেশের প্রাণ।
উত্তরণের উপায়ঃ
১) আর্থিক স্বচ্ছতা ও সংস্কার দরকার। ঋণ ও বাজেট ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতি কমাতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে।
২) সম্পদ পুনর্বণ্টন জরুরি। ধনী-গরিবের ব্যবধান কমাতে কার্যকর করনীতি প্রণয়ন করতে হবে। অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ জমে না থেকে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
৩) সবুজ অর্থনীতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেকসই কৃষি, পরিবেশবান্ধব শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
৪) প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ জরুরি। দক্ষ জনশক্তি তৈরি না হলে কর্মসংস্থান বাড়বে না, অর্থনীতি টেকসই হবে না। এজন্য অদক্ষ মানুষের জন্য বিভিন্ন সেক্টেরর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে কর্ম উদ্যোগী করতে হবে।
৫)আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। ডলার নির্ভরতা কমাতে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে নতুন বাণিজ্যপথ ও মুদ্রা সহযোগিতা গড়ে তোলা যেতে পারে।
৬) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। অর্থনীতি কখনোই রাজনীতির বাইরে নয়, স্থিতিশীল পরিবেশ ছাড়া উন্নয়ন টেকে না।দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ ছাড়া কোনো বৈদেশিক বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করতে আসবেনা।
অতএবঃ বিশ্বের এই অস্থিরতার সময়টায় বাংলাদেশও কঠিন পরীক্ষার মুখে। তবে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম, সাহস আর বিশ্বাসই আমাদের ভরসা। কৃষক জমিতে যায়, শ্রমিক কারখানায় ঘাম ঝরায়, ব্যবসায়ী চেষ্টা চালিয়ে যায়- এই মানসিকতাই আমাদের মূল শক্তি।
অর্থনীতির কাঠামোতে সৎ পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে, এই সংকট একদিন কাটবেই। মানুষের মাঝে সঞ্চার হবে আশার আলো।
লেখক
শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক
গ্রাম- সাভার
পোস্ট – হেমগঞ্জ বাজার
উপজেলা – নান্দাইল
জেলা – ময়মনসিংহ




















