Saturday, December 14
Shadow

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন গল্প | একটি লম্বা সকাল

সায়েন্স ফিকশন গল্প একটি লম্বা সকাল ধ্রুব নীলবড় কোনো ডিগ্রির ভার নেই। তবে সাংবাদিক হিসেবে এলাকায় আমার খ্যাতি অনেক। সম্পাদক মশাই তো বলেন আমার রান্নার হাত বেশ। কথাটা প্রশংসা হিসেবেই নিই। আজকাল খবরে এক আধটু মশলা ভালো করে কষিয়ে না দিলে চলে না।

প্রায়ই নানান অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পাই। সব রক্ষা করা হয় না। তবে গতকাল চিঠিটা পাওয়ার পরপরই সিদ্ধান্ত নিই নিমন্ত্রণটা আমাকে রক্ষা করতেই হবে।

কারণ চিঠিটা পাঠিয়েছেন স্বয়ং বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ। নামজাদা বিজ্ঞানী। নিভৃতে পড়ে থাকেন অলকেশ্বর রোডের বিদঘুটে বাড়িটায়। দেখে মনে হয় জেলখানা। কীসের বিজ্ঞানী তা কেউ জানে না। তবে বিদেশি পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে নিয়মিত ছাপা হয়।

‘যাচ্ছি মালতী! বিকেলের আগে ফিরতে পারব কিনা জানি না।’ বউকে বলতে বলতে জুতো পায়ে গলাচ্ছিলাম।

‘নাস্তা করবে না?’

‘সকালের নাস্তাটা তো তিনি অবশ্যই করাবেন। এত বড় বিজ্ঞানী। এত টাকার মালিক।’ জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে হুলোকে বললাম ‘যা! আমার জন্য রাখা দুধটা সাবাড় করে দে। বয়স সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। প্রতিদিন দুধ খেতে হবে এমন কথা নেই।’

সাইকেলের প্যাডেল আজ একটু জোরেই দাবালাম। হাওয়া ভরা চাকা। ফুরফুর করে এগোচ্ছে।

তেত্রিশ নম্বর বাড়িটার সামনে প্রকাÐ ফটক। কোনো প্রহরী নজরে এলো না। বাগানটাও পরিপাটি। কোনো মালি নেই নাকি! গোটা বাড়ি একাই সামলান বিজ্ঞানী?

দরজার বাইরে মূল রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ড. সিদ্ধার্থ। আমার অপেক্ষায়! পরিচয় দিতেই হেসে বললেন আসুন, আসুন! চলুন ভেতরে। অনেক বড় খবর অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। ঠিকঠাক লিখতে পারলে পুরস্কার কেউ ঠেকাতে পারবে না।

খুশিতে আশপাশের কিছুই খেয়াল করলাম না। অবশ্য খেয়াল করার মতো কিছু নেই। এদিকের রাস্তাটা একটু নির্জন।

বাড়িতে ঢোকার সময় একটু অবাক হলাম। বাড়ির দেয়ালটা বেশ উঁচু। জানালাগুলো খুপরির মতো।

ঢুকতেই চাপা গন্ধ নাকে বাড়ি দিল। গন্ধটা নাকে সয়ে আসতেই হরেক পদের খাবারের ঘ্রাণ পেলাম। বাহ, নাস্তাটা আজ জমবে মনে হচ্ছে।

‘তা কী খবর বলুন।’

বিজ্ঞানী জানতে চাইলেন। আমি বিগলিত। হেসে বললাম, ‘আমার আর কী খবর। খবর তো সব আপনার কাছেই।’

বসার ঘরটা সাজানো না হলেও আভিজাত্য উপচে পড়ছে। নাস্তার ট্রে হাতে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখলাম না। বিজ্ঞানী স্বয়ং ভেতরের কক্ষে গেছেন। মিনিটখানেক পর ফিরে এলেন। হাতে ফলভর্তি ট্রে। আমি হই হই করে উঠে দাঁড়ালাম।

‘আহা! একি!’

‘ও কিছু না। কষ্ট করে খবর লিখবেন। অনেকটা সময় থাকতে হবে। ভালোমন্দ খাবার তো চাই।’

আপেলে কামড় দিতে দিতে ঘরটা দেখে নিলাম এক ঝলক।

‘সময় সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?’

আপেলে কামড়ের গতি কমে গেল আমার।

‘বুঝলাম না। সময় মানে.. এক সেকেন্ড, এক ঘণ্টা।’

হো হো করে হেসে উঠলেন বিজ্ঞানী। উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালেন। জানালায় মোটা কাচ। অপরপ্রান্তে সুনসান রাস্তা। বৈদ্যুতিক পোলের ওপর একটা কাক উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। লোকের আনাগোনা নেই।

‘সময় থাকে আমাদের মাথার ভেতর। মগজটাই যত নষ্টের গোড়া। বুঝলেন সাংবাদিক মশাই।’

‘জি জি তা বটে।’

কেটলি থেকে এবার নিজেই চা ঢেলে নিলাম।

‘আপনাকে ডেকেছি আমার লেটেস্ট আবিষ্কারটা দেখাতে। আর ওটা হলো..।’

‘নিশ্চয়ই সময়ঘটিত কিছু। দারুণ কোনো ঘড়ি বানিয়েছেন বুঝি?’

বিজ্ঞানী হাসলেন না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় রাগ হলো। এতবড় বিজ্ঞানী তিনি। বের করবেন নতুন তত্ত¡কথা। ঘড়ি বানাতে যাবেন কোন দুঃখে!

‘যা বলছিলাম। আমার আবিষ্কারটা বুঝতে হলে আপনাকে আগে সময় বুঝতে হবে।’

নড়েচড়ে বসলাম। কারণ বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ সোফায় তার আসন নিয়ে বসেছেন। গৌতম বুদ্ধের মতো লাগছে তাকে। নামেও মিল, আসনেও মিল। আমি যতটা সম্ভব চেহারায় মনযোগী শ্রোতার ভাব ধরার চেষ্টা চালালাম।

‘আপনাকে একটা মশা কামড় দিল, আপনি সেটা কতক্ষণ পর টের পাবেন? কে এই সিগনাল আপনার মাথায় পৌঁছায়? স্নায়ু। এই স্নায়ুর কাজ কারবার চলে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালসের গতিতে। মানে প্রায় আলোর গতিতে। আমাদের মস্তিষ্ক সব কিছু প্রসেস করে এই গতিতে। ওই গতিটাকেই আমরা একটু রং চড়িয়ে একটু টেনে লম্বা করে নাম দিয়েছি এক সেকেন্ড।’

ব্যস, এত সহজে সময়ের ব্যাখ্যা হয়ে গেল! তবে আমার নিজের মাথা বোধহয় এত গতিতে চলে না। যতটা গতিতে বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ বলে গেলেন কথাগুলো।

‘আসলে ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারেননি।’

‘জি…।’

‘আমাদের চিন্তার কথাই ধরুন। আমাদের সমস্ত বোধশক্তি আর চিন্তার ক্ষমতা যদি হুট করে কমিয়ে দেওয়া হয়। মানে একযোগে এই জগতের সমস্ত মানুষ আর জীবের চিন্তার গতি যদি হুট করে কমে যায় তবে কেউ সেটা টেরও পাবে না। আমি কিছু বললে আপনি সেটা শুনবেন পরে, আমার কথাগুলো প্রক্রিয়া করবেন তারপর আবার আপনি কিছু বলবেন। তখন আবার নতুন করে পুরো প্রক্রিয়াটার জন্য আপনাকে নতুন করে সেকেন্ড মিনিট তৈরি করতে হবে।’

‘জি এবার কিছুটা বুঝতে পেরেছি।’

‘আমার আবিষ্কারটা হলো টাইম ডায়ালেশন নিয়ে। এ খবর কেউ জানে না।’

চা ঢালছেন বিজ্ঞানী। বিরতির পালা। আসল খবরে কখন আসবেন কে জানে। নাকি খবর এখানেই শেষ।

‘সময়কে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছি সাংবাদিক সাহেব।’

যাক বাবা, একটা হেডলাইন তো পাওয়া গেল। এবার পদ্ধতিটা দেখতে পেলেই হয়।

নাস্তা পর্ব শেষে ঝপাং করে উঠে দাঁড়ালেন বিজ্ঞানী। আমাকে হালকা ইশারা করতেই দ্রæত উঠে দাঁড়ালাম।

একটা আলো আঁধারি পথ ধরে এগোলাম দু’জন। বাড়ির পেছন দিকটায় আরেকটা ঘর। ভারী দরজা। ভেতরে আলো জ্বলছে। মাঝে মোটা রড দিয়ে ঘেরা একটা চেম্বার। সেখানে বন বন করে ঘুরছে গোলাকার একটা বস্তু। আলো ঠিকরে বের হচ্ছে সেটা থেকে।

‘কী হয় এটা দিয়ে।’

‘ওই যে, আমার সময়যন্ত্র।’

‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু এতে সময় দেখায় কী করে? মানে পাঠককে তো একটা কিছু লিখে বোঝাতে হবে।’

‘হুমম। ভুল বলেননি সাংবাদিক সাহেব। তবে আমার কথা হলো, আমার যন্ত্রটা কাজ করছে। আর সেটা প্রমাণ করাও সহজ। ইয়ে মানে প্রমাণ ছাড়া তো রিপোর্ট হবে না তাই না?’

আমি সাবধানে হাতঘড়িতে চোখ রাখলাম। সেকেন্ডের কাঁটাটা ঠিকঠাক ঘুরছে। মনে মনে গুনেও দেখলাম। এক দুই তিন। সময় ঠিকই চলছে। বিজ্ঞানীর কথায় ঠিক ভরসা রাখা যাচ্ছে না।

বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ আমার হাতঘড়ির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অন্য কিছু একটা ভাবছিলেন। তারপর ঝট করে চলে গেলেন বসার ঘরে। আমিও বন বন করে ঘোরা বস্তুটাকে আরেকপাক দেখে অনুসরণ করলাম বিজ্ঞানীকে।

‘বাড়িটা বেশ পুরনো কিন্তু শক্তপোক্ত মনে হয়।’ পরিস্থিতি হালকা করতে বললাম।

‘হুম। দরজাটা নিজেই বানিয়েছি। টাইটানিয়াম অ্যালয়ের। আমরা প্রিয় বস্তু। বোমা মারলেও আঁচড়টি পড়বে না। আমি অবশ্য খুব বেশি সময় থাকি না। সব সামলে রাখে নিতাই।’

যাক, একজন তাহলে থাকে বাড়িটায়। কিন্তু তাকে এখনো দেখছি না।

আমার মনের কথা পড়ে ফেললেন বিজ্ঞানী। ‘নিতাই বিশ্রাম নিচ্ছে। এখন আসবে না।’ কেমন যেন কঠোরতা খেলে গেল তার গলায়।

চোখ বুলিয়ে নিলাম আরেকদফা। জানালাগুলো শক্তপোক্ত। কোনো কপাট বা খোলার ব্যবস্থা চোখে পড়ল না। বিজ্ঞানী মানুষ। কেউ এসে ফর্মুলা বা যন্ত্রপাতি চুরি করলে বিরাট লস হয়ে যাবে। সে কারণেই বোধহয়।

‘চোরের সাধ্যি নেই ঢোকে। হো হো হো।’ আমার হাসিকে পাত্তা দিলেন না যথারীতি। মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘বস্তু যে বোঝে, তার ইশারায় সবই খোলে।’

সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ
সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ

বুঝতে পেরেছি বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ আমার ওপর খানিকটা খেপা। আমার অজ্ঞতা নিয়ে খানিকটা টিপ্পনী কাটলেন তাই। গায়ে লাগালাম না। তার গবেষণাকর্ম বোঝা আসলেই কঠিন। তবে এসেছি যেহেতু একটু কিছু তো ছাপা হবেই।

‘একটু সহজে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না বিষয়টা?’

মুখ বাঁকা করে অন্যদিকে তাকালেন বিজ্ঞানী। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার সোফায় বসলেন। বোতল থেকে পানীয় ঢাললেন। অনেক ধরনের ফল মিশিয়ে তৈরি জুস মনে হলো।

‘ইচ্ছেমতো খান। বাড়িতে একটা খাবারের ঘর আছে। হাজার আইটেমের শয়ে শয়ে খাবার।’

কিন্তু বিজ্ঞানীতো একবার বললেন তিনি এ বাড়িতে খুব একটা থাকেন না। তা হলে কে খায় অত খাবার। থাক, প্রশ্নটা আর করলাম না।

পানীয়টা দারুণ। মনে হলো সারাদিন কিছু না খেলেও চলবে। বিজ্ঞানীর তৈরি শক্তিবর্ধক কিছু আছে বোধহয়।

‘তা বিষয়টা..।’

‘ও হ্যাঁ। আপাতত বাদ দিন। বুঝতে পারবেন। সময় হোক।’

‘সময় নিয়ে যেহেতু আবিষ্কার, বুঝতে সময় তো লাগবেই, হা হা হা।’

গুমোট ভাবটা কাটল এবার। বিজ্ঞানীও হেসে উঠলেন আমার সঙ্গে।

‘আমার বাড়িতে সব ব্যবস্থাই আছে। নিতাইকে বললেই চলে আসে। শুধু বিশ্রামের সময়টা ছাড়া। ওর কাছে যা চাইবেন এনে দেবে। রান্নার হাত বেশ।’

‘ওকে নিয়েও দুকলম লিখে দেব নাকি!’

এভাবে কথাবার্তায় বারোটা বেজে গেল। বিকেল চারটার মধ্যে জমা দিতে হবে রিপোর্ট। ওঠার জন্য উসখুশ করছিলাম। বিজ্ঞানী আয়েশ করে ঝিমুচ্ছেন। আমি বলার আগেই বললেন, ‘আরে ভাই, তাড়া নেই। যাবেন যাবেন। ঢের সময় আছে।’

জানালার বাইরের কাকটাকে দেখলাম। তার হাতেও যেন ঢের সময়। আকাশে কাকে যে খুঁজছে!

দুপুর দুটো। এবারও বিজ্ঞানী নিজে খাবার নিয়ে এলেন। নিতাইয়ের দেখা নেই। জানা গেল ও নাকি এক দিন কাজ করে এক দিন ঘুমায়। কী আজব মানুষরে বাবা!

‘আমাকে এবার উঠতেই হচ্ছে। তা না হলে আপনার খবরটা তো কালকের পত্রিকায় ধরাতে পারব না।’

‘কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লিখবেন কী? আপনি তো প্রমাণই পেলেন না।’

‘ও না হয় আপনাকে কোট করে লিখে দেব। পাবলিক বুঝুক যে একটা কিছু আবিষ্কার হয়েছে। পরে আবার একটা ফলোআপ দেব।’

‘উঁহু। প্রমাণটা বড় বিষয়। সাংবাদিকের উচিৎ অন্তত নিজে প্রমাণটা দেখে তারপর এমনভাবে রিপোর্ট লেখা যেন কেউ চাইলও মিথ্যে বলতে না পারে।’

‘তো এখন…?’

এত আপ্যায়ন সত্তে¡ও মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম ঠিকই। ব্যাটার গল্প করার বাতিক আছে নির্ঘাৎ।

এদিকে পাঁচটার মধ্যে অফিসে একটা কিছু জমা না দিলে সম্পাদক আমাকে ফোনের পর..। উফফ পকেটে হাত দিতেই মুখটা তেতো হয়ে গেল। ফোনটা ভুল করে বাসায় ফেলে এসেছি।

‘এক কাজ করুন। একটু বসুন। মোড়ের দোকানটায় যাব আর আসব। আমি এলেই বের হয়ে যাবেন।’

কথাটার মধ্যে আদেশের এমন এক সুর, অগ্রাহ্য করা কঠিন। মাথা নাড়ালাম। আরেক গøাস অমৃত ঢেলে নিলাম।

ভারী দরজাটা খোলারও অনেক বুজরুকি। গোপন নাম্বার দিতে হয়। তারপর চাবি দিয়ে ঘোরাও। ঘড় ঘড় শব্দ করে খুলল। বেরিয়ে গেলেন বিজ্ঞানী। স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।

ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল। কোনফাঁকে যে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজকের রিপোর্ট জমা দেওয়ার আশায় গুড়েবালি।

সোফা ছেড়ে চোখ ডলে তাকালাম। এ ঘর ও ঘর দেখলাম। বিজ্ঞানী নেই। ডাকও দিলাম কয়েকবার। সাড়া মিলল না। মেজাজ ক্রমে তিরিক্ষি হতে শুরু করল।

‘নিতাই! নিতাই!’

নাহ তারও সাড়া নেই। ছুটে গেলাম দরজার কাছে। জানা কথা এ দরজা খোলার সাধ্য নেই। বাড়ির পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কারাকক্ষের মতো সেই ঘরে বনবনে যন্ত্রটাই আছে। ওটা টপকে যাওয়ার রাস্তাও নেই। থাকলেও কী লাভ! ওপাশে নিরেট দেয়াল। পেছনের দরজাই নেই!

বিজ্ঞানীর কিছু হয়নিতো আবার? কোনো দুর্ঘটনায় পড়েননি তো? সর্বনাশ! আটকা পড়ব নাকি এই প্রাসাদে!

কেটে গেল আরো দুই ঘণ্টা। অনেকগুলো দরজা আবিষ্কার করলাম এর মধ্যে। কয়েকটা বন্ধ। বাথরুম পেয়েছি দুটো। ওগুলোয় কোনো জানালা নেই। একটা ঘরে থরে থরে সাজানো বই। পড়ার ইচ্ছে নেই মোটেও।

আরেকটা ঘরের দরজা বেশ ভারী। খুলতেই গায়ে কাঁপুনি লেগে গেল। বেশ বড়সড় ঘর। নাকি রেফ্রিজারেটর? তাকে সাজানো খাবার, সবজি, ফল। খিদে পেল না দেখে। বেরিয়ে পড়লাম।

রাজকীয় এক বিছানাও পেলাম একটা ঘরে। বেশ শীতল। তাতে সাজানো গোছানো চাদর। দেখলেই ঘুমিয়ে পড়তে মন চাইবে এমন।

‘স্যার কিছু খাবেন?’

কানে যেন রিমঝিম করে বেজে উঠল গলাটা। ঘুরে তাকাতেই ভিরমি খেলাম। এ তো জগদ্দল এক যন্ত্র!

‘আজ্ঞে স্যার, আমি নিতাই। এ বাড়ির রোবট। কিছু খাবেন?’

‘তুমি একটা রোবট? ঠিকাছে বাপু রোবট হও আর স্টিলের ভূত, আগে জলদি জলদি সদর দরজাটা খুলে দাও। আমাকে বের হতে হবে।’

নিতাই তার ধাতব মাথাটা নিচু করে ফেলল। কিছু বলল না। রোবটের সেকি অভিনয়! মিন মিন করে বলল, ‘আমাকে তো সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া পাসওয়ার্ডও জানা নেই।’

‘তোমার মালিক আসবেন কবে শুনি! আমাকে এভাবে বন্দি করে পালালেন!’

‘উনি তো দ্রæতই চলে আসেন। কখনো এক মিনিটের বেশি দেরি করেন না। এই যাবেন আর আসবেন।’

বলছেন কি নিতাইবাবু! ছ-সাত ঘণ্টা হতে চলল আর বলে কিনা যাবেন আর আসবেন!

‘স্যার কিছু খাবেন?’

‘এতক্ষণ করছিলে কী?’

‘আমি চার্জ হচ্ছিলাম স্যার। একটুখানি চার্জ নিই, একটুখানি কাজ করি।’

একটুখানি! সারাটাদিন দেখা নেই, বলে কিনা একটুখানি!’

‘কিছু খাবেন স্যার?’

‘দশ কেজি বিরিয়ানি খাব! যা ভাগ!’

ঠিক করেছি আর এক ঘণ্টা দেখব। এর মধ্যে না ফিরলে গোটা বাড়ি তছনছ করে ফেলব।

বসে বসে ভাবছি কী করা যায়। ঘণ্টাখানেক পর ঘ্রাণ পেলাম। বেশ রান্না করেছে নিতাইবাবু। ঘ্রাণে ভরে গেছে গোট ঘর।

‘এই নিন স্যার।’

‘এ কি!’

রোবটটা যে এতটা গর্ধভ চিন্তাও করিনি। বিশাল এক হাঁড়িভর্তি বিরিয়ানি নিয়ে হাজির। সত্যিই মেপে মেপে দশ কেজি রান্না করেছে!

দুদিন পর। সকাল। গত রাতে স্বপ্নে বিজ্ঞানীকে দেখলাম। আমার দিকে একগাল হেসে বললেন, এই তো আমি এসে যাচ্ছি, আর একটু সবুর করুন!

লাফিয়ে উঠলাম। টেবিলে ব্রেকফাস্ট তৈরি। খিদে ছিল, তা না হলে ছুড়ে ফেলে দিতাম ওটা।

‘নিতাই!’

‘জি স্যার।’

‘তোমার স্যারের খোঁজ পেলে?’

‘মাত্র তো বের হলেন। এখুনি..।’

‘কী! দুটো দিন কেটে গেল। আর বলছো কিনা!’

থাক রোবটের সিস্টেমে গÐগোল আছে নিশ্চয়ই। মেশিনের সঙ্গে তর্ক বৃথা। তারচেয়ে খেয়েদেয়ে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজি।

প্রায় চার ঘণ্টা গাধার খাটুনি খাটলাম। বাড়িতে ভারী কোনো যন্ত্রপাতিও পেলাম না যেটা দিয়ে দরজায় আঘাত করা যাবে। দুটো চেয়ারও ভেঙেছি এর মধ্যে। জানালায় সামান্য আঁচড়ও বসাতে পারিনি।

বিজ্ঞানীর কারখানায় গিয়েও সুবিধা করতে পারিনি। বন বন করে ঘুরত থাকা গোলগাল যন্ত্রটার গায়ে সোফার কুশন, বাটি, চামচ, ছুরি সবই ছুড়েছি। কিছু হয়নি। ইস্পাতের রডগুলো আদৌ ইস্পাত নাকি সেই হতচ্ছাড়া টাইটানিয়াম কিনা কে জানে। তাতেও শক্তি অপচয় করে লাভ হবে না বুঝতে পারলাম।

রাত হয়ে গেল। একটু আশ্বস্ত বোধ করতে শুরু করলাম এই ভেবে যে এতক্ষণে আমার খোঁজে হইচই পড়ে যাওয়ার কথা। সবাই জানবে আমি কোথায় এসেছি। কিন্তু, এতক্ষণেও কেউ আসছে না কেন? নিতাইকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। ও একটা গবেট। কিছু জানতে চাইলেই বলে ‘স্যার মাত্র বের হয়েছেন। এখুনি ফিরবেন।’

‘তোর স্যারের নিকুচি করি। হাতের কাছে পাই একবার।’ নিতাইকে ধরে কষে থাপ্পড় বসাতে গিয়েছিলাম একবার। ধাতব হাত দিয়ে এমনভাবে ঠেকাল আরেকটু হলে আমার হাড়ই ভেঙে যেত। অবশ্য যখন যা বলছি রান্না করে খাওয়াচ্ছে, জুস বানিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু কেউ খোঁজ করছে না কেন আমার?

একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছি। বিজ্ঞানী মারা গেছেন এবং সবাই ধরে নিয়েছে আমিও নিরুদ্দেশ। কারণ বাড়ি তো লক করা। আবার এও হতে পারে বিজ্ঞানী তার বাড়ির বাইরে ইচ্ছে করে নোট রেখে গেছেন, ‘সাংবাদিক মশাই পরে আসুন। আমার ফিরতে দেরি হবে।’

মাথায় এটা ওটা তত্ত¡ ভিড় করেই চলেছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

রক্তবন্দি
রক্তবন্দি

এক মাস কেটে গেল। বন্দি জীবন ক্রমে অসহনীয় ঠেকতে লাগল। নিতাই এক দিন বসে বসে চার্জ নেয়, আরেকদিন কাজ করে। যে দিন ও চার্জ নেয় সেদিন সবচেয়ে খারাপ কাটে। কথা বলার কেউ থাকে না। রান্নাটাও নিজেকে করতে হয়।

ইলেকট্রিক তারের ওপর বসে থাকা কাকটা ছাড়া। সম্ভবত নতুন আরেকটা কাক। সবাই ওই তারের ওপরই বসে। আকাশে কী যেন খুঁজে বেড়ায়।

বাড়িটাকে তছনছ করব ভেবেছিলাম। তছনছ করার মতো কিছু নেই। রেফ্রিজারেটরে খাবার যা আছে তা হিসাব করে খেতে হবে।

এখন অবশ্য খিদেও কমে গেছে। খাবারের বহর দেখে বোঝা যায় শয়তান বিজ্ঞানী আগেই ঠিক করে রেখেছিল যে এখানে আমাকে আটকে রাখবে।

প্রতিদিন তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম বাড়িটা। একটা কিছু পাওয়ার আশায়। নিতাই যে সময়টা চার্জ নেয় তখন গিয়ে দরজায় এলোমেলো পাসওয়ার্ড দিতে থাকি। ও আমাকে সদর দরজার সামনে দেখলেই তেড়ে আসে। মূল সমস্যাটা হলো তিনবার ভুল করলেই সেদিনের মতো আর কোনো সংখ্যা টেপা যায় না।

আরো অনেকদিন কেটে গেল। জীবনে কোনোদিন সাহিত্যচর্চা করিনি। তাও লিখতে লাগলাম টুকটাক। পড়তে শুরু করলাম লাইব্রেরির মোটাসোটা বিজ্ঞানের বইগুলোও। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও পরে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম। মনযোগ কেটে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই পড়া এগোতে লাগল তরতর করে।

দিন গোনা থামিয়ে দিয়েছি। জানালার কাচটাও যে নকল সেটা বুঝতেও বাকি নেই। যখনই বাইরে তাকাই, দেখি আলো জ্বলছে। কাকটাও নড়ছে না একদমই। নিশ্চল একটা ছবি সাঁটিয়ে রাখা হয়েছে উঁচু জানালাটায়।

সম্ভবত তিন চার মাস কেটেছে। সময়ের তালগোল লেগে যাওয়াই স্বাভাবিক। হাতঘড়ির ব্যাটারি শেষ। বাড়িটায় নেই কোনো দেয়ালঘড়ি। ঘুম এলে বুঝতে পারি একটা দিন শেষ হতে চলল।

নিতাইকে সময়ের কথা জিজ্ঞেস করলে ও হাবার মতো তাকিয়ে থাকে। যেন জগতের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটা করেছি।

‘নিতাইবাবু। তুমি কি ওই ইস্পাতের গারদগুলো ভাঙতে পারবে? ওই বন বন করা মেশিনপত্র সব ভেঙেচুরে ফেলতে চাই।’

‘আমার ওসবের অনুমতি নেই স্যার।’

‘তোমার কী কী অনুমতি আছে? এ বাড়ির বিদ্যুতের উৎসটা কোথায় লুকানো বলতে পারবে? মেইন সুইচ অফ করলে কি কাজ হবে? আচ্ছা বাদ দাও। তুমি তো সেটাও বলবে না।’

‘না স্যার তা জানি। ওই ঘরে একটা ফিশন যন্ত্র আছে। আরো অনেক অনেক দিন বিদ্যুতের যোগান দেবে ওটা।’

প্রতিবার ঘুমুতে যাওয়ার আগে একটা করে দাগ দিই খাতায়। সেই হিসাবে দেড় বছর হতে চলল আমার বন্দিদশার। ভাগ্য ভালো যে এখনো পাগল হয়ে যাইনি। লাইব্রেরিটাই বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ ডপলার ইফেক্ট নিয়ে আরো বিস্তারিত পড়ব ঠিক করেছি। এরপর ল্যাগরেঞ্জের অংকগুলো প্র্যাকটিস করে জোসেফ লারমারের অসমাপ্ত ইকুয়েশনটা নিয়ে বসবো।

সাড়ে তিন বছরের মতো কাটল। বিজ্ঞানের বই পড়ে আমি এখন ভালো মতোই বুঝতে পেরেছি কী ঘটছে আমার সঙ্গে। কিন্তু বুঝে লাভ হলো কী। সদর দরজা খোলার চেষ্টা বছর দুয়েক আগেই বাদ দিয়েছি। এখন বসে বসে ভাবা আর লেখা ছাড়া কাজ নেই আমার।

ছায়া এসে পড়ে
ছায়া এসে পড়ে

বসে বসে ভাবতে লাগলাম প্রথম দিনের কথা। বিজ্ঞানীকে দরজা খুলতে দেখেছি। তার হাত নড়েছিল পাঁচবার। তার মানে সংখ্যাটা পাঁচ ডিজিটের। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না ঠিক কী গতিতে কত ডিগ্রিতে তার হাত নড়াচড়া করেছিল। ওটা ধরতে পারলেও সংখ্যাটা আঁচ করা যেত।

যাওয়ার আগে আমাদের কথাবার্তা কী হয়েছিল? মোড়ের দোকানে যাচ্ছিলেন বিজ্ঞানী। যেতে যেতে বোধহয় বলছিলেন, বস্তু যে বোঝে, তার ইশারায় খোলে। এর মানে কী? এটা কি কোনো ধাঁধা। দরজা খোলার ধাঁধা?

নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। এখন টের পাচ্ছি, এই দীর্ঘ সময়ে আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিজ্ঞান পড়তে পড়তে চিন্তা করার ধরনটাই বদলে গেছে। নতুন করে চিন্তা করার হাজারটা দরজা যেন খুলে গেল। দরজা খোলাখুলির কথা মাথায় আসতেই যেন মগজে টং করে উঠল তথ্যটা। বিজ্ঞানীর প্রিয় বস্তু টাইটানিয়াম। পাসওয়ার্ডটাও পাঁচ অংকের। টাইটানিয়ামের সঙ্গে পাঁচের সম্পর্কটা ইহজীবনেও জানতে পারতাম না, যদি না এর মধ্যে রসায়ন পড়ে শেষ না করতাম। চলে গেলাম দরজার কাছে। কাঁপা কাঁপা হাতে টিপলাম ২, ৮, ১০, ২। টাইটানিয়ামের পরমাণুর চারটি কক্ষপথে ঘুরতে থাকা ইলেকট্রনের সংখ্যা এগুলো। ঘড়ঘড় শব্দটাকে বিশ্বাস করতে চাইল না আমার কান। মুহূর্তে দপ করে চড়ে গেল মেজাজ। পালিয়ে যাব এভাবে? শয়তানটাকে শাস্তি না দিয়ে? কি-প্যাডের অপশনগুলো উন্মুক্ত হয়ে গেল। বদলে দিলাম পাসওয়ার্ড। এরপর সোজা চলে গেলাম নিতাইয়ের কাছে।

চার্জ হওয়া অবস্থায়ও আগাম নির্দেশনা নিতে পারে ও। কানে কানে বললাম, ‘আমার অনেক খিদে পেয়েছে নিতাই। ঘরে যা যা আছে সবই রান্না করো। কিচ্ছু বাদ রেখো না।’

দরজাটা পুরোপুরি খুলল ততক্ষণে। বাইরের দৃশ্য দেখে অবাক হলাম না। কারণ আমি এতদিনে বুঝে গেছি টাইম ডায়ালেশন কাকে বলে। ওই তো রাস্তার ওপর এক পা উপরে তুলে আটকে আছে বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থ। দেখে মনে হবে দুই কদমও এগোয়নি। বিদ্যুতের পিলারের ওপর বসে থাকা কাকটা ওড়ার জন্য সবে মাত্র পাখা মেলে ধরেছে দুপাশে। রাস্তার এক কোণে শূন্যে ভাসছে একটা বেড়াল। সব কিছু চলছে ঢিমেতালে। দরজার ওপাশে সময় যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে। আমার সাপেক্ষে যা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। প্রমাণ একেবারে হাতেনাতে।

বাইরে পা রাখতেই হুট করে যেন কেউ সুইচ টিপে দিল। প্রাণ ফিরে পেল গোটা দুনিয়া। কাকপক্ষীও টের পেল না ঝাড়া সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে আমার একান্ত ঘড়িতে। বিজ্ঞানী সিদ্ধার্থকে দেখলাম ফুরফুরে মেজাজে এদিক ওদিক তাকাতে। চট করে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। দরজাটা খোলা রেখে এসেছি। একটু পর বিজ্ঞানী পেছনে তাকাল। দরজা খোলা দেখে ঝেড়ে দৌড় লাগাল। ভাবল ভুল করে দরজা খোলা রেখে এসেছে! বোকার হদ্দ! সময়জ্ঞান নেই! ভেতরে ঢুকল হতচ্ছাড়াটা। দরজাটা যেন চোখের পলকে বন্ধ হয়ে গেল আবার।

বড় করে দম নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা সাইকেলটার দিকে চললাম। কয়েক কদম ফেলতে না ফেলতেই বুঝে গেলাম এতক্ষণে কী ঘটে গেছে। কিছুক্ষণ পেছন ফিরে তাকিয়ে রইলাম বন্ধ দরজাটার দিকে। নাহ, কাউকে বের হতে দেখলাম না।

ধ্রুব নীলের বাদবাকি বই কিনতে ভিজিট করুন এই লিংকে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!