আমি মানিক। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আমি যখন প্রথম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার বাবা-মা দুজনেই মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। আমি কীভাবে যে বেঁচে যাই সেটা কল্পনা করতে পারে না কেউ। সবাই বলে আমি নাকি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি। অলৌকিক মানে কি বুঝতে আমার কষ্ট হয়। তবুও অল্প অল্প বুঝি। আমাকে আল্লাহ বাঁচাইছেন। আল্লাহতো সব পারে। কিন্তু এখন আমাকে বাঁচায় না কেন আর?
আমার বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে আমাকে একটা পরিবারে দত্তক নেয়। আমি তাদের বাবা-মা বলেই ডাকি। তাদের কোনো সন্তান নাই বলে তারা আমাকেও সন্তানের মতো আদর করে। প্রথম প্রথম আমার বাবা-মা ডাকতে কষ্ট হতো। কিন্তু বাবা-মা না ডাকলে তারা আমাকে খেতে দিতো না। তাই একদিন ডেকেই ফেললাম। আর তারা তো আমাকে আদরই করে। আমি তখন খুব সুখে ছিলাম। আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঘুরতে যেতো। আমি যা চাইতাম বাবা তা-ই দিতো। আমি যখন ক্লাস টু’তে উঠি তখনই আমার জীবনের কঠিন সময় শুরু হতে লাগলো। আমার মা এখন আমার মুখ থেকে মা শুনতে চায় না। তার পেটে নাকি আমার ভাই আছে। আমাকে নিয়ে তাদের এখন আর খুশি নাই। তাদের সব খুশি তাদের নতুন সন্তান নিয়ে। আমাকে আর আগের মতো ঘুরতে নিয়ে যায় না বাবা। মাও আগের মতো পড়াতে বসে না। আমার বড্ড মন খারাপ হতো। তবে কাউকে কিছু বলতাম না। একদিন আমার ভাই আসলো দুনিয়ায়। আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার ভাইয়ের পৃথিবীতে আসার দিনে আমার বাবা-মায়ের খুশিতে আমিও খুশি। আমি তখনও জানতাম না এটাই আমার সব খুশি কেড়ে নেবে।
আমি তখনও সৎ মানে কি সেটাই বুঝতাম না। আমি নাকি তাদের সৎ সন্তান। তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলাম আমি। গণিতে নম্বও কম পেয়েছি বলে বাবা আমাকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন সেদিন। আমি অনেক কান্না করেছি। প্রথম আমাকে বাবা গায়ে হাত তুলেছে। এরপর প্রায় বাবা আমাকে মারতো। ভুল খুঁজে খুঁজে মারতো। কিন্ত মা আমাকে বাঁচাতো। আমি জানি মা আমাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু বাবা আমাকে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। হঠাৎ এরকম করছে কেন? আমি যখন ক্লাস ফোরে উঠি তখন আমার রোল চলে যায় চারে। সেদিন মা আমাকে মারে। আমার মা আমাকে মেরেছে সেটা আমি কোনো ভাবেই মানতে পারিনি। আমি রাগ করে খাবার খাচ্ছি না। কিন্তু কেউ আমাকে আদর করে ডাকছে না খাবার থেতে। আমার মা আমাকে খাবো না বললে খাইয়ে দিতো। আজ মা নিজেও ডাকছে না। আমি না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে উঠে আর না খেয়ে থাকতে পারিনি। তাই নিজে নিজে রান্না ঘরে গিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সবজির ডেকসিটা নামাতে গিয়ে সব ফেলে দিলাম। মা দৌঁড়ে এলো এবং সব ফেলে দিছি দেখে খুব মারলো। আমি আবারও মার খেলাম। এবারের মারগুলো শরীর থেকে রক্ত ঝরানোর মতো। পাশের বাসার আন্টি এসে আমাকে তাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে মলম লাগিয়ে দিলো। এরপর ভাত দিলো খেতে। আমি ক্ষুধায় ক্লান্ত। খেয়ে নিলাম। রাতে আবার মার খেলাম। পাশের বাসায় গিয়ে খেন ভাত খাইছি এটাই আমার অপরাধ। আমি নাকি মানসম্মান সব শেষ করে ফেললাম।
এদিকে আমার মার খাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মার খেতে খেতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলেও মাথা কখনও ফাটেনি। এবার আমার প্রথম মাথা ফাটানোর গল্পটা বলি। সেদিন আমার ছোট ভাইটা প্রচুর কান্না করছে। মা ভাইকে আমার কোলে দিল। বললো বাইরে থেকে একটু ঘুরিয়ে আনতে। আমি বাইরে নিয়ে রাস্তার গাড়ি দেখাচ্ছি, পাখি দেখাচ্ছি। ভাইয়ের কান্না তবুও থামছে না। তখন আমার মনে এলো তাকে কোলে নিয়ে লাফালে সে হাসে। সাথে সাথে লাফানো শুরু করে দিলাম। ওমনি সে কান্না থামিয়ে হাসা শুরু করলো। আমার দেখতে বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু আমার ভালো লাগা বেশিক্ষণের জন্য স্থায়ী হলো না। বাবা বাজার থেকে আসছিলো তখন। আমি ছোট ভাইকে নিয়ে লাফাচ্ছি এটা দেখেই আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ফুটবলের মতো লাথি দিচ্ছেন। আম্মু একটা কাটি দিয়ে ডাল রান্না করেন। বাবা সেটা দিয়েও মারলেন আমাকে। এরপর যা করলে তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার মাথাটা ধরে দেওয়ালের সাথে সজোরে আঘাত করলেন। সাথে সাথে আমার মাথা দিয়ে গরম গরম রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত দেখে আমাকে বাঁচানোর জন্য মা এলো। ততক্ষণে আমার বাবার শক্তিও শেষ। অথচ মা একবারও বলেনি আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন। রক্ত বন্ধ করে আমার মাথায় ব্যান্ডেজ করে মা কিছু খেতে দিলো। আমি বোবার মতো করে খেলাম। এরপর মা-বাবা দুজন আমাকে আদর করতে চেষ্টা করছে। আমি তখন আবার কান্না করলাম। এটা ঘৃণার কান্না। আমি তাদের ছুতে দিলাম না। তবুও মা আমার জামা খুলে শরীরর দাগগুলো দেখে আফসোস করছে। মলম লাগিয়ে দিলো। কিন্তু আমার শরীরের দাগ শেষ হলো না। কয়েকদিন পরপরই শরীরে নতুন দাগ তৈরী হয় আর মলম লাগায় মা। অনেক সময় মা নিজে মেরে নিজে মলম লাগায় অনেক সময় বাবা মারলে মা এসে মলম লাগায়। কয়েকবার মলমও লাগায়নি আর। একদিন আমি তরকারিতে হাত দিয়ে ফেলেছি এজন্য আমাকে ভাতের চামচ দিয়ে মাথায় আঘাত করেছেন মা। সাথে সাথেই মাথা ফেটে রক্ত বেরহয়। এভাবে মাথা ফাটাফাটি চলে আসছে। আমি একসময় পড়াশোনাতেও দুর্বল হয়ে পড়েছি। পঞ্চম শ্রেণীতে এ প্লাস পাইনি। এজন্য বাবা-মা দুজনের মার খেলাম। সেবার মার খেয়ে রাগে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা ধরে এনে আমাকে রশি দিয়ে বেধে এমন মার মেরেছে যা মনে করলে এখনও আমার শরীরে কাটা দিয়ে যায়। মারের উপর মার আমার শরীরকে থেতলে দিয়েছে। এখন আমার মনে হয় মার না খেলেই আমার ভালো লাগে না। মার খেতে খেতে এখন অপরাধ করতেও আর ভয় হয় না। হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে ভয় কেটে গেছে অনেক। আমি বুঝে গিয়েছি আমার প্রতি বাবা-মা শুধু দায়িত্ব পালন করছেন। মন থেকে কোনো টান নাই। আমি তাদের আসল সন্তান নাই। আসল সন্তান আমার ভাই সোহেল। তাকেই তারা ভালোবাসবে। আমিও এসব পাশের বাসার আন্টির কাছ থেকে আগেই শুনেছি।
এরপর একদিন আমি ইচ্ছে করেই সন্ধ্যার আগে বাসায় আসিনি। ভিডিও গেমস খেলেছি দোকানে। বাসায় ফিরেছি রাত আটটায়। বাসায় গিয়ে ইচ্ছেমতো মার খেয়েছি। মার খেতে খেতে আমি ক্লাস্ত হাইনা এখন। ক্লান্ত হয় আমার বাবা-মা। এভাবেই আমার মার খাওয়া চলতে থাকে। আমি সপ্তম শ্রেণীতে উঠে বিশেষ বিবেচনায় পাশ করি। মানে আমি ৪ সাবজেক্ট ফেল করেছি। তবু স্যারেরা আমাকে কোনো রকমে তুলে দিয়েছেন। আমি এখন বই খোলা রাখি বাসায়। পড়ি না। আমার বাবা-মা আমার পড়াশোনার খোঁজ রাখে না। শুধু পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে। আমাকে কেউ পড়ায়ও না। পরীক্ষার রেজাল্টে বিশেষ বিবেচনায় পাশ দেখে আবারও মার খেলাম আমি। আমাকে জানালার সাথে বেঁধে রুটি বানানোর লাটিটা দিয়ে মারছে মা। আর বাবা দিচ্ছে লাথি। পেটে একটা লাথি পড়ে গেছে ভুলে। আমি তখন অজ্ঞান হয়ে গেছি। পরে আবার পাশের বাসার আন্টিরা এসে বাবা-মা সহ ডাক্তার এনে আমাকে সুস্থ করেছে। জ্ঞান ফিরে আমি যাদের দেখছি তারা আসলে আমার বাবা-মা নন। আমি তাদের হাতেই আমার মৃত্যু দেখছি। তবুও আমি তাদের ডাকছি বাবা-মা। বিছানায় শুয়ে আমি মনে মনে ভাবছি পরের বার পরীক্ষায় আমি সব বিষয়ে ফেল করবো। তাহলে হয়তো আমাকে মেরে ফেলবে তারা। তাহলে আমি আমার আসল বাবা-মায়ের কাছে চলে যেতে পারবো। সেবার নিশ্চই আরও কঠিনভাবে আমাকে মারবে। এসব ভাবতে ভাবতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম বাবা-মায়ের মৃত্যুর সময়ে মানুষ কি বলেছে সেসব। তখন সবাই বলে আমি নাকি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি। অলৌকিক মানে যা কল্পনা করা যায় না। আমি নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরেছি। সবাই বলেন আমাকে নাকি আল্লাহ বাঁচাইছেন। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করেছি আল্লাহ কে? সে বললো আল্লাহ আমাদের বানাইছেন। আমি বললাম তিনি সব পারে? তিনি বললেন হ্যাঁ। ততক্ষণে আমার আবারও ঘুম ভেঙ্গে গেছে। গভীর রাত হয়ে গেছে কখন সেটাও জানি না। আমি চোখ দুটো খুলে চিন্তা করছি আল্লাহতো সব পারে। তাহলে এখন আমাকে বাঁচাতে পারে না কেন?
লেখক: আজহার মাহমুদ