class="post-template-default single single-post postid-10105 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

সুন্দরী হওয়ার জন্য মেয়েদেরকে লেলিয়ে দেয়া সবচেয়ে বড় নির্যাতন : তসলিমা নাসরিন

ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন বলেছেন, জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে, সবচেয়ে বড় নির্যাতন হল- মেয়েদের সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেয়া।

বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে তিনি এ কথা বলেন।

পাঠকদের জন্য তসলিমা নাসরিনের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল-

‘মেয়েদের শরীরের জন্য বিশ্ব ব্যতিব্যস্ত। তাদের পোশাক ও অলঙ্কারের অন্ত নেই। চারদিকে সাজ সাজ রব। শরীর সাজাও। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অবধি সাজাও। এটা পরো, ওটা মাখো। ফুটফুটে ঝলমলে চকচকে রাখো সর্বাঙ্গ।

কিন্তু কেন? কার জন্য? মেয়েরা কি একবারও ভাবে- কার জন্য? কাকে তৃপ্ত ও তুষ্ট করার জন্য? অনেক মেয়েই জোর দিয়ে বলতে চেষ্টা করবে যে, নিজেদের জন্যই তারা সাজে, নিজের ভালো লাগাই মূল কথা। বটে। ও রকম মনে হয়।

কিন্তু ভালো লাগা ও না লাগার উদ্রেক হওয়ার পেছনে দীর্ঘকালের শিক্ষা থাকে, তা কে অস্বীকার করবে? কে অস্বীকার করবে নারীকে সাজসজ্জা করানোর ইতিহাস?

আগে বলেছি- পটলচেরা চোখ, ফুলের মতো হাসি, কালো মেঘের মতো চুল, পীনোন্নত বুক, সুডোল বাহু—মেয়েদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে এ রকম লক্ষ উপমা এবং চিত্রকল্পের ব্যবহারই প্রমাণ করে যে মেয়েদের শরীরই শেষ পর্যন্ত সব।

ছেলেটি ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার অথবা ব্যবসায়ী অথবা লেখক অথবা শিল্পী। মেয়েটি বেঁটে বা লম্বা, কালো বা ফর্সা, সুন্দরী বা অসুন্দরী। এখনও পুরুষের পরিচয় তার কর্মে আর নারীর পরিচয় সে দেখতে কেমন, তাতে।

দীর্ঘকাল ধরে এসব দেখেও মেয়েদের কেন রাগ হয় না? কেন বেশিরভাগ মেয়েই পরমানন্দে মেনে নেয় নারী পুরুষের বিকট বৈষম্য! কেন তারা প্রশ্ন করে না, কেন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে না- আমরা যেমন আছি তেমনই থাকব? আমরা বোধবুদ্ধিসম্পন্ন রক্ত-মাংসের মানুষ, রঙ করা পুতুল নই।

আমরা আসলে বিশ্বাসী, নকলে নয়। কতটুকু বিদ্যে আমাদের পেটে আছে, কতটুকু শিক্ষা মাথায়, কাজে কেমন পারদর্শী, আমাদের কীসে কেমন দক্ষতা—সেগুলোই দেখার বা দেখানের।

নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সামান্য সচেতন হলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বুঝত যে জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে, সবচেয়ে বড় নির্যাতন হল- মেয়েদের সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেয়া।

এর পেছনে যেন মেয়েদের অঢেল টাকা যায়, সময় যায়, মাথা যায়, যেন সর্বনাশ হয়। আর পুরুষ নিশ্চিন্তে নিরাপদে ভুঁড়িওয়ালা, টাকওয়ালা, কুৎসিত কদাকার শরীর নিয়েও জগতের যাবতীয় ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে বিরাজ করবে। কেউ তাদের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে মোটেও ভাবিত হবে না।

প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে তাদের কাজকর্ম দেখে। এসবের কিছু ব্যতিক্তম যে নেই তা নয়। কিন্তু ব্যতিক্তম কখনও উদাহরণ হতে পারে না। অনেকে হয়তো বলবে সিনেমা থিয়েটার এবং বিজ্ঞাপনের জগতে পুরুষের সৌন্দর্য গোনা হয়। তা হয়তো হয় কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।

সিনেমার কথা ধরি- দিলীপ কুমারের মতো ইয়া মোটা কোনো অভিনেত্রীকে ভাবা যায় তারকা হিসেবে? যে শরীর নিয়ে গোবিন্দ নায়ক হয়, কোনো মেয়েকে কি অমন স্থূল শরীরে নায়িকা করা হবে কখনও? অমিতাভ বচ্চন তার ত্বকের ১০০ ভাঁজ নিয়েও আজ মেগাস্টার থেকে যেতে পারেন, রেখাকে কিন্তু বলিরেখা সব ঘুঁচিয়ে তবে টিকে থাকতে হচ্ছে!

উত্তম কুমার ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন বয়স হলেও; চুলহীনতা, স্থূলতা, বলিরেখা নিয়েও যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তারকাখ্যাতি কমেনি, বরং বেড়েছে।

সুচিত্রা সেনকে কিন্তু ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। বেরোলেই তার তারকাখ্যাতি ঝটিতে বিদেয় হবে। এ কথা জানেন বলেই জনসমক্ষে তিনি চেহারা দেখান না। লুকিয়ে আছেন বছরের পর বছর।

সুচিত্রা সেন খুব ভালো অভিনেত্রী ছিলেন, কিন্তু অত বড় অভিনেত্রীকেও মর্যাদা পেতে হয় তার শরীরের কারণে। ত্বকে ভাঁজ পড়লে, স্তন নুয়ে পড়লে, চুলে পাক ধরলে, নারীরা যত বড় অভিনেত্রীই তারা হোন না কেন, আর সম্মান পান না।

অপর্ণা সেনের প্রতিভার ধারে কাছে আসার যোগ্যতা হবে না অনেক পুরুষ-চিত্রপরিচালকের। কিন্তু তারপরও অজান্তেই তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চমৎকার শিকার হয়ে বসে আছেন। তাকেও কী ভয়াবহ রকম সাজতে হয়, প্রমাণ করতে হয় যে তিনি সুন্দরী!

আজ বলছি- সুন্দরী মেয়ে মাত্রই বোকা নয়। সুন্দর পুরুষ মাত্রই হাবা নয়। আর অসুন্দরদের মাথা ভর্তি বুদ্ধি আর বুদ্ধি, এও ঠিক নয়। শুধু মেধারই কদর হবে? সৌন্দর্যের কেন কদর হবে না? বাবা-মা’ চেহারা সুরত সুন্দর হলে ছেলেমেয়ের চেহারা সুরত সুন্দর হয়।

এতে ছেলেমেয়ের ততটা কৃতিত্ব নেই। বুদ্ধিটাও অনেকটা জিনবাহিত, ওতেও বা এত কৃতিত্ব কেন। বুদ্ধিটায় শান দিতে হয় জানি। শরীরেও শান দিয়ে অর্থাৎ প্রসাধন মেখে একে আরও সুন্দর করা হয়। মানুষ শুধু প্রয়োজনের কথাই ভাবেনি, নান্দনিকতার প্রতি আগ্রহও চিরকাল দেখিয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!