class="post-template-default single single-post postid-24459 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

অতিপ্রাকৃতিক সায়েন্স ফিকশন গল্প : পরীবিবির দোলনা

ধ্রুব নীল


ঘটনার কিছুটা কানে আসার পর জারা গোঁ ধরে, দাদির বাড়ি যেতেই হবে। কনকনে পৌষের শীতে জমজমাট রহস্য পেয়েছে। পরীবিবির বাড়িতে কদিন ধরে ভূতের উপদ্রব। পরীবিবি হলেন জারার দাদি। বয়স সত্তরের মতো।
নামের মতো বাড়িটাও রাজকীয়। জমিদারবাড়ির মতো খিলান, কুয়ো সবই আছে। পেছনে জঙ্গলের মতো। বাঁশঝাড়ের ফাঁকে একে অন্যের লেজ কামড়ে হেঁটে বেড়ায় শিয়ালের দল। বাড়িতে যারা থাকে তারা সরাসরি ভূত না দেখলেও ভৌতিক কাণ্ড ঘটতে দেখেছে। আর সেটাকে স্বাভাবিক বলে মেনেও নিয়েছে।
‘ভূত থাকবে না কেন? আমরা তো আছি, ভূত থাকলে দোষ কোথায়!’
জারার বাবার ভূত বাবদ আগ্রহ নেই। তিনি আমুদে লোক।
জারা ইনিয়ে বিনিয়ে দাদির কাছ থেকে ভূতের গল্পের আদিঅন্ত আদায় করে নিচ্ছে।
‘দোলনাটা আনছিল আমার আব্বা। আব্বার নাম জমিরুদ্দিন বাদশা। ১৩৫০ সনের কথা মনে হয়। ঠিক মনে নাই।’
‘কী বলো! এত আগে…।’
‘ওটা বাংলা সাল জারা।’ শুধরে দিয়ে গেলেন জারার বাবা। তিনি নিজে কোনোদিন তার নানাকে দেখেননি। পরীবিবি ছোট থাকতেই জমিরুদ্দিন মারা যান। লোকে বলে ওই দোলনার শোকেই নাকি তিনি বুক চেপে একদিন বিছানায় পড়ে গিয়েছিলেন।
‘দোলনার গায়ে মিস্ত্রি ডাইকা খোদাই কইরা আমার নাম লেখা হইল ‘পরীবিবির দোলনা’। কিন্তুক কী ঘটনা ক দিহি। আমি গিয়া বসলাম। আব্বায় দিল ধাক্কা। দোলনা নড়ে না। কী মুশকিল ক দিহি।’
‘এখন?’
‘সেই দোলনা গত আশ্বিন মাস থেইকে আচমকা দোল খাতি শুরু করিল।’
‘ইন্টারেস্টিং! ছাদের মরচে পড়া দোলনাটার কথা বলছো? ওটা এখন নিজে নিজে দুলছে?’

ছায়া এসে পড়ে
ছায়া এসে পড়ে

‘মরিচা তো আর একদিনে পড়ে নাই। সেই ষাইট বছর আইগের কথা। দেশ স্বাধীন হওনের দশ বছর আগে। আব্বায় কারিগর দিয়া বানাইল। ছাদে বসাইল। কী আচানক কাণ্ড। দোলনা দোলে না। এখন দোলে। আবার তুই গিয়া ধাক্কা দে, তহন আর দুলবে না।’
‘দোলনা তার নিজের মর্জিমতো দুলছে?’
ভূতের চেয়েও বড় রহস্য চেপে ধরল জারাকে। দোলনার এমন আচরণের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? বাড়ির ভেতর গোপন কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র আছে? যেটা দোলনাকে আটকে রেখেছে? নাকি দোলনাটা বিশেষ কোনো ধাতু… নাহ.. পেন্ডুলামের সূত্রের সঙ্গে ধাতুর বৈশিষ্ট্যের কোনও সম্পর্ক নেই..।’
জারা জানে তার দারুণ বুদ্ধি। তবে সেটা কাউকে বুঝতে দেয় না। ভূতে বিশ্বাস করে না ঠিকই। তবে অতিপ্রাকৃতিক কিছু থাকলে মন্দ কী!
পূর্ণিমার এখনও কয়েকদিন বাকি। চাঁদ আর তারার আলোয় মায়াময় হয়ে আছে ছাদ। গ্রামের রাত আটটা মানেই শিয়ালডাকা রাত। ছাদের একেবারে রেলিং ঘেঁষে মরিচা পড়া দোলনাটা স্থির পড়ে আছে। গা ছমছমে ভাবটা তাড়াল জারা। দোলনার কাছে গেল গুটি গুটি পায়ে। লোহার কাঠামোয় মরিচা পড়ে একাকার। উপরের দিকের জয়েন্ট দেখে মনে হচ্ছে ঘটনা যাই হোক, কোনোমতে হলেও দোল খাওয়ার কথা।

রক্তবন্দি
রক্তবন্দি

দোলনার একটা স্তম্ভের পাশে মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখল, ‘পরীবিবির দোল..’ পর্যন্ত লেখা। বাকি অক্ষরটা ক্ষয়ে গেছে। তবে সালটা পরিষ্কার আছে এখনও- ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ।
দোলনার সামনেই দাঁড়িয়ে জারা। পেছনে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছে না। এক পাশের শিকল ধরে টানল। একচুল নড়াতে পারল না। গায়ের জোরে টানল। লাভ হলো না। মরিচার কারণে লোহার ভারী দোলনা কোথায় আটকে গেছে হয়তো।
‘জারা ভাত খেতে আয়। না এলে আমি বোয়ালের মাথা খেয়ে ফেলবো।’
মুগডাল দিয়ে রান্না করা বোয়ালের মাথা জারার খুব প্রিয়। তবে রহস্যের গন্ধে এখন খিদে উধাও।
‘আসছি বাবা।’
দোলনায় হাত রাখতেই শিরশিরে অনুভূতি জেঁকে ধরল। বসার জায়গাটা আশ্চর্যরকম স্থির। তারপরও মনে হচ্ছে কেউ একজন বসে আছে। ধীরে ধীরে উল্টো দিকে ঘুরলো জারা। আচমকা পেছন থেকে এক হলকা বাতাস বয়ে গেল। উড়িয়ে দিল তার চুল। তারপর! ‘ক্যাঁচ.. ক্যাঁচ.. চিঁ…চিঁ।’
দুলে উঠছে দোলনাটা! একদম ছন্দে ছন্দে। ঠিক যেন কেউ দুলছে তাতে!
শীতের হিমহিম বাতাস আছে। কিন্তু এই বাতাসে লোহার ভারী দোলনা এত জোরে দোলার প্রশ্নই আসে না। যাবতীয় যুক্তি আর বিজ্ঞানকে পকেটে ভরে আপাতত নিচে ছুট লাগাল জারা। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ও।

সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ
সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ পাওয়া যাচ্ছে রকমারিতে

২.
ধুলাউড়ি গ্রামে শীতের কনকনে হাওয়ায় লেপমুড়ি দিয়ে বসে আছেন পরীবিবি। বাসায় কয়েকজন গ্রামের মধ্যবয়সী নারী আছে তার দেখাশোনার জন্য। দুঃসম্পর্কের কিছু আত্মীয়ও থাকেন। তারা একটু পর পর এসে জারা ও তার মাকে দেখে যাচ্ছে। পরীবিবির দোলনার গল্প তাদের মুখস্থ।
‘আব্বায় আমার কত কান্দন কানল। দোলনার মন গলে না। পৌষের শেষের দিকে আকাশে টকটকা চাঁদ। ওই দিন মনে হয় পূর্ণিমা। পষ্ট মনে আছে। আব্বায় আমারে কোলে নিয়া গেল ছাদে। কইল, পরী আম্মা দোলনায় বসো। আমি বিরক্ত হয়া গিয়া বসলাম। ঘুমে পইড়া যাই। আমি জানি, এই দোলনা ভূতের দোলনা। আব্বায় অনেক ঠেলা দিল। আমারে নামতেও দেয় না। পাগলের মতো ধাক্কাইতে থাকল। আধা ঘণ্টা গেল, এক ঘণ্টা গেল। বজ্জাত দোলনা দুলল না। আব্বায় পাগল পাগল হইয়া গেল। গ্রামের বড় পালোয়ান নিয়া আসছিল পরে। সেই পালোয়ানেরও সাধ্যি হইল না দোলানোর। তারপর বদ্যি কবিরাজ, পানি পড়া সবই হইল। লাভ হইল না। কেউ কইল, এটা জিনজাতির পছন্দ হইসে। তারা এইটাতে দোলে। কিন্তু আব্বা মানিল না। আব্বা কত যে কিছু করসে।’
জারা মনে মনে দৃশ্যগুলো কল্পনা করছিল। এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা ঘর। পর পর তিনবার। শব্দটা এসেছে ছাদ থেকেই। ঘরের সবাই চুপ। এমন সময় চলে গেল বিদ্যুৎ। জারা তার ফোনে টর্চ জ্বালিয়ে উঠতে যাবে, বাধা দিল মা। জারা ইশারায় বোঝাল সে চুপিসারে যাবে আর আসবে। পেছন পেছন মাও চলল।
ছাদের আরেক কোণে লাউয়ের মাচা করেছেন পরীবিবি। চাঁদের আলোয় লাউয়ের ডগা চকচক করছে। কিন্তু জারা ও তার মায়ের নজর দোলনায়। কিছুক্ষণ নিজে নিজে দুলে আবার ধীরে ধীরে থেমে গেল। এরপর অনেকক্ষণ সাড়াশব্দ নেই।
সে রাতে ঘুমাতেই পারল না জারা। ভয়ে নয়। ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগল তন্নতন্ন করে। সে জানে অন্যদের চেয়ে তার মাথা কিছুটা জোরেসোরে কাজ করে। আইনস্টাইনের অপেক্ষবাদ, স্ট্রিং থিওরি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব, সব তার নখের ডগায়। ক্লাস টেনে পড়লেও অনার্স মাস্টার্সের পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাস নিতে পারবে ও। কিন্তু ব্যাপাটার গোপন। কেউ জানে না। জানাজানি বিষয়টা পছন্দ না জারার।
রাত তিনটার দিকে উঠে মোমবাতি জ্বালাল। বিদ্যুৎ নেই। শুরু হলো কাগজে আঁকিবুঁকি। সাহস করে পা টিপে টিপে ছাদেও গেল। বাতাসে গাছের পাতা ঝিরি ঝিরি দুললেও দোলনাটা একেবারে স্ট্যাচু। জারা বুঝতে পারল তার বুদ্ধি বেশি বলে সাহসও বেশি। ব্যাপারটা ভয়ানকও। অতিপ্রাকৃতিক বিপদ ঘটতে পারে। তবু দোলনা ধরে টানাটানি করার লোভ সামলাতে পারল না জারা।
যথারীতি নাড়াতে ব্যর্থ হয়ে নেমে যেতে ধরবে, এমন সময় আবার সেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ। কেউ একজন ধাক্কা দিয়েছে হতচ্ছাড়া দোলনাটায়।
‘কে! কে! দোলনা দোলাচ্ছেন?’ বলতে গিয়ে গলা কাঁপল। তবু শব্দ করে আরো কয়েকবার ডাক দিল জারা।
নাহ। অদৃশ্য কেউ জবাব দিল না। দুলুনি থেমে গেল একটু পর। দ্রুত নেমে এলো জারা। কাগজ-কলম হিসাব নিকাশ শুরু হলো আবার।

৩.
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো। রাতের ঘটনা কাউকে বলেনি। তারপরও পুরো বাড়ি থমথমে। সবাই গোল হয়ে উঠোনে বসে আছে। তাদের টুকটাক কথাবার্তা কানে এলো জারার।
‘জিন ছাড়াইতে বনগ্রামের হুজুরকে খবর দেওয়া হইসে। উনার আসতে তিন দিন লাগবে। হাদিয়া দশ হাজার।’
‘শুনলাম এক দুই হাজারেই কাজ হয়।’
‘এখন আর সেই দিন আছে?’
জারা বুঝতে পারলো এর মধ্যে একটা কিছু ঘটেছে। বাবাকে খুঁজে পেল ছাদে। উনি গভীর মনযোগে দোলনার দিকে তাকিয়ে আছেন।
‘বুঝলি জারা, ঘটনা আসলেই বিরাট। ইলেকট্রিক ওয়্যারিংগুলোও চেক করলাম। কোনো ম্যাগনেট ফ্যাগনেটের কারবার নেই। দূর থেকে কেউ চুম্বক দিয়েও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এই সাউন্ডের সোর্স কী হতে পারে…।’
‘কীসের সাউন্ড?’
‘সকালে তুই তো বেঘোরে ঘুম। ভয়াবহ সব শব্দ হলো ছাদে। ভয়ে তো কয়েকজন বাড়ি ছেড়েও ভেগেছে। তোর মাও এখন বলছে তোর দাদিকে নিয়ে ভাগতে।’
‘অবশ্যই না। দোলনার একটা ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। ব্যাপারটা জটিল। তবে পরীক্ষা করে দেখা যায়।’
‘তোর মতো বুদ্ধিশুদ্ধি আমার নেই। তুই হলি আইনস্টাইনের নাতনি। না না, তারচেয়ে বড় কিছু। তুই হলি আমার মেয়ে!’
‘হি হি। বাবা আমার একটা বিশেষ ক্যালেন্ডার লাগবে। বাংলা পঞ্জিকা। শতবর্ষী কিছু ক্যালেন্ডার থাকে না? ওই রকম।’
‘জগা মাস্টারের লাইব্রেরিতে অবশ্যই থাকবে। তার ফোন নম্বরটা বের করি আগে।’


পরদিন দুপুর। ‘আব্বায় একদিন ঘোষণা দিল দোলনা ভাঙা হইব। বড় বড় হাতুড়ি বাটাল নিয়া আসা হইল। অনেক মিস্ত্রি আসল। কেউ ভাঙতে পারল না। কেই কইল এইটা সোলেমানি লোহা। একবার কিছু গড়া হইলে ভাঙা যায় না। আবার কেউ কইল জিনে ধরা দোলনা। জিনজাতি ভাঙতে দিব না। আব্বার খুব দুঃখ।’
‘আরেকটা দোলনা বসালেই তো পারতেন তিনি।’
‘আব্বার জেদ তো তোরা দেখস নাই। খুব জেদ। সেই জেদেই তো মইরা গেল। ছাদে গিয়া দেখি বুকে হাত চাইপা…।’
এইটুকু বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন দাদি।


রাত সাতটা কি আটটা বাজে। পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে ক্যালেন্ডার দেখে দেখে নোট নিচ্ছে জারা। পূর্ণিমার দিনক্ষণও দেওয়া আছে তাতে। সেগুলোও লিখল। একটু পর পর বাইরে তাকাচ্ছে। চাঁদের অবস্থান দেখছে। আবার যাচ্ছে দাদির কাছে। এটা ওটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। পরীবিবি মাঝে মাঝে উত্তর দিচ্ছেন, মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলছেন।
এর মধ্যে আবার জগা মাস্টারকেও ফোন করলো, ‘স্যার আজ কি পূর্ণিমা?’
‘হ্যাঁ। তাই তো। তুমি কে গো মা?’
‘আমি ভূতবাড়ির নাতনি। হিহিহি।’
পরিচয় দেওয়ার সময় নেই জারার। ছুট লাগাল দাদির কাছে। বাড়ির সবার মধ্যে পালাই পালাই ভাব। এর মাঝে আবার দুয়েকবার ভৌতিক শব্দটা শুনেছে। জারার মা-ও তাগাদা দিচ্ছেন বারবার। জারার বাবা তার মাকে রাজি করাতে পারছেন না। কিন্তু জারার কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে ঈদ লেগেছে। একছুটে গেল আবার দাদির কাছে।
‘না, না। ওই দিন মনে হয় অমাবস্যা ছিল। পঞ্জিকা দেখা লাগব। পালোয়ান আসছিল আব্বা মারা যাওনের আগে। না না। অনেক আগে। তবে সেদিন রাইতে আব্বায় আমারে নিয়া গেল ছাদে।’
‘যেদিন তুমি অনেক রাত ছাদে দোলনায় বসে ছিল, তার আগের দিন সকালে কী ঘটেছিল মনে আছে?’
‘মিস্ত্রি আইসা দোলনা ভাঙনের চেষ্টা করছিল। আব্বায় অবশ্য পরে আর দেয় নাই। আমার নামে দোলনা। সেইটা ভাঙে কেমনে। ভূতে ধরা হইলেও হোক। পরে আর ভাঙতে দেয় নাই আব্বা।’
‘পরদিন রাতে ঠিক কয়টায় তুমি আর তোমার বাবা ছাদে গিয়েছিলে মনে আছে দাদিমা?’
‘ওই সময় তো ঘড়িটড়ি ছিল না। তবে আমি ঘুমাইতেসিলাম। মাথার উপরে চাঁদ…।’
‘এক মিনিট দাদি!’
ঘটাঘট মোবাইল চেপে জারা ফোন করল তার এক ভিনদেশি বন্ধুকে। ওই বন্ধুর অনেক ক্ষমতা। তার আবার আমেরিকার নাসায় যোগাযোগ আছে। মাঝে মধ্যে কিছু গোয়েন্দা কেইসের সমাধান চেয়ে সে জারাকে ফোন দেয়। এ কারণে জারাও মাঝে মাঝে এটা ওটা জানতে চায়। আপাতত বিষয়টা টপ সিক্রেট।
ইংরেজিতে হড়বড় করে কথা বলে গেল জারা। মিনিটখানেক পর মুখে হাসি ফুটল। দাদিকে বলল, তোমাকে তোমার বাবা ঘুম থেকে তুলে নিয়েছিলেন কারণ ওই দিন ছিল আকাশভরা পূর্ণিমা।
‘হ হ। সে কি চান্দের আলো। আমি ঘুমে ঢুইলা পড়তেসিলাম। আব্বায় আমারে কোলে তুইলা নিয়া দোলনায় বসাইল।’
‘চলো দাদি।’
‘কনে যাব?’
‘ছাদে যাবে চলো।’
‘এই শীতে।’
‘আজ আকাশভরা পূর্ণিমা নেই। তবে দিনক্ষণ ঠিক আছে। পূর্ণিমা তো আর মেপে মেপে হয় না।’
পরীবিবি চাদর জড়িয়ে উবু হয়ে এক পা এক পা করে সিঁড়ি ভেঙে উঠলেন ছাদে। আর কেউ নেই। চাঁদের আলোয় চকচক করছে দোলনার একাংশ। ঝিরি বাতাসে দুলছে লাউয়ের ডগা। পেছনের জঙ্গলে যেন কতকাল ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাঁশঝাড়টা।
‘আহারে! মইরচা পইড়া কী দশা!’
জারা সঙ্গে করে কুশনটা নিয়ে এসেছিল। বিছিয়ে দিল দোলনার আসনে।
‘বসে পড়ো দাদি।’
‘বইসা কী লাভ। এই মরার দোলনা তো দুলব না।’
‘আজ দুলবে দাদি। আজ দুলবে। আজ অনেকক্ষণ দুলবে।’
‘তুই কেমনে জানলিরে দাদু!’
‘আমি জানি। আমার অনেক বুদ্ধি দাদু। আমি অংক করে বের করেছি। তোমার মাথায় কিছু ঢুকবে না জানি। তবু তোমাকে বলি, এই দোলনা কোনো না কোনোভাবে একটা মেটাফিজিক্যাল কাঠামোর মধ্যে আটকা পড়ে আছে। এই দোলনার কাঠামোর ভেতর সময়ের গতি অস্বাভাবিক কমে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দোলনার ভেতর যে শক্তি প্রয়োগ করা হয় সেটাও ধীরগতিতে পার হচ্ছে। সেই গতিটা আনুমানিক পঞ্চান্ন বছরের মতো। শক্তির বলয়টা এই ধীরগতির সময় পার হয়ে যখন দোলনা ছেড়ে বের হয়, তখনই দোলনাটা নড়ে। দোলনাটা তখন তার মেটাফিজিক্যাল কাঠামোতে থাকে না। তারপর স্থির হতেই আবার স্থির সময়ের কাঠামোয় ঢুকে পড়ে।’
জারা নিজের মতো করে বকবক করেই যাচ্ছে। পরীবিবি যথারীতি একবর্ণও বুঝতে পারছেন না। তবে তিনি যেন হারিয়ে গেছেন অতীতে। ফ্রক পরা সেই ছোট্ট খুকি হয়ে বসে আছেন দোলনায়। আচমকা দুলে উঠতে শুরু করলো দোলনাটা। পেছন থেকে যে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে স্পষ্ট টের পেলেন। তাকালে কাউকে দেখতে পাবেন না জানেন, তবে ধাক্কার ছন্দ ও গতি দেখে পরীবিবির মন নিশ্চিত হয়ে গেল, পেছনে তারা আব্বা দাঁড়িয়ে আছে। দোলনা দুলছে। দুলছে তো দুলছেই। পরীবিবি ধরে ফেলেছেন মেটাফিজিক্সের জটিল ব্যাপারটা।
আব্বা আজ অনেকক্ষণ ধরেই দোলনাটা দোলাবে। দোল খাচ্ছেন পরীবিবি। চাঁদের আলোয় তার চোখের কোণে এক টুকরো অশ্রু চিকচিক করে উঠল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!