নেহা অনেকদিন পর যেন একটু শ্বাস ফেলে বাঁচলো।বিয়ের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে ওদের।অনিকের সাথে এখনো সহজ সম্পর্ক শুরু করতে পারেনি ও।স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক তো নয়ই।
এজন্য নেহা কৃতজ্ঞ অনিকের কাছে।আসলে বাবার কথাতেই নেহা বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে।
গল্প : ভালবাসায় ভাল না বাসায়, লিখেছেন: মিমোসা মওলা নুপুর
অনিক;নেহার বাবার বন্ধুর ছেলে।নেহার বাবা নাকি অনেক আগেই বিদেশে থাকা অনিকের সাথে নেহার বিয়ের পাকা কথা বলে রেখেছিল।অনিকের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেশ তড়িঘড়ি করেই ওদের বিয়েটা হয়ে যায়।আর বিদেশে ফিরে যায় নি অনিক।বাবার এতদিনের ইচ্ছে টা পূরণ করেছে সে।
ওর বাবার ইচ্ছে ছিল,তাদের একমাত্র ছেলে যেন তাদের পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেয়।তাই দিয়েছে অনিক।কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা চাপা অসন্তোষ রয়ে গেছে ওর।ডেনমার্ক এ খুব ভাল একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলেছিল ও।এখন এভাবে সব ছেড়েছুড়ে ওর কাছে কেমন যেন অসহায় লাগছে।তার উপর বিয়ের রাতেই নেহা জানিয়ে দিয়েছে,এই বিয়েটা সে তার নিজের ইচ্ছেমত করেনি।যদিও এর কোন কারণ জানায়নি নেহা।আর অনিক ও কিছু জানতে চায়নি।মূলত ওদের সম্পর্কের ভেতর একটা শীতলতা দেখতে পেয়েই হুট করে কক্সবাজারে এক সপ্তাহের জন্য পাঠিয়ে দেন অনিকের বাবা।এটাই তাদের বিয়ের পর প্রথম বার বাইরে আসা।তাই একে হানিমুন ট্যুর বলাই যায়।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে সমুদ্রের কাছে একা চলে এলো নেহা।গতকাল রাতেই তারা এখানে এসেছে।
আগে থেক বুকিং দেয়া সিংগেল বেডের রুম টা চেঞ্জ করে ডাবল বেডের রুম নিয়েছে অনিক।নেহা ভোরে উঠে দেখলো, তখন ও অনিক গভীর ঘুমে।ঘুমন্ত মুখ টার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো নেহা।অনিক কে এককথায় বেশ হ্যান্ডসাম ই বলা যায়।টল,ডার্ক বলতে যা বোঝায় অনিক প্রায় সেরকমই। মানুষ হিসাবেও যথেষ্ট ভাল মনের।কিন্তু নেহা কে এসব কিছুই তেমনভাবে আকৃষ্ট করে না।আর করবেই বা কি ভাবে!ওর মন জুড়ে শুধু আরেক জনের ছবি।নেহা মনে মনে ভাবলো,এখন কি করছে রায়হান!সেদিন যখন নেহা রেস্টুরেন্ট থেকে চলে যাচ্ছিল রায়হান একবারও পিছু ডাকেনি।একটা কথার ও উত্তর দেয় নি।নেহা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার খবর।এও বলছিল যে,ও অনেক চেষ্টা করেছে বাবাকে বোঝানোর।কিন্তু কোন লাভ হয়নি।আর নেহা ওর বাবার অমতে রায়হান কে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না।এসব ভাবতে ভাবতেই হোটেল থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের কাছে এসে দাড়ালো নেহা।
সোমা জীবনে এই প্রথম সমুদ্র দেখছে।ওর দুই চোখে অপার বিস্ময়। মাত্র সাতদিন আগে বিয়ে হয়েছে ওর।সোমা মফস্বলের মেয়ে।মা বাবা অনেক আগে একটা এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর মামা মামীর কাছে মানুষ হয়েছে ও।হুট করেই এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এই বিয়ের প্রস্তাব আসে।আর সোমার মামা মামীও ভাগ্নি কে যথেষ্ট আয়োজন করেই বিয়ে দিয়ে দেন।এরপর ঢাকায় চলে আসে ও,বরের সাথে।এই সাতটা দিনে সোমার জীবন টা আমূল পালটে গেছে যেন।সোমা ওর নতুন জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করে।ওর মত একটা সাধারণ মেয়ে এক জীবনে এত সুখ পাবে কখনো ভাবে নি।ও সমুদ্র দেখে ছেলেমানুষের মত লাফাতে থাকে।বরের হাত ধরে যখন সমুদ্রে পা ভিজিয়ে দাঁড়ায়,ওর মুখে হাসি অথচ চোখের কোণে জল।যখন ঢেউ টা ফিরে যাবার সময় ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এরকম মনে হয়,ও ভয়ে বর কে জড়িয়ে ধরে।
ওর বর ওর প্রতি মমতায় আদ্র হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।এটা ঠিক প্রেম ভালবাসার মত কিছু না হয়ত।তবে সোমার সারল্য,সোমার ছেলেমানুষি এসব দেখে ওর বর আস্তে আস্তে যেন মেয়েটার প্রতি একটা মমতা বোধ করছে।এই তো এই সাত সকালেই সোমার আব্দারে চলে এসেছে সমুদ্রের কাছে।ওরাও গতকাল রাতেই এখানে এসেছে।যখন বুকে জড়িয়ে রয়েছে বউ কে,একটু দূরে একটা চেনা মানুষের ছায়া দেখে চমকে উঠলো যেন সে।কে ও?ভুল দেখছে না তো।নাহ,অই তো স্পষ্ট বুঝতে পারছে।হ্যা,নেহা।একা একা উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের সামনে।কাকে ভাবছে নেহা?
সোমা কে বুকে আগলে রেখেও একটা অদ্ভুত কষ্টে বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো রায়হানের। এভাবে এখানে নেহা কে দেখতে পাবে সেটা ও স্বপ্নেও ভাবেনি।
অনিক ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলেই দেখলো ঘরে কেউ নেই।ও বুঝলো,নেহা হয়তো সমুদ্রের কাছেই গেছে।ও আস্তে আস্তে উঠে ফ্রেশ হয়ে রুম লক করে বেরিয়ে এলো।সমুদ্রের কাছাকাছি এসে নেহাকে দেখার আগেই রায়হানকে দেখে বিশাল চিতকার দিয়ে উঠলো অনিক।নটরডেম কলেজের সবচেয়ে কাছের বন্ধু রায়হান।অনিক ইন্টারমিডিয়েটের পর ই দেশের বাইরে চলে যায়।এরপর আর সেভাবে যোগাযোগ ছিল না।
ফেসবুকে মাঝেসাঝে হাই হ্যালো হতো।রায়হান ও এখানে একসাথে সব পরিচিত মানুষদের দেখে বিস্ময়ে চুপ হয়ে গেল।তখন ও দূরে দাঁড়িয়ে নেহা।পেছনের এতসব কান্ড সে খেয়াল ই করেনি।রায়হান আর অনিক দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো।আর সোমা তখন খিলখিল করে হাসছে।রায়হান পরিচয় করিয়ে দিলো সোমার সাথে।বললো–এই যে অনিক,আমার বউ।মাত্র কয়েকদিন আগেই এই মেয়েটা আমার ঘাড়ে ভর করেছে।তোর খবর কি বল?কবে এলি দেশে?অনিক তখন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নেহা কে দেখতে পেয়েছে।কিন্তু নেহা কে ডাকলো না অনিক।ও আসলে বুঝতে পারছিল না,যে এভাবে এখানে ওর বন্ধুর সাথে হুট করে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে নেহা ব্যপারটা ঠিক কি ভাবে নেবে!যদি বিরক্তবোধ করে।
তাই ও রায়হানের দিকে ফিরে তাকালো।বললো–আমি তো প্রায় আট মাস হলো দেশে।আসলে এসেই এতকিছু একসাথে লাইফে ঘটে গেল,বন্ধু বান্ধবদের সাথে যোগাযোগই করতে পারি নি।যাক,তোকে এখানে পেয়ে খুব ভাল লাগছে।ওরা ওখানেই কথা বলছিল।সোমা দুই বন্ধুকে ওখানে রেখেই একটু এগিয়ে গেল।হাটতে হাটতে গিয়ে দাড়ালো নেহার ঠিক পাশেই।নেহা এতক্ষণ যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল।
চারদিকের কিচ্ছু খেয়াল করেনি এতক্ষণ। হঠাৎ পাশে অচেনা মেয়েটা কে দেখে একটু চমকে উঠলো। সেটা টের পেয়েই সোমা এক গাল হেসে বললো–আপু,বিরক্ত করলাম?সোমা আসলে এরকমই।মফস্বলে বড় হয়েছে বলেই হয়তো ওর ভেতর একটা সরলতা সবসময় রয়ে যায়।নতুন কারো সাথে কথা বলতে শহুরে মানুষ যেভাবে ভাবে,ইতস্তত করে সেসব নেই সোমার।নেহা মাথা নাড়লো।
বললো–না,ঠিক আছে।সোমা এবার মাথা নেড়ে নেড়ে কথা শুরু করলো–আমি এই প্রথম সাগর দেখতে আসছি।আমার স্বামী নিয়ে আসছে।আমার বিয়ে হইছে আজকে আট দিন।নেহা মনে মনে হাসছে এভাবে সোমার গল্প বলার ভংগি দেখে।মনে হচ্ছে,সোমা ওর কত দিনের পরিচিত।এবার সোমা বলছে–অই যে আপু,আমার বর।দ্যাখেন এখানে এসে এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেছে।দুই বন্ধুর মাঝখানে আমি আর কি করবো?তাই তো এখানে আপনাকে দেখে গল্প করতে এলাম।নেহা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো।তাকিয়েই রইলো।ওদিকে রায়হান ও তখন ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে।একদিকে অনিক রায়হানের সাথে কথা বলে যাচ্ছে আর একদিকে সোমা নেহার সাথে।কিন্তু যাদের সাথে ওরা কথা বলছে তারা দুইজন তখন যেন কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না।শুধু ভাষাহীন ভাবে একজন আরেকজনকে দেখছে।
হোটেলে ফিরে সোমা কথা বলেই যাচ্ছে।রায়হান হ্যা হুম করে উত্তর দিচ্ছে।ওর বারবার মনে হচ্ছে,এখানে না এলেই বোধহয় ভাল হতো।যাকে ভুলতে চাচ্ছে মনে প্রাণে তার সাথেই এখানে দেখা হয়ে গেল!তারচেয়েও অবাক ব্যপার ওর একসময়ের বন্ধু অনিকের বউ এখন নেহা।এত্ত কো ইনসিডেন্ট ওর জীবনেই ঘটতে হলো!সেদিন ওভাবে নেহা ওকে ফিরিয়ে দেয়ায় ওর পুরো জীবন টাই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।বলা যায় সেই এলোমেলো জীবন গোছাতেই হুট করেই বিয়ে টা করে ও।সোমা কে নিয়ে বেশ তো ভাল ই ছিল।হ্যা,সোমা হয়তো এসময়ের অনেক মেয়ের তুলনায় অনেক কম স্মার্ট, অনেক বেশি সহজ সরল।
নেহার তুলনায় রুপে গুণে একদম ই সাধারণ। কিন্তু কই?এই কদিনেই তো সোমা কে ও বেশ আপন করে নিয়েছে।মাঝেমাঝে এও ভেবেছে,যে এরকম একটা ঘরোয়া মিষ্টি মেয়ে ওর জীবনে পেয়ে রায়হান তার আগের সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলবে ধীরে ধীরে।কিন্তু এরকম একটা জীবনের পর্যায়ে এসে কেন নেহার সাথে দেখা হলো!অবশ্য বেশিক্ষণ নেহা কে নিয়ে ভাবতে পারলো না রায়হান।ওর বকবক করা বউয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো সে।সোমার ঠোঁটে আঙুল রেখে বললো–এই যে পাগলি,এইবার একটু চুপ করা যায়!?সোমা কে বিয়ের পর থেকে এই নামেই ডাকে রায়হান।সোমা লজ্জায় রায়হানের বুকে মুখ লুকোলো।
এদিকে অনিক আর নেহা ডিনার শেষ করে যখন নিজেদের রুমে ফিরছিল,কি ভেবে যেন অনিক বললো–চলো,একটু হেটে আসি।যাবে?ওদের হোটেলের খুব কাছেই সী বিচ।রাজী হলো নেহা।ওর মনের ভেতর সেই সকাল থেকেই যেন কালবৈশাখী ঝড় চলছে।রায়হানকে ও এখনো ভালবাসে।আর সেজন্যই অনিকের সাথে একটা মিথ্যে বিয়ের সম্পর্ক বয়ে চলেছে।এদিকে রায়হান আর সোমাকে এক সাথে দেখেই ও বুঝে গেছে,যে ওদের দাম্পত্য টা সত্যিকারের। ওদের দেখলেই বোঝা যায়,ওরা বেশ সুখি।না,কোন হিংসা বোধ করেনি নেহা।বরং হয়তো খুশি ই হয়েছে রায়হানকে সুখি দেখে।
ওর ভেতরের যে অপরাধবোধ টা ছিল,সেটা একটু কমেছে এখন।ওরা এক সাথে যখন সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছলো, তখন আকাশে এত্ত বড় একটা চাঁদ উঠেছে।বোধহয় দুই একদিন পরেই পূর্নিমা।কি মনে করে পাশে দাঁড়ানো মানুষটার হাত ধরলো নেহা।খুব অবাক হলেও হাতে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো অনিক।মনে মনে বললো–হয়তো এতদিন পর তোমাকে আজ সত্যিই পাশে পেলাম,কাছে পেলাম।ওর কাধে মাথা ঠেকিয়ে টপটপ করে চোখের পানি ফেলছিল নেহা।যেন মনেমনে বলা অনিকের কথাগুলি বুঝতে পেরেই মৃদুগলায় বললো–আজকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে,না?আজ কিন্তু আমি একা ঘুমাতে পারবো না।অনিক এবার এক হাতে আগলে রাখা নেহার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো–আমিও আর তোমাকে একা ঘুমোতে দেবোই না।একা কি?ঘুমোতেই দেবো না!খিলখিল করে হাসতে হাসতে অনিকের বুকে কপট কিল দিতে শুরু করলো নেহা!!