[একটি সবিনয় নিবেদন: আমাদের আয় নেই বলে লেখকদের আমরা খুব একটা সম্মানি দিতে পারি না। তবে লেখকরা লেখা থামান না। তারা লিখছেন। তাই পাঠকদের কাছে অনুরোধ, গল্প বা লেখা ভালো লেগে থাকলে লেখকের জন্য একটা নামমাত্র সম্মানি দিতে পারেন। সম্মানি আমাদের “নগদ” একাউন্টে পাঠাতে পারেন: নম্বর 01407-885500]
সাইদুর রহমান ইদানীং বেশ ভুলে যাচ্ছেন। চায়ে যে চিনি নেই, সেটা টের পেলেন কাপ অর্ধেক খালি হওয়ার পর। কলেজের কাজে ছোটাছুটি করতে হয় বেশি। তবু মনে হয় সারাক্ষণ মাথাটা ঝিম মেরে আছে। কোনো কাজই করছেন না।
‘…এই ধরেন স্যার চল্লিশ পাঁচচল্লিশ বছর হইবো।’
‘হ্যাঁ? কী..?’
‘আপনে স্যার কথাই শোনেন নাই।’
‘না না.. তুমি একটা লোকের কথা বলছিলে। গ্রামের। কী যেন নাম.. আবদুল মতিন। হ্যাঁ.. লোকটা মারা গিয়েছিল।’
‘স্যার আপনি শোনেন নাই। লোকটার নাম নুরুল বেপারি।’
‘ইদানীং কিছু মনে টনে থাকে না। এক কাজ করো। গোড়া থেকে ধরিয়ে দাও।’
‘স্যার, চাইর মাসের আগের কথা। লোকটা মারা গেছিল। তারপর তিন দিন না যাইতে আবার জিন্দা হয়া ফেরত আসছে।’
‘বুঝলাম। তারপর?’
দপ্তরি মালেক চুপ মেরে গেল। এক টানে চায়ের কাপ খালি করে উঠে দাঁড়াল। বিজ্ঞানের শিক্ষক সাইদুর রহমানের সঙ্গে তার খাতির ভাল। তাকে নিয়ে চা-টা খায়। গল্পগুজব করে। মালেকের আজ মনে হলো সাইদুর রহমানের মাথা আসলেই কাজ করছে না। এভাবে চললে একদিন স্কুল কমিটি হাতে চিঠি ধরিয়ে বলবে, এবার যান। রাস্তা মাপেন।
‘আমি রাস্তা মাপবো কেন? রাস্তা মাপবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের লোকজন। ছোট করে যাকে সওজ বলে।’
মালেক থতমত খেয়ে গেল। সাইদুর রহমানের এই গুণ তার মনে ধরেছে। মনের কথা ধরে ফেলেন। এ কারণে তার সঙ্গে অন্য শিক্ষকরা মেশে কম। তবে মালেক মেশে। কারণ সে জানে তার মন পরিষ্কার। মাঝে মাঝে একটু উল্টাপাল্টা..।
‘ভয় নাই মালেক। আমি মনটন পড়তে পারি না। মাঝে মাঝে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ি। ইদানীং সুগারটা বেড়েছে মনে হয়। ঝিমানি লাগে।’
‘তাইলে আপনে চলেন আমার লগে। আমার বাড়িতে গেলেই দেখবেন মন ফ্রেশ। অনেক গল্প পাইবেন। লেইখা শেষ করতে পারবেন না।’
সাইদুর রহমান খুশি হলেন। স্কুলে একমাত্র মালেকই মনে হয় তাকে লেখক হিসেবে মানে। আজকাল তো কেউ বইটই পড়ে না।
‘ঠিকাছে। কবে যাবে বলো। ছুটি নিয়ে রাখি।’ বলেই সাইদুর রহমান হাসলেন। কারণ তিনি জানেন মালেক তাকে তার বাড়ি নিয়ে যাবে না। বাড়িতে নিয়ে যাওয়া মানে বাড়তি ঝামেলা, বাড়তি খরচ। মালেকের মন পড়ে ফেলেছেন তিনি।
যথারীতি একাই রওনা দিলেন আনন্দপুর ডিগ্রি কলেজের প্রবীণ বিজ্ঞান শিক্ষক সাইদুর রহমান।
গ্রামের নাম চিতলপুর। একসময় হয়তো চিতল মাছ পাওয়া যেত খুব। এ গ্রামে আগেও এসেছেন সাইদুর। তার নিজের গ্রামের চেয়েও কেন জাানি চিতলপুর তাকে বেশি টানে। গ্রামের পাশে নদী। দুনিয়ার সব শুকিয়ে গেলেও চিতলপুর নদীর থই পাওয়া যায় না। খালবিল, ধানক্ষেত, বক, বন-জঙ্গল, ধুরন্ধর লোকজন সবই আছে। এখন নতুন করে যোগ হয়েছে রহস্য। কবর থেকে মরা মানুষ জিন্দা হয়ে বের হয়ে এসেছে।
‘নুরুল বেপারি দোকানদার ছিল। এখন কিছু করে না। মরা মানুষ বাঁইচা আসছে, এটাই বড় কথা। দোকানদারি কইরা কী করবো।’
‘তা ঠিক। বেঁচে থাকাই পরম বিস্ময়। দোকানদারি তো সবাই করে।’
‘হে হে। তা উঠসেন কার বাড়ি?’
‘কারো বাড়ি উঠিনি হারুমাঝি। কোথায় যাই বলো তো। গ্রামে তো হোটেল ফোটেল পাওয়া যাবে না।’
‘আমার বাড়িত চলেন। দিনে একশ টেকা দিবেন, সব ব্যবস্থা হইবো। চা-পান বিড়ি সব পাইবেন।’
‘বল কি! মাত্র এক শ।’
হারুমাঝির বয়স চল্লিশের মতো। স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নাই। বাচ্চা হয়নি। সাইদুর রহমানকে দেখে লম্বা করে সালাম দিল হুরে জান্নাত। হারুমাঝি রূপবতী স্ত্রী পেয়েছে। টেনে ঘোমটা পরে। সম্ভবত কাউকে নিজের রূপ দেখাতে চায় না। গ্রামে সুন্দরী মেয়েদের পদে পদে বিপদ।
‘স্যার, আপনে ভিতরের ওই ঘরটায় থাকবেন। যেকোনো সমস্যা হইলে জান্নাত বইলা চিক্কুর দিবেন। বান্দি হাজির।’
‘এই নাও পাঁচশ টাকা। অ্যাডভান্স করলাম।’
‘স্যার, হে হে।’
গ্রামের লোকজন সহজে থ্যাংকু বা ধন্যবাদ বলে না। তবে হাসিতে সেটা উপচে পড়ে। সাইদুর রহমান উপচেপড়া হাসিটা দেখলেন চোখ বড় বড় করে। হারুমাঝি বিব্রত ভাবখানা নিয়ে চলে গেল বাজার করতে।
দুপুরের খাওয়া দেখে চোখ তালুতে উঠে গেল সাইদুর রহমানের। এক শ টাকায় এতকিছু পোষাবে কী করে কে জানে। পাবদা মাছের ঝোল, মুরগি, ভর্তা, শাক।
‘এত রান্না করলে কখন?’
‘আমার আর কাম কী। সারাদিন রান্দন।’
‘তোমার আরো অনেক কাজ। ঘর ঝাড়ু, গরুকে খাওয়ায়। এসব করতে গেলে তো আমি মরেই যেতাম। দশটা খাতা দেখলেই ঘুম পায়। তা তুমি করে বললাম, মাস্টার মানুষ তো, সবাইরে তুমি করে বলার অভ্যাস।’
‘আমারে তুই কইরা বললেই কী।’
সাইদুর রহমান দীর্ঘদিন কাউকে তুই করে বলেছেন কিনা মনে পড়ে না।
‘আপনে আসছেন নুরুল বেপারির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে? মরা মাইনসের লগে কীসের এত বাতচিত।’
‘সে তো মরে নাই।’
‘কব্বর থেইকা আসলে মরাই হয়। জিন্দার মতো ঘুরলেই জিন্দা হয় না। এই যে আমি, আমি কি জিন্দা?’
সাইদুর রহমান হুরে জান্নাতের চোখের গভীরে তাকালেন। মন পড়তে পারলেন না অন্য সবার মতো। তবে পূলক বোধ করলেন। কথাগুলো মনে ধরেছে।
খাওয়া শেষে ছোট খুপড়ি ঘরটায় বিশ্রাম নিলেন। ভেবেছিলেন খানিকটা গা এলিয়ে নেবেন। কিন্তু শক্ত পাটির বিছানায় শুতেই ঘুম। এমন ঘুম সাতজন্মে ঘুমাননি।
সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান শুনে ঘুম ভাঙতেই হা করে তাকিয়ে থাকেন সাইদুর রহমান। হুট করে মনে পড়ছিল না কোথায় আছেন। সামনে মুখে জোর করে হাসি এনে দাঁড়িয়ে আছে হারুমাঝি। হাতের পিরিচে চায়ের কাপ। সাইদুর ধরে ফেললেন হারু মনে মনে মহাবিরক্ত। কিঞ্চিৎ আতঙ্কিতও। কে জানে কেন।
‘স্যার। ওই বেটা আসছে।’
‘কে নুরুল?’
‘হ জিন্দা লাশ। যখন বাঁইচা ছিল, তখন নুরুল ডাকতাম। এখন সব্বাই জিন্দা লাশ বইলা যানে।’
‘জিন্দা লাশ কেন এসেছে?’
‘আপনি না দেখা করতে চাইলেন?’
‘আমি আবার কখন দেখা করতে..। আচ্ছা.. কে জানে হয়তো বলেছি। ঠিকাছে বের হচ্ছি।’
উঠানে মাথা নিচু করে একটা লোক বসে আছে। গায়ের রং কুচকুচে কালো। বাংলাদেশে এত কালো লোক সাধারণত দেখা যায় না। লোকটা মাথা তুলে তাকাতেই পিলে চমকে গেল সাইদুরের। কেন চমকে গেল সেটা ধরতে পারেননি। চেহারাটা কেমন যেন মায়াময়। চোখ দুটো কাজল কালো। টলটল করছে পানি। এমন মায়াবী চোখ মধ্যবয়সী পুরুষের চোখে মানায় না।
‘আপনি নুরুল বেপারি?
‘জ্বি স্যার! আমারে তুমি কইরা বলেন। তুই তোকারিও করতে পারেন।’
‘ফাইজলামি করবা না!’ ধমকে উঠল হারুমাঝি।
নুরুল বেপারির চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে মহা আনন্দে আছে। কবর থেকে বেঁচেবর্তে ফেরাটা আনন্দের বটে।
সাইদুর একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন নুরুল বেপারির দিকে। মন পড়ার চেষ্টা করছেন। একটা অন্ধকার পর্দা দেখতে পাচ্ছেন শুধু। মানুষটার মনে যেন কোনো কথা নাই। হয়তো আছে। গভীরের কথা। সাইদুর রহমান সেটা পড়তে পারছেন না।
হারুমাঝি দূরত্ব বজায় রেখে আছে। কাছে ঘেঁষেছে না। ঘোমটা মাথায় হুরে জান্নাত এলো। হাতে ট্রে। চা, বিস্কিট আর নুডলস। একটা চেয়ার টেনে বসলেন সাইদুর। হুরে জান্নাত আগে চা-বিস্কিট দিল নুরুলকে। সাইদুর মন পড়ে ফেললেন জান্নাতের। নুরুল বেপারির প্রতি তার একটা অন্যরকম মায়া টের পেলেন। মায়ার উৎস অপরিচিত। নুরুল আলম বিষয়টা খেয়াল করলো না।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গিয়েও পারছেন না সাইদুর। অনেক ভেবেও কীভাবে কথা শুরু করবেন তা বুঝতে পারলেন না। তাকে বাঁচিয়ে দিল নুরুল বেপারি।
‘স্যার মনে হয় আমার গল্পটা শুনছেন।’
‘না শুনিনি। গল্পটা তোমার মুখেই শুনতেই চাই প্রথমে। মানুষের শোনা কথায় অনেক বাড় বাড়ন্ত থাকে।’
‘জ্বি স্যার। কথা সত্য। তবে আমার ঘটনা সিম্পল। আমি পানিতে পইড়া গেছিলাম। বলতে পারেন মইরা গেছিলাম।’
‘কিভাবে পড়েছিল?’
‘সত্যি কথা হইল স্যার, আমার মনে নাই। পড়সি এটা মনে আছে। ভরা পানি। না নদী না পুকুর ঠাহর নাই। মাঝ দরিয়া। সেকি ঢেউ! পানি গিলতে গিলতে একসময় হুঁস গেলগা। আচানক ব্যাপার, ঠিক মরার টাইমে আমি কোনো ব্যাথা বেদনা টের পাই না। মরণ জিনিসটারে হুদাই এতদিন ডরাইসি। মরার টাইমে আপনে ব্যথা বেদনা পাইবেন না গ্যারান্টি দিলাম। তার একটু আগে পাইবেন।’
‘এটা আমি জানি। ধর্মগ্রন্থে পড়েছি। মৃত্যু জিনিসটা হলো মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায়। সে যাক, তারপর?’
‘তারপর আমার কিছু মনে নাই। সব আন্ধার। হুঁস ফিরসে যখন, তখন দেখি আমি কাফন পইরা মাটিতে শোয়া, চাইরপাশে লোকজন তামশা দেখতেসে। আমার ভাই মোসাদ্দেক ছিল। ও এক দৌড়ে পলাইলো। আমারে দেইখা ডরাইসে।’
‘মোসাদ্দেক পালাল কেন?’
‘কারণ সে আমারে স্বপ্নে দেখছিল। আমি নাকি তারে স্বপ্নে দেখাইসে, মোসাদ্দেক ও মোসাদ্দেকরে.. ভাই আমার.. আমি মরি নাই.. আমারে কব্বর থেইকা তুল।’
মোসাদ্দেক পরে হুজুরগো লগে আলাপ করে। কেউ রাজি ছিল না। পয়সাপাতি খরচা কইরা লোকজন দিয়া সে আমার কবর খোঁড়ায়। আমি বাঁইচা উঠি। আর হ্যায় দিল দৌড়। গেরামে আর আসেই নাই। আচানক ব্যাপার স্যার, আমার শইলে পঁচন ধরে নাই। তবে মাইট্টা একটা গন্ধ চইলা আসছে। এই যে দেখেন স্যার।’
নুরুল বেপারি তার গায়ের গন্ধ শোঁকানোর জন্য সাইদুরের দিকে এগিয়ে আসছিল। সাইদুর ভড়কে না গিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার গন্ধ শুঁকে দেখলেন। মাটি না ঘামের তা বুঝতে পারলেন না। তেড়ে এলো হারুমাঝি। ‘যা! যা! সর! স্যারের সামনে আবি না!’
‘কেন! ও সামনে আসবে না কেন!’
‘স্যার ও একটা পিচাশ। পিচাশরাই কবর থেকে উইঠা আসে। আপনি কাছে গেলে আপনার অনিষ্ট হইব।’
‘স্যার আমি একটা মশা মাছিও মারতে পারি না। কিছুই করতে পারি না। লোকজন কাজকাম দেয় না। সবাই খালি দেখতে আসে। খাওন দাওনও পাই না।’
‘তা মরার আগে, মানে কবরে যাওয়ার আগে কী করতে?’
উত্তরটা দিল হারুমাঝি। ‘কী আর করতো! আমার লগে কাম করতো। মাছ ধরতো। বাসায় থাকত।’
‘এখন থাকে না?’
‘পিচাইশশারে ঘরে জায়গা দিমু কেলা। কথা শেষ। এখন ভাগ। নইলে মাইরা ভর্তা বানামু।’
নুরুল বেপারি নির্বাকার। চায়ে বিস্কিট চোবাতে গিয়ে বিস্কিটটা পড়ে গেছে। চামচ এনে দিল হুরে জান্নাত। সাইদুর রহমানের মনে বিচিত্র সব জিনিস ধরা পড়ছে। হুরে জান্নাতের মনে নুরুল বেপারির জন্য একটা মায়া আছে। শক্ত মায়া। এ মায়ার উৎস কী? জীবিত ফিরে এসেছে তাই? নাকি অন্য কিছু?
রাত হলেও গ্রামের নিশুতি রাত নয়। সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সাইদুর রহমানের চোখ উপচে ঘুম। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে আজ রাত তার ঘুম হবে না। আজ না ঘুমানোর রাত। আকাশে বিশাল একটা চাঁদ। রাত এগারোটা বাজতেই জানালার কাছেই ধুপধাপ শব্দ। একটু পর কপাটিতে মৃদু টোকা।
‘কে!’
‘স্যার আমি, জিন্দা লাশ নুরুল।’
ইচ্ছা করে নিজেকে জিন্দা লাশ বলল কেন নুরুল? ভয় দেখাতে?’
‘জিন্দা লাশ তো কবরে গিয়া শুয়ে থাকো। এখানে এত রাতে কী।’
‘স্যার বাইরে আসেন। আপনারে আমার পছন্দ হইসে। আপনার ভয়ডর কম। বাইরে ফকফকা জোসনা। আইজ আপনারে কবরের গফ শোনাবো। আপনার তো শুনতে মন চাইতেসে। আমি কেমনে কব্বরে গেলাম। কেমনে বাইর হইলাম। বিস্তর কাহিনী।’
‘বিস্তর কাহিনির কিছু নাই। অনেক সময় হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলেও মানুষ বেঁচে থাকে। এটা অহরহ ঘটে। পরে আবার জিন্দা হয়ে ফেরত আসে।’
‘কিন্তু স্যার আমি তিন দিন কব্বরে ছিলাম।’
‘তাও হতে পারে। তিন দিন খাবার পানি ছাড়া মানুষ বাঁচে। অক্সিজেন পেয়েছো হয়তো ফুটোফাটা দিয়ে।’
‘স্যার কী কইতাসেন কিসুই বুঝতাসি না। তিনদিন কব্বরের অন্ধকার। আমি মইরাই গেছিলাম। উল্টাপাল্টা বহুত কিসুই দেখসি। আপনি আমার লগে চলেন আপনারেও দেহাই।
বলেই চুপ করে গেল নুরুল বেপারি। যেন বলা উচিৎ হয়নি এমন কিছু বলে ফেলেছে।
‘আমাকে কী দেখাবে।’
‘নিশুতি রাইতে গেরামে বহুত আচানক ঘটনা ঘটে। চখে না দেখলে বিশ্বাস হইবো না। স্যার কি বাইর হইতে ডরাইতেসেছেন?’
সাইদুর রহমান কিছুটা ভয় পেয়েছিলেন। নুরুলের কথা শুনে রাগ হলো। নুরুলের মতো হ্যাংলা পাতলা লোককে তিনি এক হাতেই সাইজ করতে পারবেন। ভয় পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
চাদর গায়ে শীত মানছে না সাইদুর রহমানের। এদিকে নুরুল বেপারির গায়ে একটা ময়লা শার্ট আর ছেঁড়াফাটা প্যান্ট। সে নির্বিকার।
‘কব্বর থেইকা উঠার পর দেহি হারুমাঝি আবার সব জিনিসপত্র ফালাইয়া দিসে। একটা তেনাও রাখে নাই। হুরে জান্নাত কিছু জোগাড় কইরা দিসে। বাসায় জায়গা দিল না। বাইরে বাইরে থাকি, ঘুমাই। চুরি কইরা খাইদাই। হে হে অবশ্য আপনে তো মনের খবর রাখেন। আপনি ধরতে পারসেন। আমারে খাওন দিসে হুরে জান্নাত। তবে সব দিন পারে না। সে আমারে বড়ই পেয়ার করে।’
‘আর সেটা হারুমাঝি জেনে যায়? জেনে যাওয়ার পর তোমাকে সে মাঝনদীতে ফেলে দেয়?
চুপ করে গেল নুরুল বেপারি। এর উত্তর তার জানা নেই।
‘ঠিকাছে তোমাকে কাপড় কিনে দেব আমি।’
‘লাগব না স্যার। আমার শইলে শীত করে না। কব্বরের অভ্যাস। জিন্দা লাশের আবার জামাকাপড় কিসের। লাশের কাপড় হইল কাফন। স্যার কি কাফনের কথা শুইনা ডরাইলেন?’
‘তুমি কি আমাকে কোনো কারণে ভয় দেখাতে চাচ্ছো?’
নুরুল বেপারি হাসলো। এবারের হাসিটা নকল। নকল হাসি হাসার কারণ ধরতে পারলেন না সাইদুর।
গ্রামের ধানক্ষেত আর কয়েকটা আইল পের হয়েছে দুজন। সামনে চিতলপুরের নদীর। একপাশে পানি, আরেকপাশে ঝোপঝাড় জঙ্গল, খোলা মাঠ। সম্ভবত ওই দিকেই কোথাও কবর দেওয়া হয়েছিল নুরুল বেপারিকে। আকাশ দেখলেন সাইদুর। চাঁদের আলো নিয়ে তার মধ্যে উথালপাতাল কোনো আবেগ কোনোকালেই ছিল না। তবে আজকের রাত আলাদা। আজ ফকফাক জোছনায় তিনি হাঁটছেন একটা জিন্দা লাশের সঙ্গে। লাশটা একটু পর তাকে নিজের কবর দেখাতে নিয়ে যাবে। খোঁড়া কবর। যেখানে কোনো লাশ রাখা নেই। জীবনানন্দের কবিতার দৃশ্যের মতো লাগছে বিষয়টা। সাইদুর বিজ্ঞান পড়ালেও জীবনানন্দের কবিতা তার প্রিয়।
‘কবরের কিছু নিয়ম কানুন আছে স্যার। গেরামের মুরুব্বিরা কয়। কেউ যখন কবর থেইকা জিন্দা বাইর হয়া আসে তখন সেই কবরে একটা কলাগাছ রাইখা দিতে হইত। মানুষ আসলে কবররে ডরায়। মনে করে খালি কবর রাখন ঠিক না। তাতে কবরের খিদা যায় না। একটা না একটা কিছু রাখতে হয়। আপনে কন স্যার, মানুষ আর কলাগাছ এক হইল?’
‘এখন কি তুমি কবরে কলাগাছ রাখতে যাবে?’
‘হে হে হে।’
নুরুল বেপারির হাসিটাই গা ছমছম করিয়ে দিল। তবে ছমছমে ভাবটা তীব্র ভয়ের আকার ধারণ করলো একটু পরেই। সামনে জ্বলজ্বলে চোখের কতগুলো প্রাণী।
‘ছেই! ছুহ! যা ভাগ!’ সাইদুর রহমানের গলা কাঁপছে।
‘ছেই কইয়া লাভ নাই স্যার। এগুলা কুত্তা না, শিয়াল। লাশের গন্ধ পাইয়া আসছে। আশেপাশে অনেক কবর তো? কবরে লাশ খাইতে আসে ওরা। আমার গন্ধ পাইয়াও আসতে পারে। হেরাও জাইনা গেসে আমি জিন্দা লাশ। তবে স্যার ডরাইয়েন না। বিষয়টা দেখতেসি। একটা শক্ত মোটা বাঁশ লাগবো। লাডি দিয়া হইবো না। বাঁশ দিয়া দুইটা বাড়ি মারলে সব ঠিক।
এরপর সাইদুর রহমান যা দেখলেন তা আগে জীবনেও দেখেন নাই। নুরুল বেপারি বাঁশ খুঁজে আনার আগেই শিয়ালগুলো একটা আরেকটার লেজ কামড়ে ধরে একটা লাইন বানাল। এরপর লাইন ধরে এগিয়ে চলল।
‘স্যার, হিয়াইললার কারবারই এইটা। লেঞ্জা ধইরা চলে।’
সাইদুর রহমানের ভয়টা কাটল না। ভয়ের একটা ফিনফিনে চাদর জেঁকে ধরেছে। যতক্ষণ এ জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করবেন ততক্ষণ চাদরটা পরে থাকতে হবে।
‘স্যার, চাইর-পাঁচটা হিয়াল-কুত্তারে ডরানোর কিছু নাই। ওরা দেখেন আমারে দেইখাই পলাইসে। যেন আমি একটা পিশাচ।’
সাইদুর খেয়াল করলেন লোকটা পিচাশ বলেনি, শুদ্ধ বাংলায় পিশাচ বলেছে। এটাও তাকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে একটা পাখি ঝাপটা মেরে উড়াল দিলেও তিনি ভয় পাবেন। হলোও তাই। গাছের কোটর থেকে একটা সাদা রঙের বড় পাখি ক্যাঁ ক্যাঁ করে উড়ে গেল। যেন বলল, কেন! কেন! সাইদুর ভাবলেন, তার হার্ট অ্যাটাক টাইপ কিছু হলে ভালো হতো। হার্ট নিয়ে ভাবা যেত। ডাক্তার-হাসপাতাল খুঁজতেন, কবর নয়।
‘এইটা হইলো স্যার কব্বর।’
নদী থেকে বেরিয়ে আসা চিকন একটা খাঁড়ি। তার পাশে একটা মানুষ সমান গর্ত। কবরটাই যেন একটা জ্বলজ্যান্ত অস্তিত্ব। অথচ একটা চারকোণা গর্ত ছাড়া কিছুই না।
‘এইখানে স্যার তিন দিন শোয়া ছিলাম। বুঝেন অবস্থা। আপনি কি একটু শুইয়া দেখতে চান স্যার?’
সাইদুর রহমানের হাত পা অসাড় লাগল। নুরুলের দিকে তাকালেন। তাকে আর জীবিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না। তার হাসিটা বহুকাল ধরে যেন মুখে লেপ্টে আছে।
‘কব্বরের নিয়মটার কথা মনে আছে না স্যার?’
‘হুম।’
‘আমার মনে হয় স্যার জন্মের ডর খাইসেন। হে হে। ডরের কিসু নাই। মরণরে ডরাইয়া লাভ আসে? মরণ তো আসবোই।’
সাইদুর রহমান নুরুল বেপারিকে অবাক করে দিয়ে এক লাফে কবরে নেমে গেলেন। একটা গর্তে লাফিয়ে নামার মধ্যে কোনো বীরত্ব থাকার কথা নয়। তবু নিজেকে অনেক সাহসী মনে হলো তার। কিন্তু এর পর কী করবেন বুঝতে পারছেন না। কবরে নেমেই মনে হলো ভুল হয়েছে। কবরটা বেশ উঁচু মনে হচ্ছে। পিছলা দেয়াল। বেয়ে আবার উপরে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় না। এদিকে চামড়ার স্যান্ডেলটা কাদামাটিতে মাখামাখি। সাইদুর তার স্যান্ডেল সামলাতে ব্যস্ত। জোছনার আলোয় কবরের তলায় এলোমেলো বিছিয়ে রাখা বাঁশের কঞ্চিগুলোও দেখতে পাচ্ছেন পরিষ্কার। পায়ে খোঁচা লেগে সামান্য কেটে গেছেও মনে হচ্ছে। উপরের দিকে তাকালেন। কেউ নেই। চারপাশে তাকালেন। নুরুল বেপারি উধাও! সাইদুর রহমান এবার আতঙ্কে সত্যি সত্যি হিম হয়ে গেলেন। কুঁকড়ে যেতে লাগল শরীরটা। শীতে তার গলার রগ কাঁপছে। নুরুলকে নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করেও পারলেন না। পেছন ফিরে তাকালেন। জ্বলজ্বলে চার জোড়া চোখ দেখতে পেলেন। একটার পেছনে আরেকটা। লেজ কামড়ে এগিয়ে আসছে ওরা। সাইদুরের দিকে তাকিয়ে আছে দারুণ লোভী দৃষ্টিতে। পায়ের নিচে বাঁশের কঞ্চি আছে। কিন্তু সেটা তোলার শক্তি পাচ্ছেন না সাইদুর। একে অপরের লেজ কামড়ে শিয়ালগুলো সাইদুর রহমানকে ঘিরে চক্কর খেতে লাগলো। অতিপ্রাকৃত ভয়ের কারণে সাইদুর খেয়াল করলেন না যে তার শরীরে চাঁদের আলো পড়ছে না। একটা অন্ধকার ছায়ামূর্তি হয়ে কবরে ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে লাগলেন তিনি।