রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি রাস্তার কথাই ধরি। রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের পাশের রাস্তা। স্কুল ঘেঁষা রাস্তাটির সব পাশের সারি সারি মেহগনি গাছ । চার পাশ মিলিয়ে শ পাঁচেক গাছ হবে। একেক গাছে কয়েকশ করে ফল। ফলগুলো পাখিও খায় না। টুপটাপ রাস্তায় পড়ছে। পথচারীরাও ভড়কে উঠে ভাবছেন, সেরেছে! যদি মাথায় পড়তো! কারও মাথায় পড়তে দেখা না গেলেও বিষাক্ত ফলগুলো কিন্তু ঠিকই রাস্তায় পড়ছে। ড্রেনের পানিতে মিশছে। মাটিতেও মিশছে। কমছে উর্বরা শক্তি।
কাঠ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না মেহগনি গাছ থেকে। সেই কাঠ কি আদৌ রফতানি হচ্ছে? ফার্নিচার বেচে রাস্তার আশপাশের লোকজন লাখ লাখ টাকার মালিক হচ্ছে? মোটেও না। বছরের পর বছর এভাবেই আমাদের বেকুব মানসিকতার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহগনিগুলো। ঠিক যেমনটা আছে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি।
ঢাকার রাস্তার দুই পাশে এমন মেহগনির সারি কিন্তু বিপদেরও কথা। একটু বাতাস হলেই কিন্তু ফলগুলো ছিটকে এসে পড়ছে। গাড়িতে থাকলে মাথা বাঁচবে। কিন্তু গাড়ির ঠিকই বারোটা বাজাচ্ছে। আবার কিছু স্কুলগুলোর সামনে ও আঙিনাতেও দেখা গেলো এ গাছ আছে। কোমলমতি শিশুদের মাথায় একটা ফল এসে পড়লে কী হবে একবার ভাবুন তো!
মেহগনির কাঠের অনেক দাম ও এর কাঠের মান ভালো, মানলাম। কিন্তু সেই ভালো মান বা দামের জন্য কিন্তু যত্রতত্র বা বিশেষ করে রাজধানীর রাস্তায় এ গাছ লাগানো হচ্ছে না। কারণ কাঠের জন্য এত বড় বড় গাছ কেটে ফেলাও কাজের কথা নয়।
এ গাছ ছায়া দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু তারচেয়েও বড় ক্ষতি করছে পরিবেশের। পাখিরা এ গাছের ফল খেতে পারে না। মানুষও কোনও উপকার পাচ্ছে না। অথচ গাছগুলো কিন্তু এক হিসাবে লাখ লাখ বর্গমিটার জায়গার উর্বরা শক্তি ও মাটি দখল করে আছে।
মেহগনির জায়গায় অজস্র আম, কাঁঠাল, আমড়া, লটকন এসব গাছের দৃশ্য একবার কল্পনা করুন। অন্যরা পেড়ে খাবে? খাক না! কত খাবে, কারা খাবে? গুলশানের ধনী কেউ এসে ওই গাছে ঢিল ছুড়বে? মোটেও না। বেওয়ারিশ ফলজ গাছ মানেই গরিবের ফল কেনার চিন্তা থাকবে না।
আমাদের যারা মোটা মোটা বিসিএস গাইড পড়ে বড় কর্তা হয়েছেন, তাদের মাথায় এ বুদ্ধিটা আসে না কেন? কেন অজস্র বিদেশি আগ্রাসী ও বেহুদা জাতের গাছ দিয়ে দেশের প্রতিবেশ (পরিবেশ নয়) ধ্বংস করা হচ্ছে? অজস্র দিন, উর্বর মাটি ও সর্বোপরি একটা বড় জায়গা (খুব সংকট যার) দখল করে থাকা এসব গাছের সুফল তো জনগণ পাচ্ছে না।
জনগণই তো লাগাচ্ছে? তাদের বোঝাতে হবে না? আচ্ছা বুঝলাম জনগণ বুঝেও লাগাচ্ছে। জনগণকেও বলছি, আপনার পতিত জমি বা আঙিনায় যে মেহগনি লাগিয়েছেন, সেটা ২০ বছর পর বেচে কী পাবেন না পাবেন সে চিন্তা বাদ দিন। ওই জায়গায় দুচারটে থাই জাতের আমের কলম চারা লাগালেও কিন্তু তারচেয়ে কয়েকগুণ টাকা আসে। আম পাকবে, মানুষে খাবে। খেতে দিন।
সবাইকে উদ্ভুদ্ধ করুন পতিত জমিতে ফলের গাছ লাগাতে। পুরো গ্রাম নানা জাতের ফলগাছে ছেয়ে যাক। কেউ তখন আর কারও গাছে ঢিল ছুড়বে না। তবু দয়া করে আর কাঠের মোহে মেহগনি, আকাশমনি লাগাবেন না। আপনিই হিসাব করুন। যেসব মেহগনি লাগিয়েছেন, সেগুলো বেচে কত পাবেন? সেখানে নানা জাতের ফল গাছ থাকলে কত পেতেন?
তাই বলে মেহগনি লাগবে না? থাকুক কিছু। সুনির্দিষ্ট জায়গায় এর বাগানও করা যায় চাইলে। সেখান থেকেই আসবে ফার্নিচারের যোগান। তবে সামনে কিনা প্রসেস করা কাঠের দিন। এসব গাছ থেকে আনা কাঠের দিন কিন্তু শেষ। সেই সূত্রে এসব গাছের লাভও কিন্তু খুব একটা পাওয়া যাবে না আর।
সুতরাং নতুন করে যারা মেহগনির চারা রোপণের কথা ভাবছেন, তারা আরেকবার ভাবুন। একটি গাছ মানেই কিন্তু শুধু কাঠ নয়। গাছ মানে আপনার সন্তানের ফল খাওয়া, গাছ মানে আপনার মাটি ঠিকঠাক থাকা ও গাছ মানে পাখিসহ অন্যসব প্রাণির খাবারের যোগান।
বেশি করে ফল গাছ লাগান। ফলদ গাছ যত বেশি হবে, আমরা তত নিরাপদ হবো। অর্থনীতির যা খুশি হোক, ফলে ফলে ভরা বাংলাদেশে কেউ তো আর না খেয়ে থাকবে না তখন। শুধু একবার এই মুহূর্তে আশপাশের মেহগনি, আকাশমনির জায়গায় একবার ফলের গাছ কল্পনা করে দেখুন।
মাটির ফলদ বৃক্ষরোপণ অভিযানে অংশ নিতে যোগাযোগ করুন ইমেইলে। সেই সঙ্গে আপনার লেখা ও মতামত পাঠান: news@matinews.com