চোরাবালি চোরা ভয়
নাম শুনে কিংবা সিনেমা দেখে চোরাবালি সম্পর্কে যে যা-ই বলুক, সবার আগে বলে দিই, চোরাবালি মানেই মরণফঁাঁদ নয়। চোরাবালিতে কেউ পড়লেই যে সে আস্তে আস্তে পুরোটা ডুবে যাবে, এটাও বানানো গপ্প।
সম্ভবত সিনেমায়ই মানুষ সবচেয়ে বেশি চোরাবালি দেখেছে। আর এ সম্পর্কে সবার ভীতি এতটাই বেশি যে ভালো করে পরখ করে দেখতে এর ধারেকাছেও কেউ যায় না।
কিভাবে হয়?
কোথাও খটখটে মাটি, আর কোথাও থৈ থৈ জল। কোথাও শুধু বালি আর বালি। কিন্তু কিছু কিছু জায়গা আছে (বিশেষ করে সৈকত কিংবা জলাভূমির পাশে), যেখানে পাওয়া যাবে এসব উপাদানের বিচিত্র এক মিশ্রণ। ধরে নেওয়া যাক, একটা জায়গাজুড়ে অনেক গভীর পর্যন্ত কেবল বালিতে ভর্তি। আর এর ঠিক নিচেই আছে একটা লুকানো খাল কিংবা জলাধার। বালির স্তর আর পানির স্তরের মধ্যে হঠাৎ করে তৈরি হয়ে গেল সংযোগ নালা। জলাধারের পানি ওপরে উঠে ভিজিয়ে দিতে শুরু করল ওপরের সব বালি। একপর্যায়ে সব বালি ভিজে তৈরি হয়ে গেল থিকথিকে কাদা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে, এটা সাধারণ কাদামাটি। হাঁটতে গেলে বড়জোর গোড়ালি পর্যন্ত দেবে যাবে। কিন্তু ততণে নিচ থেকে আসা পানি এসে একেবারে সুপের মতো বানিয়ে দিল বালিগুলোকে। যা কি না সামান্য ভরও সহ্য করতে পারবে না। একপর্যায়ে বালির প্রতিটি কণার মধ্যে জমে গেল পানির বিন্দু। বালি আর শক্ত রইল না। হয়ে গেল নরম থিকথিকে বাথটাব। আর বালি ও নিচের পানির স্তরের মধ্যেও রইল না কোনো দেয়াল। অনেকটা গর্তের মুখে গাছের ডালপালা রেখে যেমন ফাঁদ বানানো হয়, তেমনি একটা ফাঁদ হলো চোরাবালি। পার্থক্যটা হলো, গর্তের মুখে থাকে ডালপালা, আর এর নিচে পুরোপুরি ফাঁপা। অন্যদিকে চোরাবালির ওপরে বালি, মাঝেও তাই, কোথাও একচুল ফাঁপা থাকে না। আর এ কারণেই চোরাবালি অতটা মারাÍক নয়।
পড়ে গেলে কী হয়
চোরাবালিতে পা দেওয়া মাত্রই যে জীবনের আশা ছেড়ে দিতে হবে এমনটা নয়। আসলে পা দেওয়ার পর অনেকে বোঝেই না যে সে চোরাবালিতে পা রেখেছে। ভাবে, তলার মাটিটা বুঝি এমনি এমনি নরম। যেই না আরো কিছু ধুড়–ম-ধাড়–ম করে পা ফেলল সে, অমনি বালির তলার জমে থাকা পানিতে হড়কে যেতে থাকবে ওপরের থিকথিকে বালিগুলো। অর্থাৎ ওপরের স্তরে খানিকটা ঝামেলা টের পাওয়া মাত্রই তলার নরম বালি-পানিতে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। পুকুরে ঝাঁপ দিলে যেমনটা হয়। যতই হুড়োহুড়ি বাড়ে, ততই সরে যেতে থাকবে তলার নরম বালির স্তর। কেননা পানিতে নড়াচড়ার ফলে যেমন ঢেউ তৈরি হয়, তেমনি চোরাবালির ভেতর হুড়োহুড়ি শুরু করে দিলেও এক ধরনের মৃদু ঢেউ দেখা দেয়। যে ঢেউয়ের তোড়ে বালির ফাঁকে জমে থাকা পানির কণাগুলো আরো বেশি করে বালিতে মিশে যেতে থাকে। আর যতই মিশবে, ততই পিছলে যেতে থাকবে বালি। আর পায়ের তলার বালি পিছলে গেলে তুমিও যে তলিয়ে যেতে থাকবে।
যদি পড়ে যাই!
চোরাবালিতে পড়ে যাওয়ার সুযোগ আমাদের খুব একটা নেই। তবু যদি কেউ পড়ে যায়, তবে তাকে যেন চোরাবালি সম্পর্কে কিছু টিপস দিতে পারো, তাই বলছিÑ১. প্রথম শর্ত, একটুও ভয় পাওয়া চলবে না। যতটা সম্ভব মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। পাশাপাশি ধীরে-সুস্থে শরীর থেকে ব্যাগের মতো ভারী ও অতিরিক্ত সব কিছু ফেলে দিতে হবে। পারলে জুতো জোড়াও খুলে ফেলতে হবে। কেননা জুতোর মসৃণ তলার কারণে বালি আরো বেশি করে পিছলে যেতে পারে।
২. বালি যদি বেশি নরম হয়, তবে নড়াচড়া করা মাত্রই দ্রুত ডুবতে থাকবে। এ েেত্র জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে পেট ফুলে ঢোল বানিয়ে রাখতে হবে।
৩. স্বাভাবিক অবস্থায় একপর্যায়ে চোরাবালিতে কেউ পুরোপুরি ডুবে যায় না। তাই স্থির থেকে সাহায্যের জন্য অপো করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে এর মধ্যে চাইলে কিছু কাজ করা যায়। প্রথমেই হাত আর দুই পা যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিতে হবে। আর ধীরে ধীরে পেছনে হেলে পড়তে হবে। একটা সূত্র নিশ্চয়ই মনে আছে, এক টুকরো লোহা পানিতে ডুবে গেলেও লোহার তৈরি জাহাজ কিন্তু ভেসেই থাকে। তাই নিজেকে জাহাজের মতো করে মেলে ধরতে পারলে চোরাবালির সাধ্য নেই তোমাকে ডোবায়।
চোরাবালি নিয়ে ভয় নিশ্চয়ই কেটে গেছে। তবে হ্যাঁ, বিশেষ সতর্কবাণীটা হচ্ছে, অ্যাডভেঞ্চারের নামে সৈকতের বিপজ্জনক অঞ্চলে না যাওয়াই ভালো। কেননা বিপদে পড়লে ভয়ের চোটে ওপরের টিপসগুলো ভুলে যাওয়াটা খুব সাধারণ ব্যাপার। আর ভয় পেয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করলেই… হায় হায়!