চীনের আবিষ্কার: সারি করে চাষ - Mati News
Friday, December 5

চীনের আবিষ্কার: সারি করে চাষ

চীনের আছে সমৃদ্ধ কৃষির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। দেশটির এমন অনেক উদ্ভাবন রয়েছে যা বিশ্বব্যাপী কৃষিতে এনে দিয়েছে নতুন মাত্রা। এর মধ্যে অন্যতম হলো সারি চাষের পদ্ধতি, যা ফসল উৎপাদন এবং টেকসই চাষাবাদের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছিল। প্রাচীন চীনের কৃষকদের উদ্ভাবিত এ পদ্ধতি কৃষির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক হিসেবে বিবেচিত। এমনকি চীন থেকে এ সারি করে চাষ করাটার কৌশল চলে যায় সারা বিশ্বে। এখন আমাদের ক্ষেতে খামারে গেলে দেখতে পাবো গাছগুলো সব সারি আকারে বেড়ে উঠছে।

প্রাচীন চীনে সারি চাষের ধারণা প্রথম চালু হয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৬ষ্ঠ শতক তথা আজ থেকে ছাব্বিশ শ বছর আগে চৌ রাজবংশের সময়। এর প্রায় দুই হাজার দুই শ বছর পর এ পদ্ধতির সন্ধান পায় ইউরোপীয়রা।

চৌ রাজবংশের আমলে প্রাচীন চীনা কৃষি গ্রন্থ, ছি মিং ইয়াও শু’তে সারি করে চাষের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এই পদ্ধতিটি কৃষকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং ফসলের বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা ও পানির প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল।

এই পদ্ধতিতে ফসল বপন করা হতো নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। বীজগুলো রাখা হতো সরলরেখায়। এতে ফসলের যথাযথ বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যেত আবার চারাগাছে পর্যাপ্ত সূর্যালোক, বায়ু চলাচল, এবং পানি গ্রহণের মাত্রাও বাড়তো। দূরত্ব বজায় রাখার কারণে শিকড় ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট জায়গাও পেত গাছ।

প্রাচীন চীনারা কিন্তু এমনি এমনি এভাবে সারি করে চাষ শুরু করেননি। এ পদ্ধতিতে চাষের রয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। সারি করে চাষ ছিল প্রাচীন চীনা কৃষকদের পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের অনন্য উদাহরণ। এর প্রধান বৈজ্ঞানিক দিকগুলো হলো:

  1. এ পদ্ধতিতে প্রতিটি গাছ পুরোপুরি সূর্যালোক পায়, যা গাছের ফটোসিন্থেসিস তথা সালোকসংশ্লেষণের জন্য অপরিহার্য।
  2. এ পদ্ধতিতে সেচের জন্য থাকতো আলাদা সারি। আর এ ব্যবস্থায় খাল ও নালার মাধ্যমে প্রতিটি গাছ সমপরিমাণ পানি পায়। এতে করে সব ফসলের গুণমানও থাকে একই রকম।
  3. মাটির নিচে শিকড়ের সাহায্যে গাছের মধ্যে চলতে থাকে এক ধরনের নিরব প্রতিযোগিতা। আর তা হলো কে কার আগে বেশি পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে। এলোমেলো আকারে বা এক জায়গায় ঘন করে গাছ লাগালে দেখা যায় সেখানকার গাছগুলো সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে না। সারি করে সঠিক দূরত্বে চাষ করা হলে প্রতিটি গাছই সমপরিমাণ ও পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান পায় সহজে। এতে করে গাছের নিজস্ব প্রতিযোগিতাও কমে আসে এবং গাছগুলো তখন নিজেদের বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায়।
  4. সারি করে চাষ পদ্ধতি বিশেষভাবে ধান, গমের মতো শস্যের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। আর এখনকার মতো প্রাচীন চীনেও এগুলো ছিল প্রধান খাবার। তাই খাদ্য সংকট প্রতিহত করতেও ভূমিকা রাখছে চীনের তৈরি সারি করে চাষ করার এ পদ্ধতি।
  5. এলোমেলোভাবে বীজ বপন করে বেশি চারা গজানো গেলেও মূলত ফলদায়ক গাছ বেশি পরিমাণে পেতে সারি করেই বীজ বপণ করতে হবে।
  6. এ পদ্ধতিতে মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে সারি করে চাষ করার পদ্ধতি।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এলোমেলো বপনের তুলনায় সারি পদ্ধতিতে চীনারা ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত ফসলের উৎপাদন বাড়াতে পেরেছিল। ইয়েলো নদীর সমতলভূমিতে এই পদ্ধতি কৃষি উৎপাদনশীলতাকে রূপান্তরিত করেছিল এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছিল।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় থাং রাজবংশের কথা। ৬১৮–৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলমান এই রাজবংশের সময় সারি চাষের উন্নত পদ্ধতির কারণে চীনে শস্যের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হয়েছিল, যা কিনা চীনের শহরায়ন এবং সিল্ক রোডের বাণিজ্য সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

বিশ্বজুড়ে সারি চাষের প্রসার

সারি করে চাষের ধারণাটি বাণিজ্য এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন কোরিয়া এবং জাপান এই পদ্ধতি দ্রুত গ্রহণ করে এবং স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়।

ষোড়শ শতকে, ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা চীনা কৃষি পদ্ধতির দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয় এবং এটি ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়। সারি করে চাষের ধারণা ইউরোপে কৃষি বিপ্লবের ভিত্তি স্থাপন করে, যা পরবর্তীতে পশ্চিমা কৃষি চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে।

বিংশ ও একবিংশ শতকে সারি চাষের পদ্ধতি আরও আধুনিক হয়েছে। চীনের প্রিসিশন এগ্রিকালচার বা যন্ত্রভিত্তিক নিখুঁত কৃষিকাজের সঙ্গে সারি চাষের মৌলিক নীতিগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর যথারীতি এ কাজেও নেতৃত্ব দিয়ে আসছে চীন।

সারি করে চাষ করার আছে আরও কিছু উপকার।

  • এ পদ্ধতিতে চাষ করা হলে সেচের পানি অপচয় হয় কম। সেচ দেওয়ার নানা ধরনের প্রযুক্তিও গড়ে উঠেছে সারি করে চাষ করার ওপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে ড্রিপিং ইরিগেশন সিস্টেমের কথা উল্লেখ করা যায়।
  • সারি করে চাষ করা হলে ফসল সংগ্রহের কাজ সহজ ও দ্রুত হয়। চীনের খামারে সারি করে চাষ করার কারণে যন্ত্রের সাহায্যে ফসল সংগ্রহ করা যাচ্ছে সহজে।
  • সারি করে চাষ করতে বীজের অপচয় কম হয়। তাই এ পদ্ধতিতে বেঁচে যায় চাষের খরচ। মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগও করতে হয় না এতে।
  • চীন থেকে শেখার পর এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেছিল ইথিওপিয়া। সেখানে এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, এলোমেলো বপন করার তুলনায় সারি করে বীজ বপন করা হলে প্রতি হেক্টর জমিতে গমের ফলন বেড়ে যায় প্রায় ৫০০ কেজি। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আধুনিক সারি চাষের মাধ্যমে মাটির উর্বরতাও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে এবং পানির ব্যবহার কমেছে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত।
  • চীনের আবিষ্কার সারি করে চাষ পদ্ধতি শুধু উৎপাদনশীলতা বাড়ায়নি, এটি পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মাটির ক্ষয় রোধ, সেচের পানির অপচয় কমানো, এবং কীটনাশকের কার্যকারিতা বাড়ানো এই পদ্ধতির প্রধান সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

প্রাচীন চীনের উদ্ভাবিত সারি চাষ শুধু একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, এটি কৃষি উন্নয়নের একটি যুগান্তকারী মাইলফলক। চীন থেকে শুরু হওয়া এই পদ্ধতি আজ বিশ্বব্যাপী কৃষি সম্প্রসারণের একটি প্রধান হাতিয়ার, যা কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করছে।

সূত্র: সিএমজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *