Saturday, December 14
Shadow

ভয় : ধ্রুব নীলের হরর গল্প

সদ্য খোঁড়া কবরের ভেতর শুয়ে আছি। স্যাঁতস্যাঁতে মাটি লেগে শার্টের পেছনটা ভিজে গেছে। ভেতরটা উষ্ণ। বাতাসের জন্য একটা পাইপের ব্যবস্থা আছে। তবু মনে হচ্ছে অক্সিজেন পাচ্ছি না। পাইপের অপরপ্রান্তে সম্ভবত পলিথিন জাতীয় কিছু আটকে গেছে। পাশ ফিরতেও সমস্যা। কারণ আমার পাশেই একটা তরতাজা কাফনে মোড়া লাশ। লাশ কি তরতাজা হয়?
লাশ মানে জড়বস্তু। মনে করুন আপনি খাটে শুয়ে আছেন। খাট জড়বস্তু। মাথার নিচের বালিশ জড়বস্তু। যতক্ষণ না ওই বস্তু আপনার ক্ষতির কারণ না হয়ে দাঁড়াচ্ছে ততক্ষণ আপনি…।
‘খুকক.. খুককক…।’
লাশটা কেশে উঠল। ভুল বললাম। লাশ হলে কাশবে কেন? লোকটা বেঁচে আছে? কাশি শুনে বুঝলাম বয়স পঞ্চাশের ঘরে। চিঁ চিঁ শব্দ আসছে কাফনের ভেতর থেকে। জোর করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলে যেমন শব্দ হয়। কিছু বলা দরকার? নাকি চুপচাপ শুয়ে থাকব?
কবরের ভেতর ঢোকার গল্পটা সংক্ষেপে বলি। আমার বন্ধু তুষার। সে-ই সব ব্যবস্থা করেছে। এটা ওটা ম্যানেজ করতে ওর জুড়ি নেই। ও জানে আমি ভয় পাই না। ভয়ের অনুভূতিটা আমার নেই। বিজ্ঞানীরা এখনো ডিএনএ’র ভেতর ভয়ের জিন আবিষ্কার করতে পারেননি। ওটা খুঁজে পাওয়া গেলেও আমি নিশ্চিত আমার ভেতর ওটা কেউ পাবে না।
তুষার মানতে নারাজ। সে মনে করে ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়িনি বলেই ভয় পাইনি কোনোদিন।
ভয়ের পরিস্থিতি বলতে ও কী বোঝাল সেটাও আমি জানি না। তবে তুষার যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছে সেসব হাস্যকর। তার সেই কর্মকাণ্ডের বর্তমান দশা হলো আমার কবরে শুয়ে থাকা। ঠিক কোন পর্যায়ে আমার ভয় পাওয়া উচিৎ বলে তুষার ভেবেছে?
‘ও মা! ও মা!’
ক্ষীণস্বরে ডাক দিল লোকটা। গলা শুকিয়ে নিশ্চয়ই কাঠ। তাকে কবর দেওয়া হয়েছে দুপুরের পর। এখন রাত এগারোটা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই লাশের শরীর থেকে মৃদু একটা গন্ধ আসার কথা। আমি পাচ্ছি না যদিও।
গোরখোদকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল সকালে। কবরের পাশে আরেকটা কবর খোড়া হয়েছিল চুপিসারে। ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো পথ। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়েছে আমাকে। লোকটাকে সমাহিত করে লোকজন চলে যাওয়ার পরও আমরা অপেক্ষা করেছি প্রায় সাত ঘণ্টা। আর গত এক ঘণ্টা হলো আমি শুয়ে আছি সমাহিত লোকটার পাশে।
একবার ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু মাটির সোঁদা গন্ধ আর পেছনটা ভিজে হওয়ায় ঘুম এলো না। তুষার বলেছিল সে আমাকে রেখে চলে যাবে। আমার ধারণা সে যায়নি। কবরস্থানের আশপাশে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। তার ধারণা আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই অপ্রকৃতস্থের মতো ভয় পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে আসব। আবার এমনও হতে পারে সে ঠিকই ভয় পেয়ে চলে গেছে। যা আমি পাইনি।
লোকটা নড়ে উঠল। কাফনের আগাগোড়া দড়ি দিয়ে বাঁধা বলে সুবিধা করতে পারছে না।
‘আপনি মারা যাননি?’
হাস্যকর ঠেকল প্রশ্নটা। তবে এটাই যুৎসই প্রশ্ন। লোকটা স্ট্যাচুর মতো স্থির হয়ে গেল আবার। নাহ মারা যায়নি লোকটা। কারণ বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছে।
‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? আমার নাম আবদুল মোতালেব। রূপসা ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। আমার বন্ধু তুষার…।’
‘ভাইসাব আমার বান্ধনটা খুইলা দিবেন? নাকের মইদ্যে কী জানি ঢুকসে। দম নিতে কষ্ট। মুখ দিয়া দম নিতাসি।’
‘আপনার নাকে তুলা। আপনি আজ সকালে মারা গিয়েছিলেন তো। মানে সবার ধারণা..।’
‘অ্যাঁ.. আমি কবরে! ও ভাই আমি কি কবরে! আপনে কে! আপনে কে!’
‘আপনি সম্ভবত ভয় পাচ্ছেন। একটু অপেক্ষা করুন। মোবাইলের টর্চ জ্বালাচ্ছি। কাফনের দড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না। ওটা না খুললে আপনাকে..।’
‘কাফন! ও আল্লাহ! আমি মইরা গেসি! আমি মইরা গেসি! আমারে বাঁচান। ও মা! মা গো! আমি মরবার চাই না!’
বিরক্ত হলাম। লোকটা হাউমাউ করছে কেন? তার তো খুশি হবার কথা। সে মারা যায়নি। দিব্যি বেঁচে আছে। সে কেন ভয় পাচ্ছে?
‘আপনার ভয় লাগছে?’
লোকটা চুপ। আমিও চুপ। মোবাইলের টর্চটা কোনোরকম এপাশ ওপাশ নেড়ে যতটা পারা যায় দেখে নিচ্ছি। লোকটা এখন নড়াচড়া করছে না। এতক্ষণ ভুল শুনলাম? যতদূর মনে পড়ে লোকটা মারা গিয়েছিল হার্ট অ্যাটাক করে। তারপর অনেকটা সময় পেরিয়েছে। এতক্ষণ কারো হার্ট বন্ধ থাকতে পারে? আমার ডাক্তারি জ্ঞান ভালো না অবশ্য।
কনুই দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিলাম। নড়নচড়ন নেই। কানে ভুল শুনতে পারি। হ্যালুসিনেশন হয়েছে সম্ভবত। হলে হবে। আগে বাঁধন খুলে দেখা যাক। অবশ্য এমনও হতে পারে লোকটা ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে বা আবারো হার্ট অ্যাটাক করেছে।
দ্বিতীয় যে কবর দিয়ে আমি নিচে নেমেছিলাম, সেটার ওপর পাতলা করে বাঁশের কঞ্চি আর লতাপাতা বিছানো। চাইলেই উঠে বেরিয়ে আসতে পারি। কিন্তু তুষার বলেছিল আমাকে কম করে হলেও ঘণ্টা দুয়েক শুয়ে থাকতে হবে। ঠিক লাশের মতো।
কাফনের বাঁধন খুলতে ঘাম ছুটে গেল। বাইরে পৌষের হিমরাত। কবর থেকে বের হলেই দেখা যাবে কণকণে ঠাণ্ডা ছেঁকে ধরেছে। ভয় কী জিনিস জানি না। কিন্তু নিজের ভালোমন্দ তো পাগলও বোঝে। তুষারের মতো অনেকেই বলেছে আমি নাকি শুধু ভূতে ভয় পাই না। বাকি সব কিছুতে ভয় আছে। এই যেমন সাপ, রেলিংবিহীন দশতলা বাড়ির ছাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরও বিষয়টা আমি অনুভব করতে পারিনি। বিশ্বাস করুন, এ নিয়ে আমার মধ্যে খানিকটা আক্ষেপও কাজ করে। আশপাশের সবাই একটা বিশেষ অনুভূতি পাচ্ছে, অথচ আমি পাচ্ছি না। খারাপ তো লাগবেই।
‘আমার হাত ধরুন।’
‘পারতেসি না ভাই। আমার গায়ে বল নাই। আমি শেষ। আমি লাশ!’
‘আপনি লাশ না। বেঁচে আছেন। আমরা এখন কবর থেকে বের হবো। তারপর আপনার বাসায় যাব। আপনার মা কি বেঁচে আছেন?’
‘আমি জানি না। আমি কিসসু জানি না। আমার কিসু মনে নাই!’
লোকটার গলার স্বর খানিকটা পরিষ্কার হলো। নাকে গোঁজা তুলার বল দুটো বের করে দিয়েছি।
কবরের ভেতর শ্বাস নিতে আমারও কষ্ট হচ্ছে। দুজনেরই মনে হলো বের হওয়ার দরকার।

লতাপাতা ঠেলে বের হলাম। লোকটাকে তুলতে গিয়ে ঘেমে একাকার হয়ে গেলাম। বের হয়েও তাই শীত লাগল না। ‘তুষার তুষার’ বলে কয়েকবার ডাকলাম। সাড়া মিলল না।
‘আপনার নাম কী?’
‘জানি না। ভুইলা গেসি।’
লোকটা ট্রমায় আছে। ট্রমা কেটে গেলে সব মনে পড়বে। সময় লাগবে।
‘পানি খাব।’
‘সঙ্গে তো পানি নেই। চলুন আপনার বাড়ি যাই।’
‘আমার বাড়ি কই? ও ভাই! আমার বাড়ি কই?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন আপনার বাড়ি যাওয়া যাক। আমারও পানি খাওয়া দরকার।’
‘ভাই আমার পা চলে না। আমারে ধরেন।’
লোকটা একেবারেই হ্যাংলা পাতলা। আমার শরীরে শক্তি মোটামুটি ভালোই। মওকা বুঝে লোকটা তার পুরো শরীরের ভারটাই যেন আমার হাতে গছিয়ে দিল। তার গায়ের গন্ধের সঙ্গে কর্পুর আর মাটির সোঁদা গন্ধ মিলেমিশে বীকট লাগল। গা করলাম না।
লোকটাকে নিয়ে কিছুটা হাঁটতেই মনে হলো পথ হারিয়েছি। এদিকে ফোনের চার্জ শেষের পথে। বন্ধ হয়ে গেল নাকি?
‘আপনি আমার লগে শুইয়া ছিলেন কেন? আপনার কাফন কই?’
‘আমি তো মারা যাইনি। এমনি শুয়ে ছিলাম।’
‘আপনিও কি মইরা গেছিলেন?’
উদাস হওয়ার ভান করে বললাম, ‘সম্ভবত। আমরা অনেকেই মৃত। কেউ টের পায়, কেউ পায় না।’
‘পানি খাব। পানির ব্যবস্থা করেন। আমার গায়ে শক্তি নাই। আমি মইরা গেছি দেইখা আমারে আর খাওনও দেয় নাই।’
‘ওরা কারা? পরিবারের কারো নাম মনে আছে?’
‘সাইফুল। সাইফুল, আমার পোলা!’
‘ও হ্যাঁ, কবর দেওয়ার সময় খুব কান্নাকাটি করেছিল। ওর সঙ্গে ঘিয়া রঙের শাড়ি পরা এক মহিলাকে দেখেছিলাম। ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। সাইফুলরে ও সাইফুল কাঁন্দিস না.. এমন বলছিল।’
‘ও আমার বউ। আমার মনে নাই। আমার কিছু মনে নাই ক্যান!’
‘আপনি বড় ধরনের শকের মধ্যে আছেন। এ জন্য কিছু মনে করতে পারছেন না। একটু একটু করে মনে পড়বে।’
‘আমরা কই যাই!’
‘আপাতত আগাছার জঙ্গল থেকে বের হই। তারপর কাউকে বলে কয়ে আপনার বাড়ি যাব।’

কতক্ষণ হাঁটছি জানি না। লতাপাতা আর কিছু ফার্নের ঝোপ পার হলাম। আধো আলো। খানিক পর পর লোকটার চেহারায় চাঁদের আলো এসে পড়তেই অন্যরকম লাগছে। এই অন্যরকম লাগাটা কি ভয়? নাহ, আমি তো তাকে ছেড়ে যাচ্ছি না। আমরা দুজন বলতে পারেন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হাঁটছি। আমি ছেড়ে দিলেই আছড়ে পড়ে বিপত্তি বাঁধাবে লোকটা।

‘তুষার? তুষার? পানি আছে তোর কাছে?’
ঝোপের আড়ালে স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা মানুষের অবয়ব। এদিকে সঙ্গের লোকটাকে ছাড়তেও পারছি না। কোনোমতে বসিয়ে দিলাম। কিন্তু বসে থাকল না। সটান শুয়ে গেল।
এগিয়ে গেলাম ঝোপের দিকে। লুঙ্গি গোছা করে কোমরের কাছে গুঁজে রাখা। কুচকুচে কালো গা। সম্ভবত অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করতে কিছু মেখেছে।
‘কে আপনি?’
‘কেডা? লাশচোর তো মনে হয় না।’
‘আমি লাশচোর হবো কেন? লাশ চুরি করে কী করব? আপনি লাশ চোর?’
‘জে। আমি চুরি করি। একটা লাশের দাম পাঁচ হাজার টেকা। আমি যার কাছে বেচি, সে বেচে দশ হাজার টাকায়।’
আমি কবর থেকে তুলে আনা লোকটার দিকে তাকালাম। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিঁ চিঁ করে কী যেন বলার চেষ্টা করছে। মুখের কাছে কান নিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম।
‘ভাই! ও ভাই! আমি তো লাশ না! আমারে যেন চুরি না করে।’
‘এই লাশটা আমারে দিয়া দেন। আপনারে এক হাজার টেকা দিতেসি।’
‘উনি তো মারা যান নাই।’
‘কী কন। আইচ্ছা থাক। না মরলে নাই। কপাল খারাপ। আপনি চলে যান মুরুব্বি। আমি আছি এখানে।’
আবারো ক্ষীণ কণ্ঠে অনুরোধ জানাল লোকটা।
‘ভাই! ও ভাই। আমারে একলা ফালাই রাইখা যাইয়েন না। আপনার পায়ে ধরি। ভাই আমি মরি নাই। আপনি চইলা গেলে এই লোক আমারে নিয়া যাবে।’
আমি একবার লোকটার দিকে আরেকবার লাশ চোরের দিকে তাকাচ্ছি। এরপর কী যে হলো, তেড়ে গেলাম লাশচোরের দিকে। লোকটা ক্ষীণকায় বলেই হয়ত সাহস দেখালাম খুব। আমাকে তেড়ে আসতে দেখে উল্টো দিকে দৌড়ে গায়েব হয়ে গেল লোকটা।

আমরা আবার হাঁটা শুরু করলাম। ক্লান্তি ছেঁকে ধরেছে। একটা বাঁশঝাড়ের তলায় দাঁড়ালাম। লোকটা একচুলও হাঁটছে না নিজে থেকে। আমাকেই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় চুপ করেই থাকল। মাঝে এক দুবার পানি চেয়েছে। আমি না শোনার ভান করেছি।
বাঁশঝাড়ের সামনে পুকুর। পুকুরে নেমে হাতের কোয়া করে পানি নিলাম। লোকটার মুখ ফাঁক করে ঢেলে দিলাম কিছুটা।
‘বাড়ি যাব। বাড়ি যাব।’
একই কথা একই স্বরে দু’বার বলল লোকটা। ঘোর এখনো কাটেনি? লোকটা কি ভয় পাচ্ছে? কেমন ভয়? সব ভয় কি একই রকম?
লোকটাকে ঝাড়তলায় রেখে এদিক ওদিক হাঁটলাম কিছুক্ষণ। মোবাইলের ঘড়িতে রাত দেড়টা। দুই ঘণ্টা কোন ফাঁকে কেটে গেল! বাঁশঝাড়টা আশ্চর্যরকম স্থির। একটা হিম বাতাস লাগছে গায়ে। অথচ একটা পাতাও নড়ছে না। এসব কি ভয় পাওয়ার মতো পরিস্থিতি?
চাঁদটা একটু বড় বড় লাগছে এদিকটায়। পথ চিনতে সমস্যা হচ্ছে না।
লোকটা বাঁশঝাড়ের নিচে এমনভাবে শুয়ে আছে যেন চাঁদটাকে গিলে খাচ্ছে। চোখজোড়া আশ্চর্যরকম খোলা। একটা আলোর উৎস দেখে আশা ফিরে পেলাম। জেলে হবে লোকটা। হাতে মাছ রাখার খলুই। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। চোখ দুটো কেমন করে রেখেছে। সম্ভবত ভয় পেয়েছে। আহা! ভয়! কেমন সে অনুভূতি কে জানে! কতদিন আমি ভয় পাই না। মন কিছুটা খারাপই হলো।
‘কে! কেডারে!’
‘ভয় পাচ্ছেন?’
‘ভয় পামু ক্যান! ভয় পামু ক্যান! তুই কে! তুই দূরে যা শয়তান! তুই দূরে যা! কোপ দিমু তোরে! থু থু!’
লোকটার গা কাঁপছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় জ্ঞান হারাবে।
‘সাইফুলদের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারবেন?’
‘থু! থু!’
আমি জানতাম ভয় পেয়ে মানুষ বিচিত্র সব কাজ করে। ভয় নিয়ে বেশ পড়াশোনা আছে আমার। তবে এ লোকের আচরণ মিলছে না।
‘সাইফুলদের বাড়িটা জানা দরকার।’
‘যাহ যাহ! আমারে ধরবি না কইলাম। রাস্তা ছাড়! যাহ! থু!’
লোকটা সামনে এগোচ্ছে না। পিছিয়েও যাচ্ছে না। চাঁদের আলোয় তার শরীরের কাঁপুনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
‘সাইফুলের বাবাকে আজ দাফন করা হয়েছিল।’
‘তুই কে! তুই কে!’
‘তার বাবা আসলে মারা যায়নি। ওই ঝাড়তলায় শুয়ে আছে। উনাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে।’
লোকটা চোখ বন্ধ করে সাহস সঞ্চয় করছে মনে হলো। আমি তার দিকে এক পা এগোতেই খলুইটা আমার দিকে ছুড়ে পেছন বরাবর ঝেড়ে দৌড় দিল।

বাঁশ ঝাড়ে আরেকটা অস্পষ্ট অবয়ব দেখলাম। গ্রামে বাঘ ভাল্লুক নেই। থাকলে নিশ্চয়ই এ দিকটা মাড়াতাম না। অবয়বটাকে হিংস্র কিছু মনে হলো না। একটা সাদা চাদর পরা মানুষের মতো। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। মানুষের মতো, কিন্তু চাদরের ভেতর মানুষ নেই। শূন্য চাদরই সোজা হয়ে ভাসছে।
আমাদের দিকে একটুখানি এগিয়ে আসছে। আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। শূন্যে ভেসে আছে কী করে ওটা? কাছে গিয়ে দেখে আসা যাক। পা বাড়িয়েছি মাত্র-
‘ভাই! যাইয়েন না! ওইটা ভালো না! ক্ষতি করবে আপনার।’
‘আপনি দেখতে পাচ্ছেন? আপনি তো অন্যদিকে তাকিয়ে।’
মাটিতে শুয়ে থাকা লোকটার গলার স্বর আশ্চর্যরকম স্থির। কোনো ওঠানামা নেই। এক তাল এক লয়ে বলে গেল সতর্কবার্তা। আমি তার সাবধানবাণী উপেক্ষা করে এগিয়ে গেলাম ভাসমান সাদা অবয়বটার দিকে। মনে হলো আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবয়বটাও পিছিয়ে যাচ্ছে। বাঁশঝাড়ের একেবারে গভীরে আমি। খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। সামনে হুট করে মিলিয়ে গেল জ্বলজ্বলে চাদরটা। হতাশ হলাম। ফিরে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার ঠিক পেছনে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাদা অবয়বটা। চাদর নয়, ওটা একটা আলো। আগের চেয়েও বেশি জ্বলছে মনে হলো। তাপের আঁচ লাগছে গায়ে। ও দিকে চিঁ চিঁ করে কবর থেকে ওঠানো মানুষটা ডেকেই চলেছে, ‘ভাই! ও মিয়াভাই আমারে বাড়িত নিয়া চলেন।’
সাদা চাদরের অবয়বটার কোনো মুখ দেখতে পেলাম না। তবে এক ঝলক দেখে মনে হলো অবয়বটা আমার নিজের। মানে আমি যদি এমন একটা সাদা চাদর পরে নিজেকে আগাগোড়া ঢেকে রাখি, আমাকে দেখতে এমনই লাগবে। ফিসফিস শব্দ শুনতে পেলাম। আমাকে যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। কান পাতলাম। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও ডাকছে না। তারপরও বেশ কষ্ট হলো শব্দগুলো শুনতে।
এলোমেলো শব্দগুলোকে সাজিয়ে যে বাক্যগুলো পাওয়া গেল সেটা অনেকটা এমন-
‘ওকে আবার জায়গামতো রেখে এসো।’
এ কথা বলে দুম করে আবার গায়েব হয়ে গেল অবয়বটা।
লোকটাকে আবার কবরে রেখে আসতে বলল? তা কেন করব? তারচেয়ে বরং ওকে নিয়ে গরুর খামারওয়ালা বাড়িটায় যাই। অনেক রাত হয়েছে।
ঘড়িতে আড়াইটা বাজে। বাঁশঝাড়ের চক্করে পড়েই নির্ঘাৎ এতটা সময় গেছে।
‘উঠে দাঁড়ান।’
‘পারব না। পারব না।’
লোকটা এবার ধমকের সুরে বলল কথাটা এবং যথারীতি পরপর দুবার। কসরত করে ওকে আবার তুললাম। লোকটার চোখের দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম। টকটকে লাল। ঠিকরে আলো বের হচ্ছে। আমাকে যেন ছাই করে দেবে এমনভাবে তাকিয়ে আছে। আমার কি এখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য পালিয়ে যাওয়া উচিৎ?
মনের ভেতর থেকে সায় মিলল না। লোকটার শুধু চোখই জ্বলছে। বাকি শরীরটা বরফের মতো ঠাণ্ডা, নিশ্চল।
‘আমাকে আমার জায়গায় রেখে আসো।’
‘কেন? আপনি তো মারা যাননি।’
‘আমাকে আমার জায়গায় রেখে আসো।’
প্রচণ্ড শক পেলে কি কেউ এমন অচেনা ভঙ্গিতে কথা বলবে? লোকটার তো এমন শুদ্ধ বাংলাও জানার কথা নয়।
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। লোকটাকে কাঁধে নিয়ে আর হাঁটতে পারছি না। সাড়াশব্দও নেই। মরে যায়নি তো?

মনে হলো অনন্তকাল বয়ে বেড়াচ্ছি লোকটাকে। ভয় পাওয়ার মিশনে নেমে এখন বলা যায় একপ্রকার বিরক্তই হচ্ছি। এক সময় একটা বাড়ি পড়ল সামনে। চারিদিক ঝপ করে নিরব নিথর। কারো নাম ধরে ডাকব কিনা ভাবছি।
‘কেউ আছেন? কেউ আছেন?’
আমিও একটা কথা দুবার করে বলা শুরু করলাম।
‘কিডা?’
বুড়োমতোন এক লোকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। একটু পর হারিকেন হাতে ঘুম জড়ানো একটা মুখ উঁকি দিল দরজা দিয়ে। আশি কি নব্বই হবে বয়স।
‘আমাকে চিনবেন না। আমি একটা লাশ নিয়ে.. মানে একটু সাহায্য দরকার।’
‘খিদা লাগসে? ভাত খাইবেন?’
উঠোনে সটান শুয়ে থাকা লোকটা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পানি খাব। পানি খাব। অনেক তৃষ্ণা।’
‘জ্বি পানি লাগবে।’
‘তোমার লগে কেউ আছে? তুমি ডাকাতি করো?’
‘জ্বি না। সঙ্গে যে আছে সে উঠোনে শুয়ে আছে।’
‘তোমার গায়ে লাশের গন্ধ ক্যান?’
‘অনেকক্ষণ মাটিতে ছিলাম তো। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?’
‘আমি চউক্ষে কম দেখি।’
বুড়োর গলার স্বরও একলয়ে চলছে। সেও বোধহয় আমার মতো। ভয়টয় কাকে বলে জানে না।
‘সাইফুলদের বাড়িটা কোন দিকে জানেন নাকি? ওর বাবা আছে আমার সঙ্গে।’
‘তাই তো বলি লাশের গন্ধ আসে কই থেকে। হ্যার বাপ মইরা গেসে।’
বলেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল বুড়ো। আমি অবাকই হলাম। হাসির কারণটা ধরতে পারলাম না।
‘আমি ওর বাবাকে ওদের বাড়িতে দিয়ে আসি।’
‘লাশের বাড়ি তো একটাই। কব্বর। ঘোর অন্ধকার কব্বর। যে বাড়ির দরজা কোনোদিন খোলে না। খ্যাক খ্যাক খ্যাক।’
‘সাইফুলদের বাড়ি…।’
‘সোজা আউগাইতে থাকো। মরা বাড়ির কান্দাকাটি কানে পাইবা। অবশ্যি এখন নিশুতি। সবাই মইরা গেছে। ঘুম তো আরেক মরণ। আহা..।’
বুড়ো কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
আবার এ জগতে ফিরে আসতেই সচকিত হলাম। উঠোনে পড়ে থাকা কবর থেকে তুলে আনা লোকটার দিকে চোখ পড়তেই চিন্তা হলো। পানি তো দেওয়া হয়নি।
‘জ্বি। পানি দেন। জলদি পানি দেন। কতদিন পানি খাই না।’
লোকটা দেখি মনের কথা পড়তে পারে।
‘কাজটা আপনে ঠিক করেন নাই। যে একবার কবরে যায় তাকে আর ফেরত আনন ঠিক না।’
বুড়োর কথা শুনে বিরক্তই হলাম।
‘জীবিত মানুষকে কবরে নিলেও তাকে আনতে নেই?’
বুড়ো আবার বিশ্রী শব্দে হেসে উঠল।
‘জ্যান্ত মানুষ তো কব্বরে যায় না। বোকা!’
রাগ হলো খুব। উঠানে পড়ে থাকা লোকটাকে ধরে আবার দাঁড় করালাম। তারপর তাকে নিয়ে হন হন করে বাড়ির পেছনের অন্ধকার ঢাকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
‘আস্তে যান। ব্যথা লাগে।’
লোকটা পুরো ভরই আমার গায়ে ছেড়ে দিয়েছে। আচ্ছা মুশকিল। এরচেয়ে তাকে কাঁধে চড়িয়ে নিলেই ভালো হতো।
একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। গুন গুন শব্দ পাচ্ছি। মিহি কণ্ঠে এক নারীর কান্না ভেসে আসছে । মরাবাড়ি বলতে যা বোঝায় সেটাই বোধহয়। বাড়ি বলতে জীর্ণ কুটির। এ কি তবে সাইফুলের মা? লোকটার স্ত্রী? লোকটার কাছ থেকে কোনো জবাব এলো না।
‘কেউ আছেন?’
‘আসছি দাঁড়ান।’ জবাব দিল নারীকণ্ঠ। সম্ভবত সাইফুলের মা। মানে লোকটার স্ত্রী।
কী আশ্চর্য। মধ্যবয়সী ওই নারীর হাতে পানির গ্লাস। চোখ দুটোর নিচে কালশিটে। শাড়িটা পরিপাটি করে পরা। কিন্তু চেহারায় যেন ঝড় বয়ে গেছে।
‘নেন পানি খান।’
‘আমি তো খাব না। উনি খাবেন। উনি কি আপনার…।’
‘উনি তো মইরা গেছে। আজকেই কবর দেওয়া হইল। মরা মানুষ পানি খায়? কী! আপনি পানি খান? আপনি তো মরা।’
বিরক্ত হলাম। এ মহিলা বলে কী! সামনে জলজ্যান্ত একটা…। কিন্তু যদি মৃতই হয়, তাহলে তার দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করবে কেন? নাকি স্বামীকে হারিয়ে মহিলার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
লোকটাও বা কী রকম পাজি। এখন আর পানি চাইছে না। হা করে আকাশের তারা গুনছে।
‘সাইফুল দেইখা যা! তোর বাবা, কেমুন কইরা তাকাইয়া আছে।’
সাইফুল নামে কেউ এলো না। আর মহিলার কণ্ঠস্বরও কেমন রসকসহীন ঠেকল। হাত বাড়িয়ে আমি গ্লাসটা নিলাম। ঠোঁটের সামনে নিয়ে বুঝতে পারলাম তাতে পানি নেই। ছুড়ে ফেলে দিলাম গ্লাসটা। অভদ্রতার একটা সীমা থাকে।
লোকটাকে দেখলাম চট করে উঠে পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে রইল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘরের পেছনের অন্ধকারের দিকে। ওদিকে কাকে দেখতে পেয়েছে কে জানে। গোঁ গোঁ করে শব্দ বের হচ্ছে গলা দিয়ে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। একটা শেয়াল। ওটার চোখে আগুন ঝরছে ওটার। জম্পেশ শিকার দেখতে পেয়েছে যেন।
‘যা! যা! ছুহ! ছুহ!’ উঠোনে মূর্তির মতো বসে থাকা লোকটা শব্দ করল।
হিংস্র শ্বাপদের মতো গুটিপায়ে এগিয়ে এলো শেয়ালটা। আমাকে পাশ কাটাল। যেন দেখতেই পায়নি।
‘কী করি বলুনতো?’ কথা শুনে লোকটার স্ত্রী ঘুরে দৃষ্টি হানল আমার দিকে। অস্বাভাবিক ঠেকল তার ঘুরে দাঁড়ানোটা। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম, মহিলার মাথাটা ঘুরেছে কেবল। বাকি শরীরটা ঘোরেনি। চোখে প্রশ্ন নেই। শূন্য দৃষ্টি। ঠিক যেমন করে দেখে মৃতরা।
‘শেয়ালটাকে তাড়ান প্লিজ।’
‘লাশের গন্ধ পাইয়া আসছে। ওরে তাড়ানো ঠিক হইব না। ওরে তাড়ানো ঠিক হইব না! হা হা হা হা!’
অপ্রকৃতস্থের মতো হেসে চলেছে ওই নারী। পিছু হটলাম। লোকটার স্ত্রীর ঠোঁট এত লাল কেন? নাকি এ অন্য কেউ। আগের মতো আর শোকার্ত মনে হলো না। মনে হলো বয়সটাও ঝপ করে কমে গেছে।
‘ভাই, আমারে খাইয়া ফেলবে। আমারে বাঁচান। ও আমার বউ না। ও একটা লাশখোর পিশাচিনী!’
এক অসীম শূন্যতা আমাকে গ্রাস করছে। আমি পড়ে যাচ্ছি! অনেক নিচে। অনেক নিচে। তলাহীন এক জগতে পড়ছি তো পড়ছি। কিন্তু লোকটার আর্ত দৃষ্টি আমার পিছু ছাড়ছে না। অনুনয় করেই চলেছে, ‘আমি কবরে যামু না! আপনি সাইফুলের মায়েরে ডাক দেন। আমি মরি নাই।’
লোকটার কণ্ঠের ওঠানামা নেই। পড়ছে না চোখের পলক। নড়ছে না ঠোঁট। উঠোনে শুয়ে আমার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে তো আছেই।
পিছু হটতে শুরু করলাম। লোকটার শীতল দৃষ্টি আমার পিছু ছাড়ছে না। ভেসে ভেসে আসছে জ্বলজ্বলে ওই নারীমূর্তি। তার জ্বলন্ত অথচ ঘোলাটে চোখ আমি এড়াতে পারছি না কিছুতেই। পালাতে চাইছি প্রাণপনে। আমার গা ঘামছে। বুকে কী যেন বাড়ি খাচ্ছে। মনে হলো প্রচণ্ড বেগে পিছু হটছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন এক পা-ও নড়তে পারছি না! জ্বলজ্বলে নারীমূর্তিটা পানির গ্লাস হাতে আমার খুব কাছে চলে এসেছে। আমার পা চলছে না। কিন্তু আমি পিছু হটছি। এক নতুন অনুভূতি আমাকে গ্রাস করে চলেছে! একটা কিছু হচ্ছে! একটা কিছু টের পাচ্ছি আমি!

[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি  পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!