ধ্রুব নীল
ভূতের প্রসঙ্গ উঠলেই নাঈমের দাদি খ্যাটখ্যাট করে ওঠেন। খ্যাটখ্যাটের একপর্যায়ে তিনি অশালীন গালিগালাজ শুরু করেন। গ্রামে এসব গালিগালাজ কমন ব্যাপার।
নাঈমের সঙ্গে তার ভার্সিটির বান্ধবী উপমাও বেড়াতে এসেছে। উপমার সামনে দাদির অশ্লীল গালিগুলো হজম করতে হচ্ছে নাঈমকে।
‘যা যা। ভূত আমার ইয়ে করবে।’ তারপর ভূত আর কী কী করতে পারবে না সেটার একটা ফিরিস্তি দিলেন দাদি।
‘দাদি, উপমা এসেছে ঢাকা থেকে। ওর কথাই বলেছিলাম। ও এসেছে আমাদের বাড়ির ভূত দেখতে।’
দাদি একটা কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেলেন। উপমা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন গোটা গোটা চাহনির সামনে গালিটালি মুখ দিয়ে আসে না। হামানদিস্তায় পান ছেঁচতে লাগলেন দাদি। চোখে ছানি পড়ায় কোন দিকে তাকিয়ে আছেন বোঝা গেলো না।
রাত এগারোটা। এখনকার গ্রামে এগারোটা অতো গভীর নয়। অবশ্য আজ সম্ভবত অমাবস্যা। ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে যে একটা বিষয় আছে সেটা মনে হয় এই প্রথমবার দেখলো উপমা। একটু পর পর নাঈমের গা ঘেঁষে বসছে।
‘কোলে উইঠা বহো না ক্যান। আন্ধারে কেউ কিছু…।’
‘দাদি, চকোলেট খাবা? লেবেনচুস টাইপের চকলেট না, এটা বিস্কিটের মতো। ধরো নাও।’
‘আমারে হাত করনের ধান্ধা? দে দে। তোর দাদার মতো হইছিস। একটা হারামি। কথা নাই বার্তা নাই পল্টি মারলো একদিন।’
‘দাদা ছিল রোমিও টাইপ। আমিও তার মতোই। ব্যাপারটা জেনেটিক।’ তড়িঘড়ি কথা ঘোরালো নাঈম।
দাদির গলা নরম হচ্ছে। লক্ষণ ভালো। সুযোগ বুঝে এবার কথা পাড়লো উপমা। ‘গভীর রাতে যে কাঁদে, তাকে কেউ দেখেছে?’
‘কিডা? ও ওই পেত্নি? ওই পেত্নিরে আইজতক কেউ দেখে নাই। কয়েকজনে দেখছে মনে হয়। দেইখা দিওয়ানা হইসে। দিওয়ানা না, হইসে পাগল। তোর দাদায় তো রোজ কান্দন হুননের লাইগা গুয়ের কিনারে বইসা থাকতো। নাঈমরে, ও নাঈম তোরে নিয়া আমার ডর করে। এতো সোন্দর পোলা তুই। তোরে যদি আবার ডাক দেয়। বাপুরে, তুই আবার পেত্নির ডাকে চইলা যাইস না। তোগোরে কিডা কইসে আইজ অমাবস্যার রাইতে এই কালিডাঙ্গায় আইতে।’
‘আজ অমাবস্যা! বাহ। ভালো তো!’
‘হ হ। কালা রাইত। কোন দিক দিয়া কে কারে…।’
দাদি আবার বেলাইনে চলে যাচ্ছে দেখে তাগাদা দেয় নাঈম।
‘তুমি ভূত পেত্নি যেটার হোক একটা গল্প শোনাও। আমি একটু বাথরুম থেকে আসি।’
‘লাইট নিয়া যা। ওই খানকি আবার কান্দন লাগাইবো কইলাম।’
‘কে দাদি?’
‘যার কতা কই। রাইত হইলে গুন গুন কইরা মাথা ধরাইয়া দেয়। হারা রাইত কান্দে ক্যান আল্লা মালুম। কীসের এতো জ্বালা তার। পাইলে ছেমরির…।’
নাঈমের দিকে তাকায় উপমা। গোলগাল মুখে টোল পড়া হাসিটা টেনে বলে, ‘পেত্নি তোমাকে ধরে নিয়ে গেলে খোদাহাফেজ। পেত্নিধরা ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না।’
খিলখিল করে হেসে উঠলেন নাঈমের দাদি পরীবিবি। পান মুখে দিয়ে তিনি শুরু করলেন গল্প। বেশ গুছিয়েই বলতে পারেন।
‘আমার তখন বারো তেরো। আপনের দাদাজান তখন আমার দিকে নজর দিসে। কত প্রেম। রাইত বিরাইতে শিয়ালের পাল খেদাইয়া আহে আমার লগে পিরিতি করতো। আমাদের বিয়া হইলো। তারপর সংসার শুরু হইলো। একদিন শুরু হইলো কান্দন.. সেই কান্দন। পেত্নির কান্দন। কান্দন হুইনা আপনের দাদাজানের মাথা গেল খারাপ। কয় এতো মিহি সুরে কান্দে কে? না জানি মাইয়ার কত দুঃখ। দুঃখ না ছাই। আসলে তো ওই মাইয়া.. না, তুই শহরের মাইয়া। অত বুঝবি না। বিয়াশাদি না হওয়ার দুঃখ আরকি। তোর দাদাজানরে কইলাম, এতো খোঁজ নেওনের কাম নাই। আপনে বইসা থাকেন। না উনি রাত বিরাইতে বিচরাইয়া বেড়ায়। আমার তো মনে হয় ওই পেত্নির লগে দেহাও হইসে তার।’
বিদ্যুৎ নেই। টর্চও নেই হাতের কাছে। অবশ্য এখন আর তিন ব্যাটারির টর্চ লাগে না। মোবাইলের টিমটিমে বাতিতে কাজ হয়। কিন্তু আজকের অন্ধকারটা একটু বেশি ঘুটঘটে। মনে হচ্ছে একদলা অন্ধকার কেউ ঘুটা মেরে রেখে গেছে বাড়ির পেছনে।
ফ্ল্যাটে থাকার অভ্যাস। গা ছমছমে ব্যাপারটা জানে না নাঈম। হনহন করে হাঁটতে লাগল পেছনের শান বাঁধানো একটা সিমেন্টের বাথটাব ধরে। হাতের ডানে বাঁশঝাড়ের পাশ ঘেঁষে টয়লেট। বাড়ির ভেতর এটাচড বাথরুম বিষয়টা দাদির একেবারেই পছন্দ না। প্রায়ই বলেন, ‘ঢাকার মানুষ ঘরের ভিতরে হাগে ক্যান! কী সমস্যা!’
বাঁশঝাড়ের আড়ালে হুট করেই একটা কালো চাদর। গাছপালা আর ঝাড়ের ছায়া এমনভাবে পড়েছে যে সামান্য আলো-ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। ছোটবড় সব গাছ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ঝড়ের মৌসুম। বাতাস নেই একফোঁটা। নাঈমের মনে হলো ঝোপের আড়ালে একটা কিছু নড়ে উঠলেই ভালো হতো। এমন মূর্তির মতো গাছপালা দেখলেই ভয় লাগে।
একা একা এতদূর আসা ঠিক হয়নি? বাড়িতে লোকজন সব ঘুমে। কাউকে ডেকে আনতে হলে আবার ফিরে যেতে হবে। ভাবনাটা বাদ দিল নাঈম। এখন ডাকাডাকি করা মানে দাদি আরেকটা গল্প পেয়ে যাবেন। পান ছেঁচতে ছেঁচতে পাশের বাসার চাচিকে বলবেন, আমার নাতিটা সবে হাগতে বসছে, এমুন সময় একটা খবিশ ভূত আইসা কইল, গু খা।
বাথরুমের চাপ বেশি নেই। না সেরেই চলে যাবে কিনা ভাবছে। এত কাছে এসে ফিরে যাওয়ার কী মানে। লম্বা দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করলো নাঈম।
বাঁশঝাড়ের পাশে চিকন একটা পায়ে হাঁটার মতো রাস্তা। ওপারে নিকষ কালো অন্ধকারের একটা চাদর। আকাশে দুচারটা তারা আছে এখানটায় মিশমিশে কালো। কিছুটা হলেও দেখা যাওয়ার কথা। দিনের বেলায় পরিষ্কার দেখেছে, ঝাড়ের পাশের ডোবার মতো পুকুরটার ওপারে একটা পাড় আছে। পাড়ের ওপারে ধানক্ষেত। জঙ্গল নেই খুব একটা।
কিন্তু এখন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন মহাকাশের একরাশ অন্ধকার ঝপ করে বসে পড়েছে কালিডাঙ্গার গহীন জঙ্গলে।
‘কে! কে কথা বলে!’
কথাটা গলা দিয়ে বের হয়নি নাঈমের। মনে মনে বলেছে। ভয় পেলে মানুষ মনে মনে চিৎকারও দেয়। নাঈম বুঝতে পারলো সে সত্যিকার অর্থে ভ‚তের ভয়ে কাবু।
কেউ কি আদৌ কথা বলেছে? এমন কালো অন্ধকার ভেদ করে তো কথাও আসতে পারবে বলে মনে হয় না। নাঈমের মন চাইল বসে পড়ে। পেছনে তাকানোর ইচ্ছেও করছে না। এবার স্পষ্ট শুনতে পেলো। গুন গুন করে কাঁদছে। কান্না নাকি গান? চলে যাওয়ার বাদ দিল নাঈম। গানের সুরে একটা টান আছে। সেই টান তাকে বেঁধে ফেলেছে।
গাঢ় নিকষ অন্ধকারের চাদরটা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হাত-পা আঁকড়ে ধরেনি কেউ। এমনি এমনিই টানছে। চুম্বকের মতো। নাঈম পা চালালো পুকুরপাড় ঘেঁষে।
কয়েক কদম এগোতেই অন্ধকার চাদরটা পার হয়ে গেল। ধুপ করে যেন আবার চোখের সামনে ফুটে উঠলো গাছগাছালির ছায়া। তারাগুলো আগের মতোই আছে। সামনে পেছনে গহীন জঙ্গল।
অবাক হলো নাঈম। বাড়ি ছেড়ে কতদূর এসেছে বুঝতে পারছে না। যতদূর দেখা যাচ্ছে, গাছ আর গাছ। এত ঘন ঝোপ পার হলো কী করে?
‘আমার মনের মানুষের সনে…’
ওহ, গানই তো গাচ্ছে। পরিচিত সুর। মিলন হবে কতদিনে।
ভূত নিশ্চয়ই লালন ফকিরের গান গাইবে না। শব্দের উৎস খুঁজতে আরও হাঁটলো নাঈম। উত্তর-দক্ষিণের দিশ এমনিতেই থাকে না। পথ হারালে হারাক। আজকাল তো চাইলেও পথ হারানো যায় না।
‘অত বিচরান ক্যান। এইদিকে আমি।’
পুরনো মোটা গাছের গুড়ি। গাছের বয়স কয় শ বছর কে জানে। গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে পায়ে আলতা লাগাচ্ছে এক মায়াময় তরুণী।
‘আপনি ভূত? মানে পেত্নি?’
‘ভূত বলেন, সমস্যা নাই। পেত্নি বলবেন না। শুনতে খারাপ লাগে। আমি কত সুন্দরী দেখতেসেন না।’
‘হ্যাঁ, কাছে এসে বসি?’
‘বসেই তো আছেন। আবার জিজ্ঞাস করেন ক্যান।’
নাঈম বুঝতে পারলো বড় গণ্ডগোলে পড়েছে। তবে মধুর গণ্ডগোল। সে মেয়েটার এক হাত সামনেই গুড়িয়ে হেলান দিয়ে বেশ আয়েশ করেই বসে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে আগের যুগের সাদাকালো কোনো সিনেমায় ঢুকে পড়েছে। ফিতেওয়ালা ক্যাসেটে তাদের দুজনের সিনেমাটা কেউ আকাশ থেকে দেখছে। এখুনি হেসে উঠবে একরাশ দর্শক।
‘তুমিও লাগাইবা একটু আলতা? আসো, আরো কাছে আসো, তোমার গালে একটা নকশা বানাইয়া দেই।’
‘উপমা রাগ করবে।’
‘ছি, এইটা কোনো নাম হইল? আমার নাম কত সুন্দর! আমার নাম পদ্মলতা।’
‘পদ্মলতা তোমার বাড়ি কই?’
‘ওই তো।’
‘আমার বাড়িটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। পথ হারাইসি মনে হয়।’
‘সবাই পথ হারায় গো। পদ্মলতার ডাকে সবাই পথ হারায়।’
‘তুমি দেখি ভ‚তের মতো কথা বলছো। দিয়া ভূত নাকি? যার কারণে পথ হারায়।’
‘হ। আমি ভূত। এখন তোমার ঘাড় মটকাইবো। একটু ওইদিক ফিরা বসো। ধরতে সুবিধা হইবো। হিহিহি।’
নাঈম ঘটনা ধরতে পারলো। সে স্বপ্ন দেখছে। কোনও কারণে অতিরিক্ত ভয় পেয়ে নিশ্চয়ই জ্ঞান হারিয়েছে। দাদিবাড়ির লোকজনের এতক্ষণে টের পাওয়ার কথা।
‘উপমার বয়স কত গো?’
‘আমরা একসঙ্গে পড়ি। ভার্সিটিতে। ওর তেইশ আমারও তেইশ।’
‘ছি ছি ছি। এ তো ধামড়ি মেয়ে!’
বলেই জিব কাটলো পদ্মলতা। নাঈম কিছু মনে করলো না। সে মুগ্ধ হয়ে আলতার আলপনা দেখছে।
‘আচ্ছা, পদ্মলতা। আমি যদি আর ফিরে না যাই। তুমি আমাকে সঙ্গে নেবে।’
পদ্মলতা অবাক হয়ে তাকালো।
‘তুমি দেখি এক্কেবারে পুলাপাইন। মরদ হও আগে। গায়েগতরেও তো বল নাই।’
কোনো তাচ্ছিল্যই গায়ে লাগছে না নাঈমের। চাঁদ নেই। থাকলে পদ্মলতাকে আরেকটু ভালো করে দেখতে পেতো।
‘তুমি আমারে বিবাহ করতে চাও?’
‘হুম।’
‘তোমার উপমা না টুপমা, তার কী হবে গো? সে তো পরে আমার মতো রাত বিরাইতে বনে জঙ্গলে গুন গুন করবে।’
‘কোন উপমা? কার কথা বলছো?’
নাঈমের চোখে চোখ রাখলো পদ্মলতা। গা শিউরে উঠলো নাঈমের। তার ভেতরের সব যেন পড়ে ফেলছে পদ্মলতা।
‘তুমি কি সব ভুইলা গেছো?’
‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। স্মৃতিভ্রম হচ্ছে। কোনো একটা চক্রে আটকে গেছি মনে হয়। তবে উপমা নামটা চেনা চেনা লাগছে।’
‘জাদুটোনা হইলো নাকি? ওই সবে আমি বাপু বিশ্বাস করি না। আমার মায় করতো। সে মরসে গলায় ফাঁস দিয়া। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি..।’ আবার গুন গুনিয়ে উঠল পদ্মলতা।
‘আরে আমিও তো জাদুতে বিশ্বাস করতাম না। এখন তো মনে হচ্ছে করা উচিত। তুমিই তো আস্ত একটা জাদু।’
প্রশংসায় লজ্জা পেলো পদ্মলতা। তার লাজুক অথচ ধারালো চাহনি দেখে নাঈম বুঝে ফেলল, এ মেয়েকেই সে ভালোবাসে। শুধু এতোদিন দেখা পায়নি।
‘তোমার হাত ধরি পদ্মলতা?’
পদ্মলতা শুনতেই পায়নি। গুন গুন করে আবার গান ধরেছে। অচেনা এক বাউল ঘরানার গান। এ গান নাঈম শোনেনি আগে।
‘তোমার বানানো গান?’
কিছু বললো না পদ্মলতা। যেন বাচ্চা ছেলের সব কথায় কান দিতে নেই।
আলতা লাগানো শেষ। এবার পা ছড়িয়ে বসলো।
‘এতো রাত্তিরে বনে বাদাড়ে বসে আলতা লাগাইতেসি, আর তুমি একবারও জানতে চাইলা না।’
‘কী?’
‘এতো রাইতে আমি বাইরে কেন?’
‘তুমি বাইরে কেন পদ্মলতা?’
‘বারবার নাম ধরে ডাকবা না তো। শরম লাগে।’
ক্ষণিকের নিরবতা ভেঙে পদ্মলতা আবার বলল, ‘তুমি ছেলে ভালো। তোমার সঙ্গে আমার সংসার হবে না। তুমি হবা আমার অচিন পাখি। খাঁচা ভেঙে পালানো অচিন পাখি।’
‘তোমার কথাগুলো লিখে রাখা দরকার পদ্মলতা।’
‘তুমি লেখো। আমি লিখতে পারি না। পেত্নির আবার পড়ালেখা কীসের। হিহিহি।’
‘তোমার সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে?’
‘জানি না। কতজন আসে, যায়। কেউ আর খোঁজ নেয় না। তোমারে চেনা চেনা লাগে। তুমি কার ঘরের পোলা গো?’
‘আমি সামসুল হকের নাতি। এই তো বাড়ি।’
‘হুম। চিনলাম না। এদিকে আসো তোমার চুল আঁচড়াইয়া দেই। আমার কাছে চিরুনি আছে।’
মাথা এগিয়ে দিল নাঈম। পদ্মলতার হাতে অদ্ভুত এক চিরুনি।
‘এটা আমার দাদির আমলের। হরিণের শিং দিয়া বানাইসে কারিগর। তোমার চুল দেখি পাতলা। এত তাড়াতাড়ি সব পড়লো কেমনে।’
পদ্মলতা সময় নিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। নাঈমের মনে হলো সে এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ঘুম থেকে উঠে দেখবে সে তার দাদিবাড়ির পায়খানার পাশে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। দাদি বদনা থেকে পানি হাতে নিয়ে তার মুখে ঝাপটা দিচ্ছে।
না তেমন কিছু ঘটেনি। চুল আঁচড়ানো শেষ। আবার গুন গুন আরেকটা গান ধরেছে পদ্মলতা। সেই সঙ্গে আনমনে হাত বুলোচ্ছে নাঈমের মাথায়। নাঈমের মনে হলো এবার ঘুমিয়ে পড়া যায়। কিন্তু ঘুম আসছে না। অবচেতন মন তাকে গালি দিচ্ছে বারবার, হারামজাদা এখন ঘুমিয়ে পড়বি ক্যান! ঘুমিয়ে গেলে তুই বাথরুমে আছিস না পদ্মলতার কোলে সেটা বুঝবি কী করে! সময়টা উপভোগ কর!
কেটে গেলো অনন্তকাল। নাকি কয়েক মিনিট। কে জানে। পার্থক্য তো নেই। নাঈমের মাথাটা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল পদ্মলতা। দুঃখ হলো না তাতে নাঈমের। তার মনে হলো পদ্মলতাকে একটা কিছু দেওয়া উচিৎ। এই অবিস্মরণীয় আধিভৌতিক ঘটনাকে মনে রাখার মতো একটা কিছু। আংটি চেন কিছুই পরে না ও। পকেট হাতড়ালো। একটা ক্যাডবেরি আছে। ওটাই বাড়িয়ে দিল।
‘নাও।’
হাত বাড়িয়ে নিলো পদ্মলতা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো যেন জীবনেও দেখেনি।
‘আমি চললাম। আবার আসবো।’
পদ্মলতা নাঈমের চোখে চোখ রাখলো। ভাবলো মাথা নিচু করে। চকোলেটটা জড়িয়ে দুহাত ভাঁজ করে রাখলো বুকের ওপর। তারপর ফ্যাকাসে মুখে প্রচণ্ড কষ্টের ছাপ নিয়ে ঘুরে চলে গেলো দ্রুত পায়ে। হাহাকার বেজে উঠলো নাঈমের বুকে। সেও ফিরতি পথ ধরলো। সেই নিকষ কালো অন্ধকার চাদরটা আবার ফিরে এসেছে ডোবার পাড়ে।
বছর দশেক পরের কথা। উপমাকে নিয়ে দাদির বাড়িতে এসেছে নাঈম। সঙ্গে তিন বছরের মেয়ে পদ্ম। দাদি মারা গেছেন কয়েক বছর হলো। তার কবরটা দেখে পদ্মকে নিয়ে বের হয়েছে আশপাশ ঘুরে দেখতে।
‘বুঝলি, এই গ্রামে ভূত আছে। ভালো ভূত।’
‘ভূত মানে কী বাবা?’
‘ভূত মানে ভূত। এর কোনো মানে নাই। বাবাকে একবার একটা ভূতে ধরেছিল।’
‘হি হি হি।’
যা শুনে তাতেই হাসে পদ্ম।
ঘুরতে ঘুরতে এক বাড়ির উঠোনে এলো বাপ-মেয়ে। বাড়ির জিনিসপত্র সব ছড়ানো ছিটানো। উঠোনে এক বুড়ো রোদ পোহাচ্ছেন। সম্ভবত ভিটে ছেড়ে সবাই চলে যাচ্ছে।
‘কিডা?’
‘জি, আমি সামসুল হকের নাতি।’
‘ও।’
পোঁটলার ভেতর নিজের খেলনা গোছাচ্ছিল একটা বাচ্চা। পদ্ম তাকে দেখে এগিয়ে গেলো। সাহায্য করছে ছেলেটাকে। একটা পুরনো ট্রাংক খোলার চেষ্টা করছে দুজন। নাঈম এসে হাত লাগালো।
‘আস্তে আস্তে। ও শায়লাবানু। এই ট্রাংক ফালাইও না। আমার যক্ষের ধন ওইটা।’
ভেতর থেকে শায়লাবানু (সম্ভবত বৃদ্ধের ছেলের বউ) খেঁকিয়ে উঠলো, ‘হ ওইটার মধ্যে সাতরাজার ধন! একটা বালা তো দূরে থাক, কানের দুলও পাইলাম না। নাম আবার যক্ষের ধন!’
জং ধরা বাকশোটা খুলে দিল নাঈম। সেও মনে মনে আশা করছিল দুর্লভ কিছু একটা বের হবে। কিছুই নেই বলতে গেলে। কিছু পুরনো হিসাবের খাতা, আর একটা ফ্রেমে বাঁধাই করা হাতে আঁকা ছবি। ছবির পাশে মরচে পড়া একটা জ্যামিতি বাক্সের মতো কৌটা।
ছবিটা দেখেই দশ বছরের পুরনো হাহাকার বেজে উঠলো নাঈমের বুকে। ছবির মেয়েটাকে সে চেনে। আহা পদ্মলতা!
‘ওইটা আমার দাদি।’
‘আপনার দাদির নাম কি পদ্মলতা?’
বুড়ো শূন্যদৃষ্টিতে কী যেন ভাবলো। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘কিছু ইয়াদ নাই। কিছু ইয়াদ নাই।’
‘বাবা, আমার নাম পদ্ম! আমার নাম পদ্ম!’
‘হ্যাঁরে, তোর নামই পদ্মলতা। আর কারো না।’
ছবিটা নিয়ে নেবে কিনা ভাবলো নাঈম। কিন্তু বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আবার রেখে দিল। মনে মনে বলল, ‘বিগ কোইনসিডেন্স। হতেই পারে। হয়তো আমি এই ছবি আগেও দেখেছি। বা মিলে গেছে কোনোভাবে। হতেই পারে।’
এবার জ্যামিতি বাকশের মতো দেখতে চারকোনা কৌটাটা হাতে নিল। চাপ দিতেই খুলে এলো। মিষ্টি আর পুরনো মিলে অন্যরকম একটা গন্ধ। প্লাস্টিকে মোড়ানো বস্তুটা দেখেই কেঁপে উঠলো নাঈম। অস্পষ্ট হলেও পরিষ্কার পড়া যাচ্ছে চকোলেট কোম্পানির নামটা।