Sunday, December 22
Shadow

স্বামীর কথায় শাড়ি পরা বনাম প্রেম : অবনিতা রায়ের কলাম

আমার বন্ধু ইফাত। তার শাড়ির কালেকশনটা ঈর্ষণীয়। শাড়ি কেনে ঠিকই। তবে ভাঁজ করে আলমারি ভরায়। কালেভদ্রে অকেশনে বা বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে পরে। সেই অবনিতার সঙ্গে এই শাড়ি নিয়ে তার স্বামীর একবার লেগে গেল ধুন্ধুমার। আমি আগেই বলে রাখি, নারীবাদ বা পুরুষবাদ বা সমাজবাদ এসব আমার জীবন থেকে বাদ। আমি চলি আমার ইথিকসে। আমার কাছে যেটা ভালো তো সেটা ভালো। যেটা চাই না তো সেটা চাই না। তবে আবার আমার খারাপ লাগার কারণে যদি কাছের বা দূরের মানুষের কোনো না কোনো উপকার হয় তবে সেটা ভিন্ন কথা। যেমন আমার বয়ফ্রেন্ডের চাওয়া হলো তার সঙ্গে ঘুরতে টুরতে হলে তার একটু হাত ধরতে হবে, একটু ঢলাঢলি ধরাধরি এসব চলবে। আমি সরাসরি জানতে চাইলাম, এসব কি আমাদের প্রেমের সম্পর্কের ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে পড়ে? সে বলল, হলে হবে না হলে নাই। আমার ভালো লাগার বিষয়টা বললাম। একই কথা তুমি বললে আমি না করতাম না। আর যদি তুমি বলো তাহলে কাল থেকেই সংসার শুরু করতে পারি। সত্যি বলতে কি, বিষয়গুলোতো আমিও উপভোগ করি এবং আমার বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরা বা নিদেনপক্ষে একটা দুটো চুমুটুমুতে আমার সত্যিই আপত্তি নেই। হোক না। চুমু তো আমিও খাচ্ছি। ওর হাত তো আমিও ধরছি। আমারও ভালো লাগছে। সো হোয়াট।

আবার আসি অবনিতার প্রসঙ্গে। অবনিতার স্বামী কথা বলে কম। একদিন কথাপ্রসঙ্গে চলেই এলো যে অবনিতা স্বামীর কিছু ব্যাপার একেবারেই মেনে নিতে পারছে না। তার কাছে অনেককিছুই ‘অস্বস্তি’র লাগছে। আমি বললাম, অফিস শেষে চল কোথাও বসি। আলাপ করি। তর্কে বহদূর হলেও আলাপে সমাধান আছে বটে।

Abanita Roy
Abanita Roy

অবনিতার ‘সমস্যার’ সারসংক্ষেপটা এমন– তার স্বামীর শাড়ির প্রতি ফ্যাসিনেশন আছে। সম্ভবত দক্ষিণি নায়িকাদের শাড়ি পরার ধরন ধারণ দেখে সে চায় তার স্ত্রীও তার সামনে সেভাবে পরুক, সেভাবে চলুক। কোমার না দোলাক, অন্তত রোমান্সটা হোক। শাড়িপাগল অবনিতার এতে দারুণ ইগোতে লেগেছে। ‘আমার কাপড় পরাপরি আমার কাছে। ওর কথামতো পরবো নাকি! শাড়ি আমার ভালো লাগে, তাই বলে ওর কথামতো পরে বসে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগবে। নিজেকে পণ্য পণ্য মনে হবে। মডেলরা শাড়ি পরে পোজ দেয়, এটা তাদের পেশা। টাকা পায়। এতে সংসার চলে।

আমি বললাম, মডেলদের তো জোর করে পরাচ্ছে না। সানন্দে পরাচ্ছে।

‘তা পরুক। আমি পারবো না। ওর কথামতো ওভাবে শাড়িটাড়ি পরলে আমার নিজেকে থার্ড ক্লাস মনে হবে।’

‘ক্লাস বিচার করিস কী দিয়ে? অফিসের পার্টিতে তো পরিস।’

‘অফিস আর সংসার তো এক না। অফিসে সবাই পরে। এটা ড্রেস কোড থাকে। সেখানে পরতেই হবে। ইচ্ছা না থাকলেও পরতে হবে।’

‘ইচ্ছা না থাকলেও পরতে হবে কেন? শাড়ি না পরে অফিস পার্টিতে গেলে চাকরি থাকবে না? এটা চাকরির শর্ত?’

‘তা না। তবে সেটা অফিস।’

‘তাহলে তো তোর স্বামী (ধরা যাক নাম শুভ) শুভও বলতে পারে, এটা সংসার। সংসারেরও ড্রেস কোড থাকা উচিত। তুই ওকে পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে বলতে পারিস বা নাও পারিস। সেটাও একটা ব্যাপার।’

‘কিন্তু ওর কথামতো পরবো কেন। ও আমাকে কাপড় পরানোর কে? আমার মন চাইলে পরবো।’

‘ওকে পছন্দ করিস?’

‘দেখ, পছন্দ বা ভালোবাসলে সব করতে হবে এমন কথা নেই। ওকে পছন্দ করি বলে তো ওর কথা মতো আমি কাউকে খুন করবো না তাই না?’

‘তার মানে তোর মতো করে একটা ডেফিনিশন আছে এক্ষেত্রে।’

‘অবশ্যই আছে।’

‘ঠিকআছে। শুভর কথামতো শাড়ি তুই পরলি না। এতে শুভর একটা ইচ্ছা পূরণ হলো না। তাই তো। এখন সেও তার মতো করে সম্পর্কের ডেভিনিশন তৈরি করে অনেক কিছুতে না করতে পারে। আমি যতদূর জানি সে তোর চেয়ে ঢের বেশি আয় করে। সংসারের অনেক খরচ চালায়। আধুনিক মানুষ হিসেবে অবশ্য এটা তু্ই ও শুভ দুজনই দাবি করতে পারিস যে সংসারে যেহেতু দুজনের ডেফিনিশনে চলবে, তাই সবকিছুতে ফিফটি ফিফটি হবে, তাই না?’

‘কিন্তু কম্প্রোমাইজ তো থাকবে। ও একটু বেশি আয় করতে পারছে। তাই খরচ বেশি করবে। এটুকু হলো কম্প্রোমাইজ। এ কম্প্রোমাইজের সঙ্গে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে শাড়ি পরাটাকে কি মেলাতে পারিস? যা কিনা আমি মোটেও এনজয় করবো না?’

আরও পড়ুন

জীবনের কঠিন সমস্যা ও সেগুলোর সমাধান

7 ways to overcome the monotony of relationships

দু’জনে ভালো থাকুন

What is the secret of a happy married life?

অবনিতার এ কথায় আমি আটকে গেলাম। এটা ঠিক, যা অবনিতা এনজয় করবে না সেটা শুভ যদি এনজয় করে থাকে তবে শুভর দিক থেকে মানসিক একটা দীনতা থেকে যায়। যার মানে হলো শুভর ‘ভালবাসা’ বা প্রেমে গলদ আছে।

‘ওকে শাড়ি পরিস না। এভাবেই চলুক।’

অবনিতা এলো আসল কথায়।

‘আরে এখানেও তো সমস্যা। শুভ এখন রাগ করে। ঘুমের ওষুধ খায়। ওর ধারণা আমি ওকে কেয়ার করি না। ওর সবকিছুতেই আমার না। তাছাড়া অফিসে শাড়ি পরেছি বলেও ও কথা শুনিয়েছে।’

‘সেটা বলতেই পারে। অফিস তো অবশ্যই শুভর চেয়ে বড় কিছু, এটা শুভকে বুঝতে হবে। অফিস তোকে মাসকাবারি বেতন দিচ্ছে। তোকে সাবলম্বী করছে। সুতরাং শুভ পরে আগে অফিস।’

‘আমি কিন্তু সেটাও বোঝাতে চাইনি।’

‘সব নৌকায় একসঙ্গে পা রাখতে পারবি না অবনিতা। তুই মেনে নে যে অফিসের পার্টিতে তুই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরতে বাধ্য। সেখানে টাকার কাছে তুই অনেকটা জিম্মি। শুভর প্রতি তোর প্রেম বা ভালোবাসার কাছে তুই জিন্মি না। মন চাইলে শাড়ির পরবি না চাইলে না। তা, মাসে এক দুইবার না হয় ওকে খুশি করার জন্য…।’

‘না, তাতেও আমার মন সায় দেয় না। তারচেয়েও বড় কথা তুই কিন্তু সব প্রেম বা ভালোবাসাকে এক স্কেলে মাপতে পারবি না।’

‘তা ঠিক। তোর ভালোবাসা তোর কাছে। শুভরটা শুভর কাছে। আমার কাছে আবার মনে হয় আমার রবিবাবু যদি আমাকে অন্তর্বাস পরেও ঘুর ঘুর করতে বলে আমি করবো। ব্যাপারটা আমার ইগোর প্রশ্ন না। ও যদি এভাবে আমাকে চায়, তবে সেখানে আমারও কিঞ্চিৎ (একটু বেশিই) আনন্দ আছে। টিনএজ প্রেমিকাদের দেখিস না! ওরা কেমন পাগল পাগল হয়। আমারও অমন প্রেমিকা হতে ইচ্ছে করে। আর আমি নিশ্চিত রবি আমাকে দারুণ ভালোবাসে। সেবার জ্বর হলো, সারারাত ঘুমায়নি বেচারা।

‘শুভ আমার মনে হয় দূরে সরে যাচ্ছে। ঘুমের ওষুধ এটা সেটা আর রিল্যাক্সেশন ট্যাবলেট খায়।’

‘খাক না! এটা তার ইগো কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতায় পড়ে। তোর আছে শাড়ি, ওর আছে ওষুধ। সমস্যা কী?’

‘আমি জানি না।’

‘তোদের মূল সমস্যা হলো প্রেমটা জমার আগেই, দুজন দুজনকে বোঝার আগেই, দুজন দুজনকে খুব করে চাওয়ার আগেই বিয়ে করে ফেলেছিস। এমনও হতে পারে, এমন কোনো ছেলে হয়তো ছিল, যার সঙ্গে তোর বিয়ে হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। তুই-ই তাকে খুব করে চাইতি, যেমনটা শুভ তোকে চায়। এখন সেটা বলেও লাভ নেই। এক বাচ্চার মা-ও হয়েছিস। সব মানিয়ে নিতে হবে, তাই না রে!’

‘এভাবে চলতেও পারছি না।’

‘এটার সমাধান আছে। জলের মতো টলটলা সমাধান।’

‘কী সেটা।’

‘তোর কাছে শুভ হলো পারভার্ট প্রকৃতির। অবচেতন মন সেটাই বলে। তা না হলে প্রচণ্ড ভালোবাসার মানুষের সামনে শাড়ি পরলি, না বিকিনি তাতে কী যায় আসে। এর জন্য শুভকে ঘুমের ওষুধ পর্যন্ত খেতে হচ্ছে। আবার শুভও স্যাক্রিফাইস করতে পারত বিষয়টা। ও স্যাক্রিফাইস করতে পারছে না কারণ ও মেনে নিতে পারছে না যে তুই ওর কথার দাম দিচ্ছিস না। এখানে শাড়ি বা কাপড় বা বিশেষ কোনো এফেকশন চাওয়াটা নেহায়েত একটা উপলক্ষ।’

‘এখন করার কী আছে?’

‘তোর মন কী চায়?’

‘আমি চাই শুভ নরমাল থাকুক।’

‘নরমালের একটা সংজ্ঞা দে। করে না কো ফোঁসফাস, মারে না কো ঢুসঢাস?’

‘অনেকটা তাই।’

‘তাহলে সেটা তাকে বল।’

‘সে এটা মানবে না। বলে তোমার কাপড় তোমার কাছে, আমার লাইফস্টাইল আমার কাছে। সামনে নামি মদটদও খাবে।’

‘তাহলে তো ডিভোর্সের দিকেই গড়াবে।’

‘আমি তা চাই না।’

‘এখানে তো দেখছি তোর চাওয়ার পাল্লা বেশি ভারি। এত চাই না, চাই, চাই না করছিস কেন? শুভ তো এখনও ফৌজদারি অপরাধ করেনি বা সে ওমেনাইজারও না। অন্য নারীর প্রতি তো তার আকর্ষণ নাই যতদূর জানি।’

কথাবার্তা আর গড়ালো না। কারণ রিপিট হচ্ছিল সব। অবনিতার কনফিশনটা কনফিউশনই রয়ে গেল। আমিও খেই হারিয়ে ফেললাম। বুঝলাম, অবনিতা একা নয়। এমন হাজারো লাখো অবনিতা আছে। কনফিউশনে থাকতে থাকতে এরা লাভ-লাইফ কী জিনিস ভুলে যায়। পরে এরা তাদের ছেলেমেয়েকেও সেসবে ঘেঁষতে দেয় না।

তো, সমাধান কী?

আমার একবার মনে হয় ডিভোর্সই সমাধান। দুজন দুজনের তো আবার খুঁজে নিক কাউকে। সেটার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। আর না হয় সরাসরি নিজেদের গণ্ডিটা পরিষ্কার করে দিক। এটা হলে আমি আছি, এটা হলে আমি নেই। আমি বাপু আপাতত নিউট্রাল গিয়ারে গাড়ি ছেড়ে ভাগি। আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ। আলাপ আসতে না পারলে কনফিউজডরা যা খুশি করুক। দেশজাতির তাতে কিছু যায় আসে না।

(আমাদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে মাত্র ১০ টাকা দিয়ে অংশ নিতে বিকাশ করুন 01976-324725 নম্বরে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!