প্রথমেই বলে নিই, সংসারের খরচ কমানোর টিপস সংক্রান্ত লেখাটি সেইসব নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য, যারা সত্যিই কষ্ট করে চলছেন। অনেকের পকেটেই যথেষ্ট টাকা আছে, কিন্তু মুখে পেঁয়াজ আর সয়াবিন তেলের দাম নিয়ে খুব চিন্তা দেখান, তাদের জন্য আসলে এ লেখা কাজে আসবে না। কাজে আসবে তাদের জন্য, যারা সত্যিকার অর্থেই মোটামুটি দুশ্চিন্তা ছাড়া বেঁচে বর্তে টিকে থাকতে চান।
সংসার চালানোর কথা উঠলে আমাদের মাথায় অনেক চিত্র ভেসে উঠে। কিন্তু সবই ভাসাভাসা। চাল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পেঁয়াজ, বেগুন, তেল– এ তালিকা বড় হতেই থাকবে। প্রথমেই দুশ্চিন্তাটা থামান। দুশ্চিন্তা আপনার ডাক্তারের বিলও বাড়াবে। দুশ্চিন্তা করে যে সময়টা নষ্ট করছেন, সে সময় একটা কিছু করে চাইলে ক’টা টাকা বাড়তি ইনকাম করা যায়। তাই দুশ্চিন্তা বন্ধ করুন।
এখন ভাবছেন, দুশ্চিন্তা করলাম না, তো টাকা কি আপনি দেবেন? উত্তর হলো, না। টাকা আমি বা গৌরি সেন, কেউেই দেবে না। আপনার সংসারের খরচের টাকা আপনাকেই ম্যানেজ করতে হবে। তাই পরিষ্কারভাবে বলছি, নিজের টাকা যেহেতু নিজেকে আয় করতে হবে, তাই আপনার জীবন কীভাবে চলবে, কী খাবেন, মেহমান এলে তাকে বেগুনি দিতে হবে কিনা, তেল বেশি দিয়ে গরুর মাংস রান্না করতে হবে কিনা, এসবও আপনার নিজের ব্যাপার। দুশ্চিন্তার সঙেগ সঙ্গে যাবতীয় ফরমালিটিস ঝেড়ে ফেলুন। মনে করুন, আপনি একটা দুর্যোগের মধ্যে আছে। আপনাকে সারভাইব করতে হবে। টিকে থাকতে হবে। যে করেই হোক, আপনার ও আপনার সন্তানদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হবে।
সব কিছুর তো দাম বাড়ছে, তাই না? সব পণ্যের দাম বাড়ছে। সব সেবার দাম বাড়ছে। ডাক্তারের ফি বাড়ছে। আরও কত কী। তো, সবার আগে আপনি আপনার দাম বাড়ান। নিজেকে এই জগত সংসারের যোদ্ধা বানান। আপনি যে কাজে আছেন, সেখানে আপনার দাম বাড়ান। আপনার দাম বাড়ছে না? তাহলে কিছু করার নেই। আপনার নিজের যোগ্যতা, মেধা এসব কার কাজে লাগছে? তাকে বলুন, এখন থেকে এসবের দাম বাড়তি।
এটা শুনতে কল্পকাহিনির কথাই মনে হতে পারে। যারা ভুক্তভোগী তারা আসলে নিজের দাম বাড়াতে পারেন না। বাড়াতে গেলে ভয় পান। এমন একজন দুজন করে লাখ লাখ মানুষ আছে। এদের আমরা বলি সাধারণ ভোক্তা। এদের দাম কেউ বাড়তে দিতেও চায় না। কারণ একটাই, এরা প্রত্যেকেই আলাদা একটি দ্বীপের মতো থাকে।
সংসারের খরচ কমানোর টিপস : দরকার ভোক্তার সিন্ডিকেট
কাঁচাবাজারে অতি সাধারণ মুলা থেকে শুরু করে বেগুনের বেপারিরাও কী সুন্দর একাতবদ্ধ! আমরা গাল দিয়ে বলি, সিন্ডিকেট!
তো, আপনারা যারা ভুক্তভোগী, তারাও একটা সিন্ডিকেট করছেন না কেন! আপনারা আলাদা আলাদা সবাই বসে থাকবেন, আর ভাববেন, আকাশ থেকে দ্রব্যমূল্যের তালিকা টুপ করে নিচে পড়বে আর সব ব্যবসায়ী তা মেনে নেবে? মোটেও না। সিন্ডিকেটের জবাব তাই সিন্ডিকেটেই দিন। ব্যবসায়ীরা কী সুন্দর এক হয়ে বসে ঠিক করে ফেলে, আজ চিনির দাম ১১০ টাকা। তো আপনারাও শখানেক লোক মিলে ঠিক করুন, আজ থেকে চিনি বাদ। চিনি কম খাবো। চিনি খাবোই না। টাকা তো বাঁচবে, সঙ্গে শরীরটাও।
আবার পাড়া মহল্লায় চায়ের আড্ডা থেকে আপনার অফিস; সবাই সবার সঙ্গে কথা বলুন, যারা আপনার মতো অবস্থায় আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলুন, গ্রুপ গড়ে তুলুন। সেটার একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিন। তারপর সবাই মিলে সেই গ্রুপটাকে আরও বড় করুন। যারা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে অযাচিত মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে গ্রুপ থেকে বাদ দিন বা শুরুতেই বয়কট করুন। এভাবে পাড়া বা মহল্লা কেন্দ্রিক ভোক্তা সিন্ডিকেট করুন। তারপর ঠিক করুন, আগামী এক সপ্তাহ আমরা কেউ বেগুন কিনবো না, কিংবা ৫০০ টাকা দিয়ে তরমুজও কিনবো না। ব্যবসায়ীদের কাছে কঠিন একটা মেসেজ পাঠান, আমরা কোনো অপচয়ে নাই। দাম এদিক ওদিক হবে তো, গতবারের মতো এবারও বস্তায় বস্তায় পেঁয়াজ পচবে।
যে কারও তার উৎপাদিত পণ্য ও সেবার দাম কমবেশি চাওয়ার অধিকার আছে। কিছু পণ্যের সরকার নির্ধারিত দাম থাকে। তবে বেশিরভাগ পণ্যেরই থাকে না। এসব ক্ষেত্রে ভোক্তা সিন্ডিকেটই পারে দাম ঠিক করে দিতে। আপনাদের গ্রুপটা ভারী হলেই দেখবেন অনেকে নড়েচড়ে বসবে। বিশেষ করে অনলাইন ও ফেসবুকের এ যুগে তো এমন গ্রুপ করা তো কোনো সমস্যাই নয়।
ভোক্তাদের সমিতি ও এক হাতে সবার বাজার
এখন তো সংবাদের কারণ সবারই জানা যে, কৃষকের ১৫ টাকার বেগুন কী করে ঢাকায় ১০০ টাকা হয়। কৃষকের হাত থেকে মধ্যসত্ত্বভোগী, তারপর পরিবহন, তারপর আড়ত, তারপর খুচরা ব্যবসায়ীর লাভ, অপচয় ও ভ্যানভাড়া মিলেই চূড়ান্ত দাম ঠিক হয়। অথচ আপনারা মাত্র ১৫-২০ জন একাট্টা হলেই এর সমাধান হয়ে যায়। দরকার শুধু একটা প্ল্যান। কীসের প্ল্যান? আপনারা ১৫-২০ জন একসঙ্গে ঠিক করুন, আগামী এক সপ্তাহ কী কী সবজি কী পরিমাণ করে কিনবেন। সবজির পাশাপাশি মাছ-মুরগিরও একটা হিসাব করুন। হিসাব করুন আরও যত বাজার-সদাই আছে সেটারও।
তারপর সেই হিসাব নিয়ে প্রতি সপ্তাহে একজনকে দায়িত্ব দিন বাজারের। প্রয়োজনে ঢাকার বাইরের কোনো আড়তের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাকে বুঝিয়ে বলুন। বলুন আপনাদের সমিতির কথা। সদস্যদের কথা। তারপর সম্পর্ক যখন পোক্ত হবে, তখন সরাসরি ওই আড়তদারকে টাকা দিয়ে দেবেন, সে আপনাদের সাপ্তাহিক সবজির বস্তা পাঠিয়ে দেবে কুরিয়ার কিংবা পরিবহনে।
এটাকে বেশি ঝামেলার মনে হলে প্রতিদিন কেউ না কেউ বাকি সবার বাজারের দায়িত্ব নিন। ঢাকায় থাকলে সোজা চলে যান কাওরানবাজারে। ঢাকার বাইরের লোকজনও যেতে পারেন আড়তে। সেখানে গিয়ে পাল্লা ধরে কিনে নিন সবজি, মাছ এসব। তারপর সদস্যদের চাহিদা অনুযায়ী সেটা হোম ডেলিভারি দিয়ে দিন। আজ আপনি বাজার করলেন তো পরদিন আরেকজন করবে। এ কাজে লজ্জা শরম, দ্বিধা এসব ঝেড়ে ফেলতেই হবে। আবারও বলি, পকেট আপনার, টাকা আপনার, কষ্টও আপনার। আরেকজন কী বললো, তা শোনার টাইম হবে?
সংসারের খরচ কমানো সংক্রান্ত আরেকটি লেখা লিখবো অচিরেই। পরবর্তী লেখার টপিকস: সংসারের বাজেট ও টাকা বাঁচানোর যত পথ।
মাটিনিউজের সাথে থাকুন। সাইটটি সাবসক্রাইব করে নিন। কারণ মাটিনিউজ খুব শিগগিরই সংসারের খরচ বাঁচানোর কিছু পরামর্শ ও এ সংক্রান্ত যোগাযোগের বিস্তারিত নিয়ে হাজির হবে।