Thursday, April 18
Shadow

অতিপ্রাকৃতিক সায়েন্স ফিকশন : স্থির অথবা সময়হীনতা

ধ্রুব নীলের অতিপ্রাকৃতিক সায়েন্স ফিকশন গল্প


আজ রোববার। বাসের সুদীর্ঘ লাইন থাকার কথা আজও। গতকাল পর্যন্ত রাজধানী ছিল একেবারে নদীর মতো। বাস চলেছে নৌকার মতো তরতরিয়ে। কিন্তু ধূলোবালি গিলে বাসস্টপ পর্যন্ত যাওয়ার আগে আমি বিস্মিত হইনি। এসেই অবাক হলাম। লাইন নেই! বাস ফাঁকা। ড্রাইভার বসে আছে শুধু। একেবারে একা! আমি তড়িঘড়ি করে এক লাফে বাসে চড়লাম। বাস ছেড়ে দিল! একা আমাকে নিয়েই! সিটে বসামাত্রই চলতে শুরু করল। যেন এইমুহূর্তে কেউ একজন আমাকে কিডন্যাপ করলো। হালকা পাতলা ড্রাইভার কিডন্যাপার নয়। বাস চালানোতেই তার যাবতীয় মনযোগ।
আরো অবাক হলাম, যখন দেখি কোনো সিগনাল নেই। সিগনালের ট্রাফিক পুলিশ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কাকতাড়ুয়ার মতো। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কোনো রিকশাওয়ালা তার সহকর্মীকে মুখ খিঁচে গাল দিল না। শোনা গেল না অসহিষ্ণু কোনো গাড়ি চালকের ক্রমাগত হর্ন কিংবা হর্নের আড়ালে চাপা পড়া মোবাইল ফোনে কোনো তরুণীর বিরামহীন আহ্লাদ।
বাসে কনডাক্টর নেই। ভাড়া চাওয়ার ঘন ঘন তাগাদাও নেই। সহযাত্রীর দুই টাকা কম ভাড়া দেওয়ার পর যে বিরক্তি প্রকাশ পায় কনডাক্টরের পরবর্তী কথায়, সেটাও শুনতে হলো না।
বাস থামলো। এক ঝটকায় নামলাম। রাস্তায় অনেক মানুষ, গাড়ি, আরো সব স্থির বস্তু। অবাক হলাম এই ভেবে যে আজ আমি ঘন ঘন অবাক হচ্ছি। কোথাও শব্দ নেই। যেন রাত তিনটের ঢাকা। তাও এই সময় অর্ধনগ্ন পাগলির ছন্দময় হেঁটেচলার প্রায় নিঃশব্দের মতো একটা শব্দ থাকতো। তাও নেই। সব স্থির। সব বোবা।
ব্যাপারটা চোখে পড়লো। প্রচণ্ড ভয় পাওয়া উচিৎ। কেউ নড়ছে না। এক চুলও না। সিগনালের বাতিটা হলুদ। লাল হওয়ার জো নেই। যেন অদৃশ্য আরেকটা সিগনাল বাতিতে লাল জ্বেলেই আছে।
আমার ঠিক সামনেই যে স্ট্রাইপ শার্ট আর ঢোলা প্যান্ট পরা প্রৌড় মানুষটাকে দেখছেন, তিনি বেঢপভাবে একটা পা সামনে বাড়িয়ে দাঁড়িয়েই আছেন। পা না ফেলে একজন কতক্ষণ থাকতে পারে সে প্রশ্নটা এসে আবার চলে গেল। তারচেয়েও বড় বড় সব প্রশ্ন এসে ধুম ধুম করে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে লাগলো। ঢেউগুলো পড়ছে তো? নাকি ওটাকেও কেউ আটকে যেতে বলেছে।
আমি অফিসের কথা ভুলে গেলাম। নিশ্চিতভাবে এবং অফিসে না গিয়েও বলা যায়, অফিসটাও আটকে গেছে। আমার জন্য কোনো কাজ নিয়ে বসে নেই সম্পাদক মশাই। আজ পত্রিকা বের হবে তো? স্থির হয়ে যাওয়ার খবরটা কি থাকবে? আর সেই রহস্যময় বাস চালক?
কেউ নড়ছে না। কতক্ষণ নড়ছে না তা বলা মুশকিল। ঘড়ির দোকানের সবগুলো ঘড়ির মতো এখন সবার হাতঘড়িগুলো নিশ্চয়ই স্থির। একা পৃথিবীতে আমিই চলমান? আমি ভেবে পাচ্ছি না আমার কী করা উচিৎ। আমার কি অন্যদের মতো স্থির হয়ে যাওয়া উচিৎ?
হঠাৎ একটা শব্দ মাথায় এলো। স্বাধীনতা। আমি কি এখন পরম স্বাধীন? যা খুশি করতে পারি? নিজেকেও জবাবদিহি করতে হবে না? সবাই স্থির। আমি চাইলে যেমন রাস্তার ওপারের বিশ্রীরকম মুখ হা করে রাখা লুঙ্গি পরা মোটা লোকটার মুখে কষে চড় দিতে পারি তেমনি আবার চাইলে দামী গাড়িটার দরজা খুলে পেছনের আসনে বসে থাকা ভদ্রলোকের কানে কানে বলতে পারি, আপনার গাড়িতে আমি একটা কিছু ত্যাগ করে যেতে চাই। তারপর সত্যি সত্যি গাড়ির ছাদে উঠে সামনের দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর পর যদি কাচ বরাবর উষ্ণ প্রস্রবন বয়ে যায়, তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কাচ পরিষ্কারের দণ্ডদুটো একটুও এদিক ওদিক নড়বে না। ওগুলোও যে একদম স্ট্যাচু।
বুঝতে পারলাম আমি এখন যাই করি সেটা হবে স্বাধীন মানুষের কাজ। স্বাধীন মানুষ কী করে তা বুঝতে হলে আমাকে এখন একটা কিছু করতে হবে। মুহূর্তের মধ্যে স্বাধীনতাকে ভীতিকর মনে হলো। এটা কি স্বাধীনতা নাকি পরম পরাধীনতা, তা বুঝার চেষ্টা করতে গিয়েও পারলাম না। কিন্তু আমার চিন্তা তো স্থির হয়ে যায়নি।
ওই বয়স্ক লোকটার মতো এক পা শূন্যে তুলে আমিও স্থির হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। বেশিক্ষণ পারলাম না। মাধ্যাকর্ষণ বুঝিয়ে দিল, তুমি স্থির হয়ে যাওনি। তুমি জীবিত। তবে বাকিরা কি মৃত? নাকি সময় আটকে গেছে সবার জন্য। নাকি আমি সময়ের কোনো এক ফাঁকতালে পড়ে গেছি। বাস্তবের ফিতেটা কোথাও জট পাকিয়ে যায়নিতো? তাহলে সেই বাসচালক এলো কোত্থেকে? কিছু না বলে চলেও গেল যে।
দ্বিগবিদিক জ্ঞানশূন্যের মতো ছুটলাম কিছুক্ষণ। কিছু ঘটলো না। মানুষগুলোকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইলাম। পারলাম না। একেকটা যেন পাথরের মূর্তি। কিন্তু ছুঁয়ে দেখতেই নরম। একটা ফাস্টফুড দোকানে ঢুকে খামোকাই দুটো স্যান্ডউইচ চিবুলাম। কিছু ঘটলো না। নতুন কিছু ঘটলো না। মুহূর্তে মুহূর্তে চারপাশের যাবতীয় আটকে থাকা মানুষ ও ঘটনাহীন ঘটানাটা পরম অতীত মনে হতে লাগলো। সৃষ্টির শুরুতে কেউ আটকে থাকলে তার কেমন লাগতো? সব স্থির। কবে চলবে কেউ জানে না। শব্দ করে বললাম টিক টিক টিক। আমার মুখের ভেতরকার ঘড়িটা চলেছে। বাকি সবগুলো ঘড়ি অচল। প্রকৃতির ঘড়ি নিশ্চয়ই চলছে। কেননা আমার হিসেব মতে বড়জোর ঘণ্টাখানেক বা মিনিট বিশেক হলো সব আটকে আছে। তারমানে কোথাও না কোথাও একটা সময় যাচ্ছে। আমি এখন যা খুশি ভাবতেও পারি। ওহ হো, এটা তো আগেও পারতাম। আগে এ স্বাধীনতা এভাবে এখনকার স্থির সময়ের মতো টের পাইনি।
আরো সময় গেল রহস্যময় সেই ঘড়িটায়। আমার একান্ত ঘড়ি। সময় তাতে আমার মতো করেই যাচ্ছে। মেইন রোডে চাইলে একজোড়া বালিহাঁস এনে রেখে দিতে পারি। ইচ্ছে করলো মোড়ের এক কোণে সামনের চাকা আকাশমুখী করে রাখা মৃত রিকশাগুলোকে সোজা করে দিয়ে আসি। কাকতাড়ুয়া ট্রাফিক কিছু বলবে না। আর ওই যে বড় ভবনটায় যে সেমিনার চলছে, সেখানে গিয়ে টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে ধেই ধেই করে নেচে নেচে খিস্তিখেউড় বলতে পারি। কোনো কিছুই মন্দ হয় না। আবার স্থির মানুষগুলোর অভিব্যক্তি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত সম্ভবত কোনো কিছুর মানেও হয় না।
আমার হিসেবে আরো সময় গেল। চাইলে আমি সময়টাকে এক দিন কিংবা এক সহস্র বছর বলে ফেলতে পারি। কেননা, সব স্থির ছিল। কতক্ষণ স্থির ছিল সে প্রশ্ন কেউ করবে না। তাই এটা কোটি বছরও হতে পারে। আমি নিজেই একসময় ভুলে গেলাম কতক্ষণ স্থির ছিল। আমার বয়স বাড়ছে না। সূর্যটা আটকে আছে। মধ্যবয়সী সেই লোকটা এখনো এক পা উঁচুতে তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
সময় যাচ্ছে। হয়তো সময়টা নিজে থেকেই যাচ্ছে না। কত বছর ধরে সময়টা স্থির তা বলা একারণেই সম্ভব নয়। আর অবধারিতভাবে মনে হলো, আমি নিজেও স্থির হয়ে আসতে শুরু করেছি। আমার সময়টা স্থির অথবা সময়ের মাঝে আমার অস্তিত্ব নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!