Friday, March 29
Shadow

রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১১)

রোমান্টিক উপন্যাস ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃধ্রুব নীলের রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১১)

রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১০)

রোমান্টিক উপন্যাস : ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ (পর্ব-১)

রোমান্টিক ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ (পর্ব-২)

১১
দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ। কিন্তু কটা বাজছে বুঝতে পারছি না। ঘোর টোর লাগেনি। ঘড়ির ডিজাইন এমনভাবে করা যে সেকেন্ডের কাঁটা ঘণ্টার কাঁটা আলাদা করা মুশকিল। দুটোরই এক সাইজ। বারোটা দশ বাজে নাকি দুইটা, বুঝতে পারছি না।
পিঠে ধাক্কা লাগতেই উঠে দাঁড়ালাম।
‘বাস ছাড়বে। উঠ।’
আমার বন্ধু মঞ্জু। ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে বেড়ায়। সারা বছরই ছুটি কাটানোর আমেজে ঘুরে বেড়ায়। মঞ্জুর সঙ্গে আমিও একটু বোহেমিয়ান হওয়ার চেষ্টায় আছি। বিয়ে টিয়ে করিনি। আয় রোজগারও খারাপ না। এদিক ওদিক হুট করে ঘুরতে যাওয়াটা নেশা হয়ে গেছে আমাদের।
বাস ছাড়বে সোয়া বারোটায়। ব্যাপক আরামদায়ক বাস। শুয়ে ঘুমানো পর্যন্ত যায়। কিন্তু সিট বেল্ট নেই। মনের খুঁতখুঁতে ভাবটার কারণে আমার ঘুম পেল না।
আধ ঘণ্টা না যেতেই মঞ্জু ঘুমে কাদা। আমি জেগে আছি রাতের পাখির মতো। দামি বাসে শব্দ কম। মনে হচ্ছে ভেসে ভেসে এগোচ্ছি। এর মধ্যে জুলাই মাসের ঘোর বরষা। বৃষ্টির ছাঁটে বাইরের কোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। তবে বার বার যেন কার মুখটা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে খুব। মাকে আমি খুব মিস করি। উঠতে বসতে এমন ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকলেও। মায়ের কবর দেখতে যাই না অনেকদিন। কারণ আমি জানি সেখানে গেলেই একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাব। সেই ঘোর কাটাতে আমাকে আরো আরো ক্লোনাজেপাম খেতে হবে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ।
এখন কোথায় যাচ্ছি জানি না। মঞ্জু আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। ওর ধারণা আমার বিরাট কিছু হয়েছে। আমার মাথা ফ্রেশ করতে নিয়ে যাচ্ছে কোনো গ্রামেগঞ্জে বা সমুদ্রে। ইদানীং আর সমুদ্রটাও ভালো লাগছে না। গ্রামের বাঁশঝাড়ের পাশের কোনো এক পুকুর বা খালের পাড়ে বসে কচুরিপানার ফুল দেখতে পারলে ভালো হলো। আমার মনে পড়ল, ওই হালকা বেগুনী রংটাই আমার প্রিয় রং।
বাস থামলো একটা স্টপেজে। ব্যাগ কাঁধে চড়িয়ে নেমে পড়লাম দুজন। জায়গার নাম জানতে চাইলাম না। মঞ্জু এদিক ওদিক তাকিয়ে দ্রæত একটা ইঞ্জিনওয়ালা ভ্যান ঠিক করে নিল। ওতে আরো প্যাসেঞ্জার আছে। ভ্যানের ঠিক মাঝে একটা ছাগলও আছে। গাদাগাদি করে বসলাম। আমার প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে একটু ঝাঁকুনি খেলেই আমি ভ্যান থেকে পড়ে যাব। পড়লাম না। একটা জায়গায় এসে নামলাম। সামনে নদীর মতো। শাখানদী হবে। বর্ষায় পানির অভাব নেই। নদীর পাশে অনেকগুলো দোকানপাট। সেখানে একটায় বসলাম। মঞ্জু পরোটা আর ডিম ভাজির অর্ডার করলো।
‘পাশেই সরকারি পাবলিক টয়লেট। যা সেরে আয়।’
‘আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো মঞ্জুর আদেশে চলছি। সে এখন আমার অভিভাবক। তার কথার অবাধ্য হওয়া চলবে না।’
নাশতার পর হাঁটতে বের হলাম। মঞ্জু বারবার আমাকে খোঁচা দিচ্ছে। ‘কই, তুই না ছবি আঁকবি। ইজেল বসাবি কোথায়? জিনিসপত্র বাইর কর।’ আমার অস্বস্তি লাগছিল। নদী থেকে বের হওয়া একটা খাল ধরে হাঁটছিলাম। তাতে লাল শাড়ি পরা একটা মেয়ে গোসল শেষে চুলের পানি ঝাড়ছে। দৃশ্যটা কাছ থেকে দেখে দেখে আঁকতে পারলে ভালো হতো। কথাটা বলতেই মঞ্জু গটগট করে এগিয়ে গেল মেয়েটার দিকে। মঞ্জুর কথা শুনে মেয়েটাও দৌড়ে পালাল। চলে গেলে যাক। সমস্যা নেই। আমার মাথায় ক্যামেরা সেটা করা আছে। সেখানে ছবিটা তুলে রেখেছি। ইজেল বসিয়ে আঁকতে শুরু করে দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমাকে ঘিরে লোকজন জমে গেল। কাগজের ওপর রঙের ওয়াশ দেওয়ার পর আরেকটু গভীরে রং বসাতেই নদী আর দূরের ধানক্ষেতটা যখন পরিষ্কার হলো তখন অনেকেই ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো উনি দেহি আর্টিশ। কিন্তু এই মাইয়াটা আইলো কই থেইকা। আমরা তো কোনো মাইয়ালোক দেখতেসি না। বাই আপনি এই মাইয়াটারে পাইলেন কই।’
‘মেয়েটা গোসল করে চুল শুকাচ্ছে। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না?’ উপস্থিত জনতা হেসে উঠল। তাদের হাসিটা দেখে মনে হলো আমি এ গ্রামেই থেকে যাই। গ্রামে থাকবো আর ছবি আঁকবো। সেই ছবি বিক্রি হবে ঢাকায়, ইউরোপে। গ্রামের লোকজন এসব এমনিতেই দেখে, তাদের আলাদা করে ছবি দেখতে হবে না।
ছবি আঁকা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা কেউ নড়ল না। ছবি আঁকা শেষ হতেই চলে গেল। শো শেষ। হল ভেঙেছে। এবার খই ভাজতে হবে। এ গ্রামে আসার পর থেকেই মঞ্জু আমাকে খই খাওয়াচ্ছে। আর একটু পর পর একটা করে সিগারেট ধরাচ্ছে।
‘একটা বাড়িতে ওঠা দরকার। এইখানে হোটেল ফোটেল নেই।’ সিগারেট ছুড়ে দিতে দিতে বলল মঞ্জু। আমি কিছু বললাম না। কিছুক্ষণ পর মনে হলো বলি, আমি এ গ্রামেই থাকবো। দেখ, কেউ বাড়িঘর বিক্রি করবে কিনা। ব্যাংকে অনেক টাকা জমেছে। বাড়ি কিনে ফেলি। পরে মনে হলো মঞ্জু এতে কষ্ট পাবে। সে চায় ঘুরে বেড়াতে। আমার একমাত্র বন্ধু। তাকে কষ্ট দেওয়ার কী দরকার।

বিকেলের মধ্যে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলল মঞ্জু। কে জানে কী বলেছে। সে আবার অপরিচিত লোককেও আমার পরিচয় করিয়ে দিতে চায় নানাভাবে। ‘জানেন না তো ভাই, ঢাকার বিরাট সাংবাদিক। নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে ওঠাবসা। এই দেখেন ফেইসবুকে ছবি। তারউপর বিরাট শিল্পী। তার আঁকা ছবি ইউরোপ আমেরিকায় বিক্রি হয়। বাঙালির কাছে শিল্পী হইল পোকায় খাওয়া দাঁতের মতো। সময় থাকতে মর্ম বোঝে না।’
মঞ্জুর পরিচয় দেওয়ার সময় আমি বিপদে পড়ে যাই। সে কখন কী করে বলা মুশকিল। আমি তাই সংক্ষেপে বলি, আমার বন্ধু মঞ্জু। সে তাতেই বর্তে যায়।
মঞ্জু নিশ্চয়ই আমাকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে গল্প ফেঁদেছিল আড়তদার ফকির মুন্সির বাড়িতে। তা না হলে একটা বিয়েবাড়িতে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করাটা বিরাট ব্যাপার। ফকির মুনসির দুই মেয়ে। জানতে পারলাম, বিয়ে হবে ছোট মেয়ের। বড় মেয়ের নাকি কী জানি ‘দোষ’ আছে। মানসিক প্রতিবন্ধী হতে পারে। গ্রামের লোকজন এসব সহজে নিতে শেখেনি এখনো। আমাদের সঙ্গে তার দেখা হয়নি অবশ্য।
ছোট মেয়েটাকে দেখলাম খুব তোলপাড় চালাচ্ছে। আমাকে এসে একবার বলে গেল, তার সঙ্গে যেন তার স্বামীর একটা ছবি এঁকে দেই।
ঘটনাগুলো দ্রæত ঘটতে শুরু করলো। আমার বারবার মনে হতে লাগল এমন ঘটনা আগেও কোথায় যেন ঘটেছে। তবে আগে বিয়ে হয়েছিল আমার, এবার হচ্ছে অন্য আরেকজনের। আমার বিয়ের কথা মনে হতেই লুনার কথা মনে পড়ে গেল। পনের বছর হলো তার সঙ্গে দেখা হয় না। স্বামী আর তিন কন্যা সন্তান নিয়ে দারুণ সংসার তার। আমার কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। আবার হয়ত ঠিক স্বাভাবিক না। সবই মনে রেখেছে। বরং বলা উচিৎ যে আমার কথা তার ভুলে যাওয়ার ভান করাটা স্বাভাবিক।
আমি আবার ভান করতে পারি না। আমার সবই মনে আছে। নিয়মানুযায়ী প্রথম প্রেম হিসেবে লুনা আমার মনে ঠিক আগের অবস্থাতেই আছে। একটুও বদলায়নি।
‘বড় বইনটার নাকি মাথা খারাপ। কিন্তু মহা সুন্দরী। মনে কর, আমাদের সাবিনাও ফেইল।’
‘সাবিনাটা কে?’
‘আরে ভার্সিটির সেই সাবিনা। যে তোর প্রেমে হাবুডুবু খাইল। তারপর তো বেচারি আরো বেশি হাবুডুবু খাওয়ার জন্য এক ডুবুরিকে বিয়ে করে ফেলল।’
‘ওহ, ডুবুরি না, ছেলেটা নেভিতে আছে।’
‘ওই আর কি, আমাকেও তো পাত্তা দিল না। আমিও তো অফার দিয়েছিলাম।’
‘মাথা খারাপ মেয়েটাকে তাহলে অফার দে। মাথা যেহেতু খারাপ, তোর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতে পারে।’ মঞ্জু আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরাল। আমার ইয়ার্কিতে কান দেওয়ার সময় নেই তার। সে ব্যস্ত রান্নাবান্নার আয়োজন নিয়ে। বাবুর্চি, রান্নার বড় ডেকচি এসব দেখে আমার কেবলি মনে হচ্ছিল আমার দেজা ভ্যু হচ্ছে। ফরাসি শব্দটার মানে হলো ‘আগেও যেন এমনটা ঘটেছে’ টাইপ অনুভ‚তি। কিন্তু এমনটা হবার প্রশ্নই আসে না। এ গ্রামে আগে তো আসিনি।
‘আপনেরে আমার বইনে ডাকে।’
আমি হা করে কনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ তার গায়ে হলুদ। হলুদ লাগানো ছাড়াই মেয়েটার গা থেকে হলদে আভা বের হচ্ছে।
‘ঠিকাছে বিথি। নিয়ে চলো।’
‘আমি ভিতরে যাইতে পারুম না। রেনুপা আপনার লগে একা কথা কইতে চায়।’
আমার খানিকটা ভয় ধরল।
‘ডরাইয়েন না, আপা কামড় টামড় দেয় না। আর শুকনা মাইয়া মানুষ। আপনার লগে পারবো না। ঝামেলা দেখলে চিক্কুর দিবেন। আমি কাছে গেলে সব ঠিক। আমারে আপা খুব ভালোবাসে।’
‘বিথি তোমাকে সুন্দর লাগছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি এ বিয়েতে রাজি না। তুমি ভান করছো তুমি খুব আনন্দে আছো। তুমি আসলে গভীর রাতে কারো সঙ্গে পালানোর প্ল্যান করেছো। এ জন্য তুমি একটু বেশিই খুশি। তবে চিন্তার কারণ নাই, আমি তোমাদের ছবি এঁকে দেব।’
বিথি চুপসে গেল।
‘ভয় নেই। আমি কাউকে বলবো না। আমি ভাবছি, তোমরা যদি পালিয়ে ঢাকায় যাও, তা হলে আমার বাসায় উঠতে পারবে। আমার ফ্ল্যাট ফাঁকা। দুজন আরামে লুকিয়ে থাকতে পারবে। শুধু বাবাকে জানিয়ে দিও যে ভালো আছো।’
‘আপনে আসেন, দেরি করলে আবার রেনুপা চিল্লাচিল্লি শুরু করবো।’
আমার কথায় বিথি আশ্বস্ত হলো না। তার পালিয়ে যাওয়ার আনন্দ মাটি করে দেওয়ার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল।
রেনুপা মানে মেয়েটার নাম রেনু। অবস্থা সত্যিই খারাপ। বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হয়েছে। তালা খুলে আমাকে ভেতরে যেতে ইশারা করলো বিথি। ভেতরে ঢুকতেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। একবার মনে হলো সুচিত্রা সেন, আরেকবার মনে হলো তরুণী শ্রীদেবী বসে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। গ্রামের রূপবতীরা এত কড়া সাজগোজ করে না সচরাচর। ভয়ে ভয়ে থাকে। যে যত সুন্দরী, তার বিয়ে তত তাড়াতাড়ি। স্বভাবতই সেই রূপবতীদের বরগুলো সুবিধার হয় না। এলাকার হোমড়াচোমড়া টাইপের হয়।
‘বসো।’
রেনু এমনভাবে বলল যেন আমি তার বহুদিনের প্রেমিক।
‘বিথি তুই যা। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা শুনলে তোর প্ল্যানও আমি ফাঁস করে দেব।’
‘হে হে। আমি তো আরো ওকে অভয় দিলাম। পালিয়ে যেন আমার বাসায় যায়।’
‘তা হলে তো ঝামেলা হয়ে গেল। এক সঙ্গে এক বাসায় দুই বোনের বাসর হওয়াটা কি ঠিক?’
আমি ‘মানে কী!’ বলতে গিয়েও ঢোক গিলে ফেললাম। রেনুর মাথা খারাপ। কী বলতে কী…।
‘আমার মাথা মোটেও খারাপ না। আমার কিছু ক্ষমতা আছে। বাবা সেটার কথা জানে। আমার মা নেই। মা থাকলে কেউ আমাকে তালা আটকে রাখতে পারত না। আর এসব তালাটালা আমাকে আটকে রাখতেও পারবে না। বাবাকে নিশ্চিন্তে রাখতে চাই বলে নিজেই আটকে থাকি।’
‘কী ক্ষমতা..।’
‘আমি মনের কথা পড়তে পারি। উড়তেও জানি। আমার সঙ্গে এ গ্রামের যত পালোয়ান আছে, সবাই একজোট হলেও মারামারিতে পারবে না।’
‘ওহ।’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না? এই যে দেখো।’
বলেই চেয়ার ছেড়ে শূন্যে ভেসে রইল রেনু। ঝাড়া পাঁচ সেকেন্ড হবে। এরপর আবার চেয়ারে বসে চোখে মাশকারা বা কাজল একটা কিছু লাগাতে ব্যস্ত হলো। যদিও বড় বড় গভীর চোখ দুটোয় ওগুলো ভীষণ অপ্রয়োজনীয়।
‘ভয় পেয়েছো?’
‘আপনি আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন যে।’
‘তুমি করে বলছি, কারণ আমরা একটু পর পালাবো। একটু পর না। আগে রান্না বান্না হবে। গায়ে হলুদের তেহারি রান্না হচ্ছে। ওটা খেয়ে তারপর পালাবো। আমার আবার খিদে সহ্য হয় না। এরপর পালিয়ে একসঙ্গে থাকব। চাইলে বিয়েও করতে পারো। তুমি এক কাজ করো, আমার জন্য একটা কোক বা স্প্রাইট নিয়ে আসো। মোড়ের দোকানেই পাবে। তেহারির সঙ্গে লাগবে।’
‘ঠাণ্ডা না নরমাল?’
‘একটা হলেই হবে।’
রেনুর আমার দিকে একবার কি দুবার তাকাল। তাতেই আমার দেজা ভ্যু কাটছে না। এখন মনে পড়লো, তার চেহারা সুচিত্রা বা আলিয়া ভাটের মতো না। সে দেখতে অবিকল লুনার মতো। আমিও তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো কোক আনতে চলে গেলাম মোড়ের দোকানে। মঞ্জুকে সাথে করে নেওয়ারও দরকার মনে করলাম না। মাথায় কেবল শূন্যে ভেসে থাকা রেনুর ছবি ঘুরছে। কেন যেন কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম না।

রাত এগারোটায় রেনুর কথা মতো আমি আর মঞ্জু বাড়ির পেছনের জংলার মতো জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। পাশেই একটা পুকুর। বৃষ্টি নেই। উল্টো চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুকুরের পানি। মঞ্জুর একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে সাধলেও খাচ্ছি না। মাথা পরিষ্কার রাখতে হবে। সিগারেট খেলে মাথা ঝিমঝিম করবে।
এদিকে বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। কেউ একজন ধরা পড়েছে। সম্ভবত বিথির প্রেমিক। আমি এগিয়ে যাব, এমন সময় হাত চেপে ধরলো রেনু। বুঝতে পারলাম, ধরা খাওয়ানোটা তারই প্ল্যান।
‘কেন!’
‘বিথি জাহান্নামে যাক। আজ এতটা বছর আমি আটকে আছি এ ঘরে। শুধু তোমার জন্য। এসব বিথি টিথি সব বানানো গল্প।’
মাথা খারাপ হলেও রেনুর কথাগুলো ফেলতে পারছি না কেন যেন। খুব সুন্দর আর গুছিয়ে বলা কবিতার মতো। রেনু কি জীবনানন্দ পড়া পাবলিক? নাকি রিটার্ন অব শি’র সেই আয়েশা?
‘আমি তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কেন ছিলাম জানি না। চাইলে ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারতাম। কিন্তু তোমাকেই আমার কাছে আসতে হতো।’
রেনু বিড়বিড় করে বলেই যাচ্ছে। যেন মন্ত্র পড়ছে। মন্ত্র শব্দটা মনে হতেই আমার কী যেন মনে পড়তে গিয়েও পড়ল না। রেনুকে হুট করে খুব চেনা মনে হলো। লুনার চেয়েও বেশি চেনা। রেশমা নাকি? কিন্তু রেশমাটা আবার কে? এ নামেও তো আমি কাউকে চিনি না।
হঠাৎ খেয়াল হলো মঞ্জু নেই। তার কথা শোনা যাচ্ছে। গণ্ডগোল যেখানে হচ্ছে সেখানে। আমি রেনুর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম। সে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে পুকুরে ভাসা জোছনা দেখছে। জোছনার প্রতিফলন পড়ছে তার মুখে।
আমার মাথা থেকে মঞ্জু, বিথি ও তার ধরা খাওয়া প্রেমিক চলে গেল। আমি তাকিয়ে আছি রেনুর মুখের দিকে। আমি যে প্রেমে পড়ে গেছি সেটা স্পষ্ট টের পেলাম। হোক মাথা খারাপ মেয়ে। এমন রূপবতী মেয়ের মাথা কিঞ্চিৎ খারাপ না হলে মানায় না। এটা কি কারো লেখা লাইন? নাকি আমারই বানানো? মাঝে মাঝে তো মনে হয় কবিতা কেউ একজন লেখে না। সবাই একসঙ্গে লেখে একটি সত্ত্বার জন্যই। যে এই মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
আপাতত আমার মনে ভিড় জমানো কবিতাগুলো রেনুকে ঘিরেই। ধুম করে মাথা ঘুরিয়ে রেনু বলল, ‘যাও বন্ধুর সঙ্গ দাও। ঝামেলা মিটিয়ে আসো। তুমি তো ঝামেলা মেটাতে ওস্তাদ।’
রেনুর রাগ করার হেতু খুঁজে পেলাম না। ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম যাব আর আসব।

ছেলেটাকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে বিথি। কিছুটা মারধর করা হয়েছে। তবে সিরিয়াস না। মঞ্জু একটা কিছু বলার জন্য গলা খাঁকারি দিল। বিথির বাবা খুব তোলপাড় করছিলেন। তিনিও থামলেন।
‘ভাইসব। প্রিয় গ্রামবাসী। আমি আর আমার সাংবাদিক বন্ধু এখানে আপনাদের অতিথি। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমাদের কাজ হলো ঘুরে বেড়ানো আর মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা জাতিকে জানানো। তো এখানেও এক দুঃখ দুর্দশার অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাই দুচারটা কথা বলতে চাই। বিয়ের মতো পবিত্র একটা বিষয়ে এই সুরুজ বেটা (যাকে বেঁধে রাখা হয়েছে) এসে ঝামেলা পাকিয়েছে। সে আমাদের কনে বিথিকে তুলে নিয়ে যেতে চায়। বিথি বলেছে সেও নাকি তাকে ভালোবাসে। কিন্তু সে তার বাবার সম্মানের কথা ভাবল না। সে ভেবেছে পালিয়ে গেলেই বেঁচে যাবে। তার বয়স কম। সে ভুল করেছে। কিন্তু সুরুজ মিয়ার বয়স কী কম? আপনারা বলেন।’
আমি এগিয়ে মঞ্জুকে থামাতে চাইলাম। মঞ্জু উল্টো আমাকে ঝাড়ি মেরে বলল, আমার এই বন্ধুর দিল নরম। সে আমাকে মানা করেছিল আমি যেন বাড়তি ঝামেলা না করি। কিন্তু ভাইসব, ঝামেলা ছাড়া দুনিয়াতে কোনো কিছুর সমাধান হয় না। এ কারণে আমি আমার বড় মামাকে ফোন করেছি। উনি ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছেন।’ এটা বলে মঞ্জু তার চিরায়ত বিরতিটা নিল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মঞ্জু বিশেষ পরিস্থিতে তার এক কাল্পনিক বড় মামাকে টেনে আনে। যে কিনা পুলিশের বিশাল বড় কর্মকর্তা।
‘আমার বড় মামার পরিচয় আপনারা জানেন না। জানার দরকারও নাই। উনি ফোন করে দিয়েছেন, একটু পর ওসি, চেয়ারম্যান সবাই সুড়সুড় করে চলে আসবেন। একটা বিচার হবে। তারপর দড়ি বেঁধে সুরুজকে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। আদালতে আপনাদের যেতে হবে। সাক্ষী দিতে হবে। রাজসাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মেয়ের বাবা। আপনাদের চিন্তার কারণ নাই, শুধু যা যা দেখেছেন সেটাই বলবেন। আর সাক্ষী দিতে না পারলে আবার ঝামেলা বড় হবে। আপনারা উল্টা বিপদে পড়বেন।’
যথারীতি উপস্থিত গ্রামবাসীর মধ্যে একটা পালাই পালাই আচরণ দেখা গেল এবং দুই মিনিটের মধ্যে বাবুর্চির লোকজন ছাড়া আর কেউ রইল না। মঞ্জু এসে সুরুজের বাঁধন খুলে দিল। তার চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে।
‘ভাইজান সত্যিই পুলিশ আসতেসে?’
‘হ আসতেসে। আপনার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আর অপহরণের মামলা হবে।’ বিথির বাবার দিকে তাকিয়ে মঞ্জু বলল, ‘আপনাকে কিন্তু রেগুলার কোর্টে সাক্ষী দিতে হবে। যা যা দেখেছেন একটা কাগজে লিখে রাখেন। পরে উল্টাপাল্টা বললে ফেঁসে যাবেন। আর মামলার বাদিও কিন্তু আপনি হবেন।’
বিথির বাবা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি একবার বিথির দিকে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি কি তাকে এই ফাঁকে বলবো যে তার মাথা খারাপ হওয়া বড় মেয়েটা আমাকে নিয়ে পালাতে যাচ্ছে।
দশ মিনিটের মধ্যে ঘটনা বদলে গেল। মঞ্জু কয়েকবার ফোন করার ভান করলো। তারপর বিথির বাবাকে অভয় দিয়ে বলল, পুলিশ আপাতত আসছে না। আপনি আজ রাতেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছিল সেই বাড়িতে লোক পাঠান। তাদের আপাতত ঘুমাইতে বলেন। বিথির বিয়ে সুরুজের সঙ্গে হবে, আজ রাতেই হবে।
‘তুমি যা বলবা বাবা, সেটাই হবে। আমার ছেলে নাই। তুমি আমার বড় ছেলে।’
আমার দিকে তাকালেন এবার। আমি হেসে বললাম, ‘চিন্তার কারণ নাই। আমি আপনার ছোট ছেলে। আর আপনার বড় মেয়েকে আমার মনে ধরেছে। তাকে আমি বিবাহ করতে চাই।’

মহা ধুমধাম করে দুটো বিয়ে হয়ে গেল এক রাতে। গ্রামের যারা দাওয়াত পায়নি তারাও ছুটে এসেছে সবাই। রেনুকে বলা মাত্র সেও বউ সেজে ফেলল খুশি খুশি চেহারায়। বিয়ের সময় যখন সে সেজেগুজে বসল, মুহূর্তের জন্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল মহাকাল, এবং গ্রামবাসী। ‘মাথা খারাপ’ মেয়েটা যে সত্যিই মাথা খারাপ করার মতো রূপবতী হবে সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। ফিসফাস শুরু হয়ে গেলেও সেটা ঢাকা পড়ে গেল বাদ্য বাজনার শব্দে। মঞ্জু যথারীতি তার সদ্য শেখা রোবট ড্যান্স দিয়ে মাতিয়ে রাখল সবাইকে।
বাসর সাজানো হলো। আমার আবারো মনে হলো একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একটু পর একটা বড় ধরনের ঝামেলা বাঁধবে আর সব তছনছ হয়ে যাবে। কিন্তু কে ঝামেলা বাঁধাবে কেন বাঁধাবে সেটা মাথায় ঢুকছিল না।
রাত বারোটা বাজতেই গ্রামের লোকজন যার যার বাড়ি চলে গেল। এক ঘরে আমার আরেক ঘরে বিথি ও সুরুজের বাসর সাজানো হয়েছে। গ্রামের কয়েক বাড়ির মেয়েরা থেকে গেছে। তাদের সঙ্গে গুটুর গাটুর করছে মঞ্জু। হাইও তুলছে ঘন ঘন।
ঝামেলার যে আশঙ্কাটা মনে উঁকি দিচ্ছিল, সেটা ঘটেই গেল। বিথির সঙ্গে যার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল, তারা এত সহজে মেনে নিল না বিষয়টা। লাঠিয়াল বাহিনি নিয়ে হাজির হলো বাড়িতে। সিঁটিয়ে গেল মঞ্জু। কয়েক জায়গায় ফোন করে গ্রামটা কোন থানার আন্ডারে আর ওসির নাম্বার আছে কিনা সেটা বের করার চেষ্টা চালাল। একমাত্র আমিই বোধহয় নিশ্চিন্তে আছি। বাসর ঘরে ঢুকে মাত্র সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী রেনুর পাশে বসলাম তখনই হই চই। উঠতে যাব, তার আগে রেনু হাত ধরে চাপ দিল।
‘হোক গণ্ডগোল। লাঠি দিয়ে সব ভেঙেচুরে দিক। আমি আর তুমি এখানেই থাকি।’
‘আমি তো সিনেমার নায়ক। চুপ করে বসে থাকতে তো ইচ্ছে করছে না। এ ঘরে লাঠি বা বাঁশ জাতীয় কিছু আছে? একটু মারামারি করি।’ বলতে বলতেই রেনুকে বেকায়দায় জড়িয়ে ধরলাম। মাথাটা গুঁজে দিলাম ওর বুকে। গন্ধটাও পরিচিত। রেনু আমার কপালে চুমু বসিয়ে দিল একটা। গাঢ় চুম্বন যাকে বলে। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘চলো পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকি।’
‘এই হট্টগোল থামাও গিয়ে। এত শব্দের মধ্যে জোছনা টের পাওয়া যাবে না।’
রেনু বেশ সময় নিয়ে উঠল। আমিও উঠতে গেলাম। চোখ বড় বড় করে বারণ করলো, ‘এখন বের হলেই একগাদা মশা ঢোকাবে। যেভাবে আছো শুয়ে থাকো।
রেনু বের হতেই হট্টগোল থেমে গেল। আমি লোভ সামলাতে না পেরে বিছানা ছাড়ি ও জানালার ফাঁক দিয়ে ঘটনা দেখতে থাকি। লাঠিয়াল বাহিনির একজন এগিয়ে আসতে যাবে, তার আগেই অদৃশ্য একটা শক্তি তাকে গলফ বলের মতো ছুড়ে দিল দূরের একটা ডোবায়। বাকিদের কিছু বলতে হলো না। যে যেদিকে পেরেছে ছুটে পালিয়েছে। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জু। সে সিগারেটটা আস্তে করে ফেলে বলল, ‘ভাবি কেমন আছেন।’
আমি এক দৌড়ে বিছানায় উঠতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম।
‘তোমাকে না বলেছি…!’
‘দৃশ্যটা না দেখলে মিস করতাম। হে হে।’
রেনু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। মট করে একটা শব্দ হলো। ভয় পেয়ে গেলাম, পাঁজরের হাড় ভাঙলো কিনা আবার। পরে মনে হলো ওটা বিছানার শব্দ। তারপর যা ঘটার ঘটল। মানে আমি মনে মনে যেমনটা ভাবছিলাম। আমাকে নিয়ে শূন্যে ভেসে রেনু বেড়ার দেয়াল ভেদ করে চলে গেল বাড়ির পেছন দিকটায়। ভাসতে ভাসতে আমরা উঠে গেলাম বাঁশঝাড়ের একেবারে ডগায়। গ্রামে সাধারণত উঁচু ভবন থাকে না। তাই উপর থেকে গ্রাম দেখতে কেমন সেটা কেউ বুঝতে পারবে না। আমি বুঝতে পারলাম। উপর থেকে গ্রামটাকে দেখে মনে হলো একটা আস্ত একটা প্রাণী। চুপটি করে বসে থাকে। এখন সে জোছনা দিয়ে গোসল সারছে নিরিবিলি।
বিয়ের শাড়ির কারণে রেনুকে দেখাচ্ছে অশরীরি প্রেমিকার মতো। হাসি, আনন্দ আর প্রেম মেশানো টলোমলো চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টে। পলক ফেলছে না।
বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ নামিয়ে তার গলা দেখতে লাগলাম। আমি জানি এরপর কী ঘটবে। পুরো স্ক্রিপ্ট যেন আমার আগেই পড়া। মুখটা এগিয়ে আনল রেনু। গাঢ় চুম্বনে আটকে নিল আমাকে। আমার হাত-পা ভীষণরকম অসাড় হয়ে গেল। জোছনা যেন আমার শরীরে গলে গলে পড়ছে। রেনুর ওপর ছেড়ে দিলাম সমস্ত ভর। এরপর পলকা তুলোর মতো আরো উঁচুতে উঠে গেলাম। রেনুর ঠোঁট আর শরীর থেকে বিদ্যুৎ স্ফূলিঙ্গের মতো অনুভূতির স্রোত এসে ঢুকতে লাগল আমার শরীরে। আমিও যেন উড়তে শিখে গেলাম। এরপর উড়ে উড়ে সে রাতে আমরা সত্যিই পালিয়ে গেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!