কথিত আছে, এই লাইটার দিয়ে নাকি কোন এক ইংরেজ লর্ড তাঁর চুরুট ধরিয়েছিলেন। আজ গুলিস্তানের মোড়ে পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত উক্ত লাইটারখানা দিয়ে রফিক মিয়া তার দিনের দ্বিতীয় বিড়িতে আগুন ধরায়। সরু চেইনের সাথে বাঁধা এই লাইটার সবসময় তার গলায় ঝুলতে দেখা যায়। অদ্ভুত এক লকেটের মত লাগে। দোকানী হা করে তাকিয়ে থাকে।
‘ ভাই, এই মাল কই পাইলেন?
রফিক মিয়া ভ্রু কুঁচকে দোকানীর দিকে তাকায়। চোখে স্পষ্ট বিরক্তি।
‘ এইডারে মাল কইবানা! এইডা হইল তাবিজ! জন্মের সময় দাদাজান গলায় পরায়া দিছিলেন।
‘ তাবিজ থেইকা আগুন বাইর হয়! বড়ই তাইজ্জব!
রফিক মিয়া আরো উৎসাহ পায়।
‘ তাইজ্জবের দেখছডা কি মিয়া! মাইঝরাতে নিশা উডলে এই তাবিজ ছারা উপায় থাহেনা।
‘ নিশার লগে তাবিজের কি সম্মক্ক?’ দোকানী কিছুটা বিনীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। রফিক মিয়া জবাব না দিয়ে মৃদু মৃদু হাসে। এই লাইটার দিয়ে বিড়ি ধরালে বিড়িও চুরুটের মত মনে হয় তার কাছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরসে একটা সুখটান দেয়। তারপর আদিকালের ট্রেনের মত হুস্ করে ধোঁয়া ছাড়ে। রফিক মিয়া একটা ছোট মিথ্যা বলেছে। তার দাদাজান তাকে লাইটার গলায় পরিয়ে দেননি। লাইটারটা দীর্ঘদিন দাদাজানের পুরনো ট্রাংকে পড়ে ছিল। পরিষ্কার করতে গিয়ে রফিক মিয়ার নজরে পড়ে সেটা। ভালমত ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে গ্যাস ঢুকিয়ে জায়গামত চাপ দিতেই বেরিয়ে আসে নীল রংয়ের শিখা। সেদিনের কথা ভেবে রফিক মিয়ার চোখ আজও চক্চক্ করে উঠে। আনন্দের জোয়ারে সে সত্য মিথ্যা গুলিয়ে ফেলে। ‘দাদাজান গলায় পরিয়ে দিয়েছেন’ বলে রফিক মিয়া খুব গর্ববোধ করে। রফিক মিয়ার মনে আছে, যেদিন সে লাইটারটা পায়, সেদিন তিন প্যাকেট বিড়িতে একের পর এক আগুন ধরিয়েছিল। কাশিও উঠেছিল ভয়ানক। কাশতে পেরেও রফিক মিয়াকে গর্বিত মনে হচ্ছিল। কাশির কথা মনে পড়ায়, এখনও ছোট করে একটা কাশি দেয় সে।
কষ্টের গল্প
‘ ঐ মিয়া! আন্ধা নাকি! সরেন!
মৃদু ধাক্কা খেয়ে একপাশে সরে যায় রফিক মিয়া। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ায় কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। ধাক্কা খেয়ে বাস্তবে ফিরে আসে। আর একটুর জন্যে রিকশার চাকায় লুঙ্গি প্যাঁচ খায়নি। লাগলেই ঘটনা ঘটে যেত। বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ রিকশাওয়ালাকে গাল দেয়। গুলিস্তানের ফুটপাতে রফিক মিয়ার ছোটখাট কিছু ব্যবসা আছে। রফিক মিয়া যাকে বিজনেস্ বলে। ছোটখাট একজন কর্মচারীও আছে। সেই সান্টুই বিজনেসের বেশিরভাগ দেখে। অল্প বয়সেই ব্যবসা শিখে ফেলেছে। রফিক মিয়ার ভাষায় ‘এক্খান মাল! এক্কেবারে ঝানু মাল!’। এক মুহুর্তেই কাষ্টমারের মাথা ঘুরিয়ে দেবে। রফিক মিয়াই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়। একদিনকার ঘটনাই বলা যাক।
ভদ্রলোক শার্ট দেখছিলেন। কিছুক্ষণ দেখে একটা পছন্দ করলেন। সান্টু একগাল হেসে ভদ্রলোকের হাত থেকে শার্টটা নিয়ে নেয়।
‘ বাইজান কি চক্ষে কম দ্যাহেন?
‘ কেন ভাই?
‘ এতক্ষন বাইছা এইডা কি লইলেন! এই যে দ্যাখেন, মইদ্যের এই শিলাইডা দ্যাহেন, দুইডা টান দিলেই মামলা ডিসমিস! যে শিলাই করছে, হে হয় আন্ধা না হয় গাঞ্জা খাইয়া শিলাই করছিল। বালা শার্ট নিতে অইলে আমারে কন। এই যে, এই এ্যাশ কালারডা লন। ফর্সা মাইনষেরে মানাইব ভাল।
‘ দাম কত?
‘ দাম এট্টু বেশি লমু, দুইশ ট্যাকা। আর ঐ ডা লইলে মাত্র পঞ্চাইশ।
‘ দেড়শ দিবা?
‘ আফনে চাইলে মাগনা দিমু, কিন্তু দেড়শ দিমুনা। ট্যাকা দিতে চাইলে একদাম দুইশ।
‘ কিছু কম নেন
‘ লন তো বাই শার্টটা।
কষ্টের গল্প
রফিক মিয়া ভেতরে ভেতরে গর্বে ফুলে উঠে কিন্তু ভাবে তা প্রকাশ করেনা। পঞ্চাশ টাকার শার্ট একশ আশিতে বিক্রী হয়। ‘নাহ্ সান্টু আসলেই একখান মাল!’।
রফিক মিয়া তার ব্যবসার জায়গায় পৌঁছে গেছে। আজ ক্রেতার তেমন ভিড় নেই। একটু আগেই আকাশ ফকফকা ছিল। হঠাৎ করেই কোত্থেকে একপাল মেঘ এসে হাজির। সান্টুও বিরস মুখে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ তেমন কাউকে পটাতে পারেনি। সবাই নেড়ে চেড়ে দেখে চলে যায়। দাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেনা। একজন শুধু দাম জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু সান্টু কাষ্টমার চিনে। সবাই জিনিস কিনতে আসেনা। সে বিরক্ত মুখে মেঘ দেখতে থাকে। কাষ্টমার চলে যায়।
‘ কিরে আইজকা বিজনেস কেমুন?
‘ আকাশের অবস্থা বালা না। কাষ্টমারও ভাগতাছে।
রফিক মিয়া বিড়িতে শেষ টান দেয়। তারপর পাশের ড্রেনে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। আকাশ আরো কালো হয়ে গেছে। সান্টু কাপড় গোছাতে ব্যস্ত। হাত দিয়ে লুঙ্গির একপাশে লেগে থাকা রিকশার চাকার দাগ পরিষ্কার করতে করতে রফিক মিয়া বলে, ‘আইজকা আর আওনের দরকার নাই, আমি এট্টু গুইরা আসি’।
‘ কই যান?
রফিক মিয়া উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেয়। গন্তব্য নিয়ে কিছুটা দ্বিধার মধ্যে আছে সে। ময়না বিবি দুদিন হল বাপের বাড়ি। সে থাকলে রফিক মিয়া বাসার পথে রওনা দিত। এখন ফুটপাথ ধরে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে মুখ বিকৃত করে আকাশের দিকে তাকালেও রফিক মিয়া ভাবছে অন্য কথা। ময়না বিবির গর্ভে তার দ্বিতীয় সন্তান। প্রথম সন্তান মারা গেছে তিন মাস বয়সে। বছর দুয়েক পরেই ময়না বিবি সন্তানের জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। রফিক মিয়া চেয়েছিল আরো বছরখানেক অপেক্ষা করতে। সবেমাত্র কাপড়ের ব্যবসায় নেমেছে। পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে সময়ের দরকার। কিন্তু ময়না বিবি জিদ ধরে।
রফিক মিয়া আবার বিড়িতে আগুন ধরায়। বাতাস শুরু হয়ে গেছে। লাইটার থাকায় রফিক মিয়া আবারো আনন্দিত হয়। এই বাতাসে দিয়াশলাই কোন কাজ দেয়না। রফিক মিয়া লাইটারটা শার্টের বাইরের দিকটায় ঝুলিয়ে রাখে। ময়না বিবির সাথে এই লাইটার নিয়েই ঝগড়া হয়েছিল।
‘ দুনিয়াতে কত কিসিমের পাগল আছে, ন্যাংটা পাগলাও এর চাইতে বালা।
রফিক মিয়া তখন সবে খেতে বসেছে। সূক্ষ্ম অপমানের গন্ধ পায় সে। খাওয়া বন্ধ করে ময়না বিবির দিকে তাকায়।
‘ তুমি কি কইতে চাও! আমি পাগল?
‘ অবশ্যি পাগল! পাগলের উপরের পাগল! না অইলে কেউ বিড়ি গলায় ঝুলাইয়া রাহেনা।
‘ আমি বিড়ি ঝুলাইনাই ময়না বিবি! এইডা লাইটার। দাদাজানের সম্পত্তি। দাদাজান গলায় পরায়া…
‘ চুপ্ করেন! আফনে পাগল, আফনের দাদাজানও পাগল!
দাদাজানের নামে বাজে কথা রফিক মিয়ার সহ্য হয়না। ময়না বিবিকে চড় মেরে বসে তৎক্ষনাত।
কষ্টের গল্প
‘ কে? রফিক নাকি?
রফিক মিয়া পেছন ফিরে তাকায়। লোকটাকে ঠিকমত চিনতে পারছেনা। তবে চেহারাটুকু চিনে। সামান্য হেসে জবাব দেয়।
‘ কই যাও এই তুফানে?
‘ তোমার লাইটারখান দাওতো সিগারেট ধরামু।
রফিক মিয়া দ্রুত জ্বলন্ত লাইটার সামনে মেলে ধরে।
‘ তোমার কামটা ঠিক হয় নাই। পোয়াতী বৌরে মারতা গেলা ক্যান?
রফিক মিয়া মাথা নিচু করে।
‘ হুন রফিক, এই সময়ে মাইয়া মাইনষের মাথা এমনিতেই হট্ থাকে, উল্টাপাল্টা কিছু কইতেই পারে। তোমার উচিৎ ছিল তার কাছে থাকনের, আর তুমি পোয়াতীরে একলা ছাইরা দিলা। র্ধু সিগারেটে টেষ্ট নাই, বিড়িই দাও দেহি একখান।
রফিক মিয়ার কিছুটা খারাপ লাগতে থাকে। এখন মনে হচ্ছে গায়ে হাত তোলাটা একদম ঠিক হয় নাই। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রফিক মিয়ার পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। তাদের বিয়ে হয়েছিল হঠাৎ করে। জানাশোনা তেমন ছিলনা। মেয়ে দেখেই পছন্দ হয়ে যায় রফিক মিয়ার। সে তখন বেকার। মেয়ের বাবা বিয়েতে রাজী ছিলনা। শেষে মেয়েই ছেলের সাথে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। সেই দিনগুলির কথা মনে হলে রফিক মিয়ার শরীরে এখনও পূলক জাগে। তাদের বাসর রাত কেটেছিল ঝড়ের মধ্যে। নতুন বৌ অবাক হয়ে তার স্বামীর গলায় ঝোলানো লাইটারের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘ এইডা কি? তাবিজ?
‘ তাবিজই কইতে পার, দাদাজান পরায়া দিছিলেন।
‘ এইডা দিয়াত আগুন জ্বালায়!
‘ হ, ঠিক কইছ, তোমার মতন, সব পুড়ায়া দেয়!
‘ আমি আবার কি পুড়াইলাম!
‘ তুমি আমারে পুড়াইছ! প্রেমের আগুনে পুড়াইলা আমারে….
‘ চুপ্ করেন! আফনের শরম করেনা?
‘ শরমতো পুরুষ মাইনষের না, শরম হইল তোমার লাইগা, তুমি দেহি এহনি শরমাইতাছ!
রফিক মিয়া বাসায় পৌঁছে গেছে। খাটের দিকে চোখ পড়তেই জিনিসটা দেখতে পায়। ছোট একটা কাঁথা। এখনও পুরোপুরি সেলাই করা হয়নি। রফিক মিয়ার ভেতরটা লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। বিড় বিড় করে বলে, ‘ময়না গো! ভুল হইয়া গেছে, মাপ কইরা দাও’। লাইটারটা আবার শার্টের ভেতরে গুঁজে রাখে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা দেখলে হাসাহাসি করতে পারে। বৃষ্টির মধ্যেই আবার বেরিয়ে পড়ে রফিক মিয়া।
কষ্টের গল্প
মাস তিনেক পরের ঘটনা। ময়না বিবি খাটের উপর ছট্ফট্ করছে। হঠাৎ করেই প্রসব বেদনা উঠেছে। রফিক মিয়া ঘন্টাখানেক দৌড়াদৌড়ি করেও কোন ডাক্তার আনতে পারেনি। রোগীকে এই অবস্থায় বাইরে নেয়া সম্ভব নয়। বাইরে ভয়ংকর ঝড়। পাড়ার কিছু মহিলা আছে ভেতরে। তাদের সবার মুখও কেমন যেন শুকনো। রফিক মিয়া ভেতরে যেতে পারছেনা। ময়না বিবির হাত ধরে বার কয়েক বলেছিল, ‘সব ঠিক হইয়া যাইব, তুমি ডরাইওনা’। ময়না বিবি ব্যাথার কারণে কিছু বলতে পারেনা।
রফিক মিয়া ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। নড়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। বাচ্চার কান্নার ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরে পায়। কিন্তু ময়না বিবির কোন সাড়া শব্দ পায়না কেউ। ময়না বিবি যুদ্ধে হেরে গেছে। রফিক মিয়া বাচ্চাকে একনজর দেখে আবার বেরিয়ে আসে। ততক্ষনে ঝড় অনেক কমে এসেছে। বাতাস এখনও আছে। আর বাতাসের সাথে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। রফিক মিয়ার হাতে ভিজে ন্যাতিয়ে যাওয়া বিড়ি। গলায় ঝোলানো লাইটার। অনেক ঝাঁকাঝাঁকি করে জোরে একটা চাপ দেয়। কিন্তু সামান্য ফুলকিও দেখা যায়না। মনে মনে গালাগালি করে। দাদাজানের সম্পত্তি হলেও গালি দিতে দ্বিধা করেনা। লাইটারে গ্যাস নেই। শত চাপ দিলেও আর কাজ হবেনা। আগুন জ্বলবেনা। রফিক মিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাতের মুঠোয় গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়া লাইটার।