class="post-template-default single single-post postid-51420 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

গল্প: গুম

আমি ভাবছিলাম রসুনরঙের দিনগুলোর কথা। যখন রোদের আলো তেরছাভাবে এসে পড়ত মানুষের গায়ে আর রসুনের ক্ষেতে। মানুষ নিজে এ রোদ থেকে বাঁচতে চাইলেও রসুনের ক্ষেতকে থাকতে দিতে চাইত এ রোদের তলেই। এরপর রসুনগুলো তাদের বার্ধক্যের কাছাকাছি এলেই এনে জড়ো করা হতো পুরাতন পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা কোনো এক ঘরে। সেই ঘরের ওপরের দিকে ছনের চালার ঠিক নিচে, আগে থেকে বেঁধে রাখা বাঁশের কাঠামোর মধ্যে গিট্টু দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। আর একটা বালক পথ ভুলে সেই পুরাতন পৃথিবীর ঘরটাতে গিয়ে তাকাত ঝুলন্ত রসুনগুলোর দিকে। রসুনের ঝাঁজ নাকে প্রবেশ করতেই তার মনে হয়েছিল, একদিন সে এই গন্ধের কথা বলবে সবাইকে।

ঠিক এ সময় আমার পাশের খালি সিটটিতে আমারই বয়সী একটা লোক এসে বসলে আমি তাকাই তার দিকে। তাকে আমার পরিচিত কেউ মনে হয় না। যদিও আমরা একই শহরে যাব, শুধু আমরা না, এ বাসের সব যাত্রীই। তবুও কাউকেই আমার পরিচিত মনে হয় না। আমি প্রতিবারই বাসে উঠলে মুখের দিকে তাকাই, যদি কোনো মুখ চেনা যায়, এ আশায়! তবে এমন হয় না কখনো। প্রত্যেকবারই ভিন্ন ভিন্ন মুখ আর আমরা সবাই একই শহরে যাব। পাশে এসে বসা লোকটি আমার বয়সী। কাঁধের ঝোলা ব্যাগখানা কোলের ওপর রেখে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। বাসের বাইরে একের পর এক পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। জনশূন্য দৃশ্যকল্পদ্রুম। রসুনের ক্ষেতগুলো সরে সরে যাচ্ছে। আমার চুলের অলিতে-গলিতে ঢুকে যাচ্ছে পুবের বাতাস। আর রাস্তায় নেচে বেড়াচ্ছে ধুলার সংসার। বাসটা পশ্চিম থেকে পূবদিকে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? পুব থেকে পশ্চিম দিকে কেন নয়! প্রশ্ন এমন মৃদু হাওয়ায় ভেসে থাকতেই পারে। তবে এর উত্তর দেওয়ার অবকাশ নেই এই মুহূর্তে, আমাদের। আমরা জানব পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাত্রারত বাসে আমার পাশে, আমার বয়সী একটা লোক বসে আছে। আর তার আধুনিক দূরালাপনী যন্ত্রটা বেজে উঠলে আমি তাকাব সেটার দিকে এবং দেখতে পাব আমার ভাইয়ের নামের সাথে মিলে যায় এমন একজন খুঁজছে তাকে।

‘হ্যাঁ, ভাইয়্যা! বাসে উঠলাম মাত্র। হুম, যেটা পশ্চিম থেকে পুবদিকে যাচ্ছে।’

তার ভাইয়ের নাম রাসেল, আমারও! আমি তার মুখের দিকে দেখি আবারও। সে ঠিক আমার মতোন দেখতে নয়। তবে অনেকটাই। আমারই বয়সী। সে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে। চেনা পথের পাশে হঠাৎ কোনো নতুন রাস্তা দেখতে পেলে আমরা যেমন বিচলিত হই, ধান্দায় পড়ি যে, আমি কি এই রাস্তাটি আগে দেখিনি! নাকি রাতারাতি ‘নাজিল’ হয়েছে এটি! এরপর বাসের আসনটিতে আমার পক্ষে আর সহজ হয়ে বসে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমার শুধুই মনে হতে থাকে সে আমার পরিচিত কেউ নয়। তবু সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে, ক্রমশ। ডুবে যাচ্ছি আমি। গভীরে নয়, অতলে। আমাকে সে মুছে ফেলতে চাইছে এই দৃশ্যপট থেকে। যেন আমি এখানকার নই, যেন আমি এক অযাচিত অসহিষ্ণু ‘আরবি ঘোড়া’ অথবা আরও বহু আগের বর্বর ভিনদেশি ‘আর্য গরু’!

সহসা একটা কোমল হাওয়া এসে শান্ত করতে চাইছে আমায়। আমাকে চাইছে বুঝাতে। যেন আমি অদৃশ্যে দৃশ্য কল্পনা করি, যেন আমি সাংবৃতিক বিষয়ে আরোপ করি পরমার্থ। যেন আমি ঘুমিয়ে পড়ি, চোখ খোলা রাখার ভান করে। আর এসব করতে, আমাকে দেওয়া হচ্ছে পূর্বপুরুষের দোহাই। যে পূর্বপুরুষকে দেখিনি আমি, দেখেননি আমার বাবা, তার বাবা, তার বাবা, তার বাবা…; যে ছিল না মূলত আমাদের উঠানের লোক, আমাদের লোক। আমার পাশে বসা লোকটাও আমার পরিচিত না। তবে সে দেখতে আমার মতো, কথা বলে আমার ভাষায়। তারপরও তাকে কেমন দূরের লোক বলে মনে হতে থাকে। সে যেন জোর চেষ্টা চালাচ্ছে এখানকার হয়ে উঠতে, এই আলোহাওয়ার সন্তান হয়ে উঠতে। কিন্তু…।

বাসটি তার গন্তব্যে চলে এসেছে। আমরা সবাই আমাদের নিজেদের পায়ের সাহায্যে নেমে পড়ছি রাস্তায়। সেও একসময় নেমে পড়ে। রিকশা দরদাম করে। তারপর উঠে পড়ে সেটায়। আমি তার দিক থেকে মনোযোগ সরাতে পারছি না। তাকে মনে হচ্ছে চমৎকার আগ্রহের বিষয়। কিন্তু কেন? জানা নেই! আমিও আরেকটা রিকশা নিয়ে তার পিছে পিছে ছুটি। তখন চারপাশের দৃশ্যপটগুলিকে সেলুলয়েডে মোড়ানো মনে হতে থাকে। কুকুর ল্যাম্পপোস্ট পোস্টার মানুষ নারী পুরুষ বাদামওয়ালা মোড় সড়ক থুতু হর্ন সবকিছুই। সে ছুটছে। আমিও ছুটছি। এরপর একসময় দেখি সে আমার এলাকায় ঢুকছে। এরপর সে আমার গলির ভিতর ঢুকছে। এরপর আমার বাড়িতে… আমার হৃৎপিণ্ড কেমন মুচড়ে উঠল। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে, আমিও। সে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেছে। আমি তাকিয়ে আছি। আমার মা তাকে আমি মনে করছে, আমি তাকিয়ে আছি। আমার ভাই তাকে আমি মনে করছে, আমি তাকিয়ে আছি। এই তাকিয়ে থাকার মধ্যে প্রশ্ন আছে, তবে প্রশ্ন করার মতো শব্দ খুঁজে পাই না। এই তাকিয়ে থাকার মধ্যে আমার ডুবে যাবার ভয় আছে, তবে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পাই না। আমি আরও সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম। তাকালাম যতদূর চাইতে পারি। দেখতে পাচ্ছি না কিছুই। দেখার চেষ্টা করছি। কোনো একটা কিছু; এক টুকরো আলো। একটু সরলতম সমাধান। না, পাচ্ছি না। ভাবনা বাড়ছে। ভাবছি, কী অবলীলায় তলিয়ে গেছি আমি। তাও গভীরে নয়, অতলে। সেই অতলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে—আমার, ধুলায় মোড়ানো খণ্ড খণ্ড অস্পষ্ট শবদেহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!