রোমান্টিক থ্রিলার ‘কৃ’ পর্ব ৬ পড়ুন এখানে
ধ্রুব নীল
৭
রাত বারোটার পর। হিসেবে দ্বিতীয় দিনের শুরু। কৃর চেহারার পরিবর্তনটা টের পেলাম। এবার আর অভিমান বা কষ্ট নয়, আতংকে অস্থির হয়ে আছে। কালিপ্রসন্ন লোকটাকে এত ভয়ের কী আছে বুঝলাম না।
‘উপস্থিত ভাইসব। এ হইলো আসল ডাইনি। আপনেরা যেমনটা ভাবতেন, ওই রকম না। এই ডাইনি ভোলাভালা মানুষগুলারে প্রেমের জালে ফাঁসাইয়া শেষে একদম শুইসা নেয়।’
আমার ইচ্ছে হলো কৃকে বলি, ‘কই! তুমি তো আমায় এখনো শুসে নিলে না!’ কিন্তু এখন মনে হয় ইয়ার্কির সময় না। আমি ওঝার কাঁধে হাত রাখলাম। চাপ দিলাম মৃদু। ওঝার হাসিটা বিরক্তিতে রূপ নিল। আমি আমার স্বভাবসুলভ শীতল দৃষ্টিতে মোনালিসা টাইপের রহস্যময় হাসি দিলাম। কাছে এসে ফিসফিস করে বললাম, ‘কার সঙ্গে এসব করছেন কোনো আইডিয়া আছে?’
ওঝা ঘাবড়ে গেল বলে মনে হলো না। সে ঝটকা মেরে আমার হাত সরিয়ে দিল। তারপর পেছনে ঘিরে রাখা লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাগো বাড়িতে আইসা খাইয়া দাইয়া শেষে আমারে থেরেট করে। আর আপনারা চাইয়া দেখবেন?’
আমি অন্য কারো দিকে তাকালাম না। স্থির দৃষ্টিতে লোকটার দিকেই তাকিয়ে আছি। আমার চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হবে। ওজনটাও বেশি। পেরে উঠবে না। কিন্তু বাকিদের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী তা বুঝতে পারছি না।
‘কাজটা ভালা করতাছেন না। আপনে সাইডে আসেন। বাইর হন। আপনার লগে কোনো কথা হইতেসে না। গেরামের অন্তত চৌদ্দজন মানুষ আসছে যারা আপনাদের আইজকা উইড়া আসতে দেখসে।’
এ তা হলে ঘটনা। কৃও স্বাভাবিক। সে কি এখন তার ক্ষমতা দেখাবে নাকি আগের মতো আমরা পালাবো?
‘কুনু লাভ নাই বুঝলা, আমার হাত এত নরম না। তোমারে আমি…।’
ওঝার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমাদের বাসর ঘরে যেন একটা ছোটখাট টর্নেডো বয়ে গেল। বাতাসের ধাক্কায় চুপসে গেল সবাই। বাচ্চারা ছুটে চলে গেল ভয়ে। বড়রাও সিঁটিয়ে গেল। আমি আমার পাশের টেবিল আঁকড়ে ধরলাম। ভয় পেয়ে গেলাম এটা দেখে যে ওঝা লোকটা একটুও নড়ল না। যেন সে এসবে অনেককাল ধরে অভ্যস্ত।
থামল ঝড়। থামল কৃ। এগিয়ে গেলাম। তাকে ধরলাম। আমার গায়ে এলিয়ে দিল শরীরটা। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। বুঝতে পারলাম না। মুখের কাছে কান নিয়ে গেলাম।
‘তুমি চলে যাও। আমি পারছি না। আমি পারব না।’
ওঝার দিকে তাকালাম। হারামজাদাটা দুহাত তুলে বিড়বিড় করে মন্ত্র কপচাচ্ছে। আমি তেড়ে যেতেই বাড়ির এক সুঠাম শরীরের লোক এসে আমাকে শক্ত করে ধরে পাশে নিয়ে গেল। নাহ, এর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব। হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলাম। চোখ নামিয়ে বোঝালাম, আপনিই ঠিক। ডাইনির ফাঁদে পা দেওয়া মোটেও উচিৎ হয়নি।
মানুষটা আমার অভিনয় ধরতে পারল না। ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। ওঝার দিকে আড়চোকে একবার তাকালাম শুধু। কৃ ক্রমে দুর্বল হচ্ছে। একটা কিছু ঘটছে। পরিণতি কী জানি না।
কৃর চোখের দিকে তাকাতেই বুকটা হু হু করে উঠছে। ওঝার মন্ত্র পড়েও বোঝা যাচ্ছে না কী করতে চায় ও। কৃ মাঝে একবার শূন্যে ভেসে উঠল, আবার আছড়ে পড়ল। এভাবে চলতে থাকলে কৃ বাঁচবে কিনা…।
এদিক ওদিক তাকালাম। আমার পেছনেই টেবিল। বাসর ঘরের গেট ধরার জন্য কিশোর-কিশোরীরা একটা ফিতা আটকে রেখেছিল। ওটা কাটার জন্য একটা বড় সেলাই করার কাচিও এনে দিয়েছিল ওরা। লোহার তৈরি পুরনো আমলের কাচি। দরজিদের প্রিয় বস্তু। চুপিসারে অন্য দিকে তাকিয়ে হাত নিলাম ওটার কাছে। কাচি বন্ধ থাকা অবস্থায় নিরাপদ। তাই দুই মাথা ফাঁক করে নিলাম। এক প্রান্ত হাত দিয়ে চেপে ধরলাম। দাঁত চেপে সহ্য করলাম ব্যথাটা। ভালোই কেটেছে। উপায় নেই। ধারাল একটা ফলা বের করে রাখতে হলে আরেকটা পাশ চেপে রাখতেই হবে।
আমাকে বাধা দিয়েছিল যে লোকটা সে খানিকটা সরে যেতেই ধীরে ধীরে ওঝার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ডান হাতের কাচি কেউ দেখেনি। দেখলেও সমস্যা নেই। আমার সময় লাগবে এক কি দুই সেকেন্ড। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওঝার ঘাড়ে বিঁধিয়ে দিলাম ফলাটা। নিজেও ব্যথায় কুঁকড়ে গেলাম। কারণ অন্য পাশের ধারাল ফলাটা কচ করে তালুতে ঢুকে গেছে।
ওঝার ঘাড়ের ডান পাশে ইঞ্চি তিনেক ঢুকেছে আরেকটা ফলা। এটুকুই আপাতত যথেষ্ট। কাচিটা ছেড়ে ছুটে গেলাম কৃর কাছে। ওকে কোনোমতে দাঁড় করালাম। ওঝা এখন মন্ত্র পড়া ছেড়ে নিজের ঘাড় সামলাতে ব্যস্ত। দরজার সামনে একগাদা লোকজন। কৃ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দম নিল। আমি কী মনে করে লোকলজ্জা উঠোনে ছুড়ে সজোরে চুমু খেলাম ওকে। ইচ্ছে হলো এভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখি। সবার সামনে। কিন্তু সময় আবার নিজের গতিতে চলতে শুরু করে দিয়েছে। কৃকে সোজা করে ধরে রাখলাম। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ‘কিছু পারো না পারো অভিনয় করতে থাকো। ভয়ানক কিছুর অভিনয়।’
কৃ চোখ মুখ শক্ত করে হরর সিনেমার মতো গটগট করে শূন্য দৃষ্টিতে হেঁটে যেতে শুরু করলো। কাজ হলো। পথ ছেড়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। পেছন থেকে মিনমিনে গলায় ওঝা বলেই চলেছে, ‘হাসপাতাল! আমারে হাসপাতালে নিয়া চল কেউ!’
আমি আড়চোখে কৃকে দেখছি। হাতের ইশারায় অহেতুক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল দূরের একটা চেয়ার। বাইরে ঝড়ো বাতাসে প্যান্ডেল উড়ছে। দুয়েকটা চেয়ারও পড়ে যাচ্ছে। ভয়টা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। সবাই ভাবছে ঝড়টাও কৃ নিয়ে এসেছে।
কৃর ডান হাত আমার কাঁধে ভর দেওয়া। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসিতে মিষ্টি ভাব আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কৃর শাড়িটা লাল। তাতে আমার রক্তের দাগ আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। কৃ খেয়াল করলো অনেক পর। ততক্ষণে আমরা দুজন অন্ধকারে গ্রামের পথে কোনো এক দিকে এগিয়ে গিয়েছি অনেক দূর। ঝড় থেমে গেলেও থেমে থেমে বাজ পড়ছে আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির ছাঁট লাগছে গায়ে।
শাড়ির পাড় ছিড়ে ব্যান্ডেজের মতো করে বাঁধল। তারপরও রক্ত বন্ধ হওয়ার নাম নেই। বৃষ্টির পানির সঙ্গে হাতে দুই ফোঁটা চোখের পানিও পড়ল। চোখের পানি আলাদা করে বুঝতে পারলাম কারণ ওটা বৃষ্টির পানির চেয়ে উষ্ণ। এমন সময় বিদ্যুৎ চমকাল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম কৃর মুখখানা। ঠিক যেন ক্যামেরার সেন্সরের মতো ওর বিয়ের সাজে মায়াভরা বেদনার্ত মুখটা মগজের অসংখ্য নিউরনে গেঁথে গেল।