ফাতেমাতুজ জোহুরা তানিয়া : “সকাল তখন ঠিক ৫টা। শহরের রাস্তাগুলো তখনো ঘুমিয়ে। কুয়াশার চাদরে মোড়া চারপাশ, আর হালকা ঠান্ডা বাতাস যেন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চের পূর্বাভাস দিচ্ছিল।ভোরের আলো তখনো ঠিকমতো ফুটেনি। জানালার ফাঁক গলে আসা হিমেল বাতাস যেন শহরের অলসতা ভাঙতে চাইছিল। সবার ফোনে বারবার নোটিফিকেশন আসছিল—’দেরি করিস না, রেডি হয়ে যা!’তবু তানি আর নিহা ছাড়া কেউ তখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। শহরের কোলাহল থেকে দূরে এক নতুন অভিযানের ডাক আমাদের সকলকে একত্র করেছিল। গন্তব্য—নীলগিরি আর নীলাচলের স্বপ্নময় সৌন্দর্য।”

বন্ধুদের সঙ্গে বান্দরবানের নীলগিরি যাওয়ার পরিকল্পনাটা একেবারে হুট করেই হয়েছিল। নয়নের ছিল ঘোরার পাগলামী, আর আনসারের ছিল খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব। লাহা আর হিমু সবসময় যেমন তেমন, জমিরের ছিল হাসি-ঠাট্টার ভাণ্ডার। আর সুহানা? আমাদের দলের প্রাণ!”গাড়ির ব্যবস্থা করা প্রথম চ্যালেঞ্জ। কয়েকজন মাইক্রোবাস চালকের সঙ্গে কথা বললাম, কিন্তু বাজেটের সঙ্গে মিলছিল না। কেউ সাত হাজার, কেউ আট হাজার টাকা চাইছিল।শেষমেশ এক চালক রাজি হলেন ছয় হাজার টাকায়। গাড়িটা টয়োটা নোহা, আটজনের বসার মতো জায়গা ছিল।
“শহরের যাত্রা শুরু করতে সকাল থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে দেরি যেন সবার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল! লাহা ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত, আনসার কিছু না কিছু ভুলে যাচ্ছিল, আর নয়ন তো মজা করেই সময় পার করছিল। তবে তানি আর নিহা! ওরা ঠিকই সময়মতো হাজির। তানি বলল, ‘যতই তাড়া দাও, এদের কিছুতেই সময়মতো নিয়ে আসা যাবে না!’ নিহা তখন মজা করে বলল, ‘আমরাই আগে পৌঁছে গেলে কেমন হয়?’ আমরা হাসতে হাসতে ওদের নিয়ে গাড়িতে উঠলাম।”
“গাড়ি প্রায় আধা পথ পাড়ি দিয়েছে, এমন সময় আনসার হঠাৎ বলল, ‘না রে, আমার তো খিদে লেগে গেছে। একটু নাস্তা নেওয়া দরকার।’ আমরা সবাই হেসে বললাম, ‘তোর পেট কি চান্দের গাড়ির মতো? থামলেই খিদে লাগে!’তবে আনসার নাছোড়বান্দা। গাড়ি এক দোকানের সামনে থামতেই সে নেমে পড়ল। আমরা অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হচ্ছি, আর নয়ন গান ধরল, ‘এই পথ যদি শেষ না হতো…’। কিন্তু এবার তানি বলল, ‘নয়ন, গান থামাও। আনসারকে গিয়ে ধরো!’
আনসার যখন ফিরল, তার হাতে একগাদা খাবার। সে হেসে বলল, ‘সবাই ভাগ করে খাও। দেরি করে হলেও তোমাদের জন্য কিছু আনলাম!’
“গাড়ি ছুটছে, আর আমাদের মেজাজ তুঙ্গে। নয়ন গান ধরেছে, আনসার তার চিরকালের মতো গল্প নিয়ে ব্যস্ত, আর আমরা পাহাড়ের রাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ লাহা চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আরে! সুহানা কোথায়?’
সবাই চুপ। কিছুক্ষণ পর তানি বলল, ‘সোহানা তো পটিয়া থেকে ওঠার কথা ছিল, তাই না?’ আমরা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বুঝতে পারলাম, আমরা পটিয়া পেরিয়ে চন্দনাইশ চলে এসেছি, আর সুহানাকে পুরোপুরি ভুলে গেছি! হিমু তখন হেসে বলল, ‘দেখলি? যদি তোর খিদে না লাগত, আনসার, তবে ঠিক সময়ে সুহানাকে তুলে নিতাম!’ আনসার তার ডাবের পানি ফেলে দিয়ে বলল, ‘সব দোষ আমার, বুঝি। এবার চুপ কর!’
চালক গাড়ি ঘুরিয়ে বলল, ‘আপনাদের বন্ধুরা তো সত্যিই দারুণ! বন্ধুকে ভুলে গিয়ে সামনে চলে গেছেন!’ আমরা তখন সুহানার কথা ভেবে ফোন দিলাম। সুহানা রাগে বলল, ‘আমার পটিয়াতে বসে থেকে পাহাড় দেখার শখ নেই। আমাকে তোলো না, আমি নিজেই আসব!’আমরা সবাই একসঙ্গে হাসতে লাগলাম, আর বুঝলাম যে এই ভ্রমণের মজাটা এমন ভুলভ্রান্তি আর বন্ধুত্বের কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।””যখন পটিয়ায় সুহানাকে ফেলে আমরা চন্দনাইশ চলে গেলাম, সুহানা ফোন করে রাগে ফেটে পড়ল। ‘তোমরা তো বন্ধুর নামের কলঙ্ক! আমাকে ফেলে রেখে চলে গেছ?’
আমরা দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে পটিয়ার দিকে রওনা দিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই সুহানার ভ্রু কুঁচকে ছিল। কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। তখন নয়ন হাসিমুখে বলল, ‘আচ্ছা সুহানা, তুমি জানো তুমি আমাদের দলের সবচেয়ে সুন্দর?’ লাহা যোগ দিল, ‘আরে, তুমিই তো আমাদের দলের প্রাণ !’ আনসার আরও যোগ করল, ‘সোহানা, তুমি না থাকলে আমাদের ভ্রমণই ফিকে হয়ে যেত!’ হিমু বলল, ‘তুমি রেগে গেলে তো পুরো পাহাড়ই কাঁপবে!’
সুহানা একটুও পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। কিন্তু আমরা যে একেকজন একেকটা কথা বলছিলাম, তা শুনে সে হেসে ফেলল। বলল, ‘ঠিক আছে, তোমাদের মাফ করলাম। তবে এই কাণ্ড আর যেন না হয়!’ আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আর ভ্রমণটা আবার মজার হয়ে উঠল।”পথ ধরে এগোতেই হঠাৎ দেখি সামনে ক্যান্টনমেন্টের চেকপোস্ট। গাড়ি থামানো হলো। একজন দায়িত্বশীল সেনা সদস্য এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের কোথায় যাওয়ার প্ল্যান ?’নয়ন মজা করে বলল, ‘ভাই, আমরা পাহাড়ে মেঘ ধরতে যাচ্ছি!’ সেই সেনা সদস্যও হেসে বললেন, ‘মেঘ ধরা সহজ নয়, ভাই। তবে আপনারা চেষ্টা করতে পারেন।’
এরপর আমাদের ব্যাগপত্র আর পরিচয়পত্র চেক করা হলো। হিমু মৃদু স্বরে বলল, ‘আরে, এমন চেকিং দেখতে তো দারুণ লাগে!’ কিন্তু আনসার কানে কানে বলল, ‘কী জানি, যদি কোনো ভুল হয়ে যায়!’সব চেকিং শেষে আমাদের যেতে দেওয়া হলো। সেনা সদস্য হাসিমুখে বললেন, ‘আপনারা সাবধানে ঘুরবেন, আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করবেন।’ আমরা হাসিমুখে বিদায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম।””চেকপোস্ট পেরিয়ে আমরা একেবারে ঢুকে পড়লাম পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে। চারদিকে যেন সবুজের ঢেউ, আর সেই পথের প্রতিটি বাঁক আমাদের আরও গভীরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। নয়ন জানালার পাশ দিয়ে মাথা বের করে বলল, ‘এটা তো অন্য জগৎ! এখানে সব কিছু অন্যরকম সুন্দর।’
নীলগিরির পথে আমাদের যাত্রা শুরু করার আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চান্দের গাড়ি ভাড়া করা। নীলগিরির পথে যাওয়ার জন্য আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল একটা ভালো চান্দের গাড়ি খুঁজে বের করা। শহরের মোড়ে মোড়ে কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, চালকদের মধ্যে কেউ বসে পান চিবোচ্ছেন, কেউবা অলস চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমরা এগিয়ে গিয়ে দরদাম শুরু করলাম।”ভাই, নীলগিরি পর্যন্ত কত নেবেন?” নয়ন প্রশ্ন করল। চালক একটু হিসাব করে বলল, “সাত হাজার লাগবে, ভাই। রাস্তা খারাপ, গাড়িরও মেইনটেন্যান্স আছে।”আনসার সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, ভাই, এত নেয়া সম্ভব না! পাঁচ হাজার দিব, চলবে?”
চালক মাথা চুলকে বলল, “পাঁচ হাজার তো খুব কম হয়, ভাই!”আমি যোগ দিলাম, “ভাই, আমরা তো বন্ধু-বান্ধব মিলে ঘুরতে যাচ্ছি, বাজেট কম। আর তাছাড়া, চান্দের গাড়ির এই রাইডটা তো আমাদের জন্য একদম নতুন অভিজ্ঞতা!”শহরের ব্যস্ত রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আমরা দরদাম করতে লাগলাম। চালক প্রথমেই একটু বেশি দাম হাঁকালেন, তবে নয়ন আর আনসার দু’জনেই নিজেদের দর-কষাকষির দক্ষতা দেখিয়ে কিছুটা কমিয়ে নিল।”ভাই, এত বেশি নিলে তো আমরা নীলগিরি পৌঁছানোর আগেই পকেট ফাঁকা হয়ে যাব!” আনসার মজার ছলে বলল। চালক হেসে বলল, “আপনাদের জন্যই তো পাহাড়ি রাস্তায় জীবন বাজি রেখে গাড়ি চালাই, একটু বেশি না নিলে চলবে?”অবশেষে কিছুটা দরদাম করে আমরা এক মনে গাড়িতে উঠে পড়লাম। চান্দের গাড়ির খোলা পেছনের অংশে বসে বাতাসের ছোঁয়া নিতে নিতে মনে হলো, সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চার তো এখনই শুরু হলো!
চান্দের গাড়িটা পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চলছিল। ঝাঁকি খেতে খেতে সবাই হাসাহাসিতে ব্যস্ত। বাতাসে পাহাড়ের শীতল গন্ধ, আর সেই সঙ্গে হিমুর ছোট্ট মেয়ে অভ্রির একটানা প্রশ্ন—
“আন্টিরা, বানর কই?”
হিমুর ছোট্ট মেয়ে অভ্রি সবার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। সে তো আসার আগেই ঠিক করে ফেলেছিল, বান্দরবানে বানর দেখবেই! কিন্তু এত দূর এসে একটাও বানরের দেখা নেই!
সোহানা হাসতে হাসতে বলল, “বান্দরবানে আসলাম, আর একটা বানরও নেই, এটা কেমন কথা?”
নয়ন ফিসফিস করে আনসারের কানে কিছু বলল। দু’জনের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। তারপর হুট করে তারা দু’জন লাফিয়ে উঠে বসে পড়ল সিটে।
নয়ন দু’হাত মাথার পাশে তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝাঁকি দিচ্ছে, আর আনসার মুখ বাঁকিয়ে একদম বানরের মতো আওয়াজ করছে—
“উহ! আহ! ক্যাঁচ ক্যাঁচ!”
চান্দের গাড়ির ভেতর সবাই প্রথমে চমকে গেল, তারপর হেসে কুঁকড়ে গেল! অভ্রি বিস্ময়ের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর খিলখিলিয়ে হেসে উঠল—
“হেহেহে! তোমরা তো আসলেই বানর!”চান্দের গাড়ি তখনও চলছিল, পাহাড়ি পথ ধরে। বাতাসে ভেসে যাচ্ছিল সবার হাসির শব্দ, আর অভ্রির আনন্দে উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে নয়ন-আনসার আরও নাটকীয় ভঙ্গিতে বানরের নকল করতে লাগল।
সড়কের বাঁকগুলো এমনভাবে ঘুরছিল যে মনে হচ্ছিল আমরা কোনো মেঘের মধ্য দিয়ে চলছি। রাস্তার ধারে কখনো ছোট ছোট ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে, কখনো আবার নিচে গভীর উপত্যকা। লাহা বলল, ‘এখানে যদি হারিয়ে যাই, তাও কোনো আফসোস থাকবে না !’গাড়ি থেমে গেলে আমরা একটু হেঁটে নেমে পড়লাম। ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষকে সতেজ করে দিল। আনসার হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে, মেঘ তো আর ছুঁতে হবে না, মেঘই আমাদের জড়িয়ে ধরছে।’নীলগিরির রাস্তাটা আমাদের কাছে শুধু একটা ভ্রমণ নয়, এক টুকরো স্বপ্নের মতো ছিল। প্রকৃতির এই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।”
“শেষমেশ আমরা পৌঁছে গেলাম নীলগিরিতে। যেই মুহূর্তে গাড়ি থামল, মনে হলো আমরা একেবারে মেঘের রাজ্যে এসে গেছি। সামনে যত দূর চোখ যায়, শুধু সবুজ পাহাড় আর সাদা মেঘের ঢেউ। নয়ন মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘এটা বাস্তব, নাকি কোনো কল্পনা?’
সুহানা তখন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তানি আর নিহা পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাসকে ছুঁতে চাইছিল। লাহা একপাশে বসে বলল, ‘বন্ধুরা, এর চেয়ে সুন্দর কিছু আমি জীবনে দেখিনি।’আনসার একগাল হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এখানে থেকে গেলে কেমন হয়? নাস্তা তো নিয়েই এসেছি!’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
নীলগিরির সৌন্দর্য যেন আমাদের আটকে রাখতে চাইছিল। একপাশে সূর্যের আলোর খেলা, অন্যদিকে মেঘ এসে গায়ে লাগছে। মনে হলো, প্রকৃতি তার সব সৌন্দর্য উজাড় করে আমাদের সামনে হাজির করেছে। আমরা সবাই মিলে বসে সেই মুহূর্তটাকে একদম মনের গভীরে গেঁথে রাখার চেষ্টা করছিলাম।”নীলগিরির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সবাই ছবি তোলায় মগ্ন হয়ে গেলাম। কখনো একসঙ্গে, কখনো আলাদাভাবে—যার যার পছন্দমতো পোজ দিয়ে। নয়ন বারবার বলছিল, ‘এখানে যেন একটা ফটোশুট হয়ে যাচ্ছে!’
তবে ছবি তুলতে তুলতে কখন দুপুর গড়িয়ে গেল, টের পাইনি। হঠাৎ হিমু বলল, ‘খিদে লাগেনি? পেটের কথা কেউ ভাবছো না?’ সবার কথায় সায় দিলাম। আমরা একটা জায়গায় বসে আনসারের আনা খিচুড়ি বার করলাম। গরম খিচুড়ির সঙ্গে মেঘে ঢাকা পাহাড়ি পরিবেশ—একমাত্র নীলগিরিতেই এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে। সুহানা বলল, ‘আমাদের খিচুড়ি এত ভালো লাগছে কেন জানো? কারণ প্রকৃতি মশলা দিয়ে দিয়েছে।’ তানি হাসতে হাসতে যোগ করল, ‘আর বন্ধুত্ব এই মশলাকে আরও মজাদার করে তুলেছে। সেই দুপুরটা ছিল আমাদের সবার জন্য মনে রাখার মতো। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে বন্ধুত্বের এই মুহূর্তগুলো যেন চিরকাল মনে থেকে যাবে।”
রাস্তায় গাড়ি যখন মেঘের রাজ্যে ঢুকে গেল, নয়ন হঠাৎ গলা ছাড়ল, “এই পথ যদি শেষ না হতো…”। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। লাহা বলল, “ওরে বাবা, এখন আবার নায়ক হয়ে যাচ্ছিস নাকি?” কিন্তু নয়ন থামার পাত্র নয়। সে পুরো গানটাই গাইল, আর আমরা সবাই তার সঙ্গে গলা মেলাতে লাগলাম।
গাড়ির চালকও হাসতে হাসতে বলল, “আপনাদের গান শুনে মনে হচ্ছে, এই পথ সত্যিই শেষ হওয়া উচিত না!” জমির তখন মজা করে বলল, “ঠিক আছে, আমরা এখানেই থাকি। এখানে গাড়ি থামান!”
পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি এগোচ্ছে, আর নয়ন একের পর এক গান গাইছে—কখনো “এই পথ যদি শেষ না হতো”, কখনো “তুমি যাকে ভালোবাসো”। হিমু হেসে বলল, “নয়ন, তুমি একদিন গায়ক হয়ে যাবে, তোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে!” আর সুহানা বলল, “না রে, আমরা গাইতে গাইতে মেঘে হারিয়ে যাব।”
“চান্দের গাড়িতে চড়ার অনুভূতি যে এত মজার হবে, তা কে জানত! পাহাড়ি পথে গা দুলে উঠল, আর জমির এমন এক গল্প বলল যে সবাই হেসে লুটিয়ে পড়ল। নয়ন জানাল, নীলগিরির সূর্যোদয় একবার দেখলে জীবনের সব ক্লান্তি মুছে যায়।””চান্দের গাড়ি যেন মজার ঝাঁপি। জমিরের গান আর আনসারের অদ্ভুত সব গল্পে সময় কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ি একটা বাঁক নিতেই সুহানা চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আরে দেখো! মেঘ নেমে এসেছে!’ চারদিকে শুধু মেঘ আর সবুজ।
“নীলগিরি পৌঁছে মনে হলো, আমরা যেন মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছি। আকাশটা হাতের কাছে নেমে এসেছিল। লাহা এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল যেন সে পাহাড়ের রাজা! নীলাচরের পথ ধরে হাঁটার সময় সুহানা বলল, ‘জীবনে এমন মুহূর্ত বারবার আসে না।”নীলগিরি পৌঁছে মনে হলো, আকাশ যেন হাত বাড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। নয়ন বলল, ‘এটা কোনো বাস্তব জায়গা নয়, স্বপ্নের মতো!’ পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘের ভেতর হাঁটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।”
“”দুপুরের খাবার শেষে আমরা সবাই নতুন উদ্যমে নীলাচরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। খিচুড়ির স্বাদ যেন আমাদের শরীরের ক্লান্তি একেবারে মুছে দিয়েছে। গাড়ি আবার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলতে শুরু করল। নয়ন আবার গান ধরল, ‘যদি কেউ কথা না শোনে…’।
লাহা জানালা দিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নীলগিরি দেখে যদি এত মুগ্ধ হই, নীলাচরে গিয়ে কী হবে ভাবতেই পারছি না!’ সুহানা মজা করে বলল, ‘আশা করি, এবার আমাকে ফেলে যেতে ভুলবে না।’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম।”চান্দের গাড়ি পাহাড়ি পথে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল, আর তানি গাড়ির একপাশে বসে পা দুলিয়ে মহা আনন্দে গান গাইছিল। তার উচ্ছ্বাস দেখে আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলাম। তবে কিছুক্ষণ পর হিমু বলল, ‘তানি, একটু সাবধানে বসো! পা দুলিয়ে চলা ঠিক না, পড়ে গেলে কী হবে?’
তানি হেসে বলল, ‘আরে, এই মূহূর্তটা উপভোগ করো। নীলাচরের পথে এভাবে না গেলে আনন্দটা অপূর্ণ থেকে যাবে।’ লাহা মজা করে বলল, ‘তোর আনন্দ আমাদের হার্ট অ্যাটাক দেবে মনে হচ্ছে ! সবাই মিলে তাকে সাবধান করার চেষ্টা করলেও তানি ছিল নিজের মুডে। তার সেই নির্ভীক আনন্দ আর উচ্ছ্বাস আমাদের সবার জন্য একটা অনন্য মুহূর্ত তৈরি করল।”
নীলাচরের পথে পাহাড়ি দৃশ্য আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।””অবশেষে আমরা নীলাচরে পৌঁছে গেলাম। পুরো জায়গাটা যেন স্বর্গের এক টুকরো। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারছিলাম কেন এত মানুষ এখানে আসতে চায়।
তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়াচ্ছে। সেই রঙিন আলো পাহাড়ের গায়ে পড়ে সোনালি ঝলক তৈরি করেছিল। নয়ন বলল, ‘এই দৃশ্যের জন্য আমি বারবার নীলাচরে আসতে রাজি। আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সূর্যাস্ত দেখছিলাম। হিমু মৃদুস্বরে বলল, ‘জীবনের সব ব্যস্ততা যদি এমন মূহূর্তে থেমে যেত!’ সুহানা তার ক্যামেরায় সেই অসাধারণ দৃশ্য ধারণ করছিল।
নীলাচরের সেই সূর্যাস্ত যেন আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হয়ে থাকল। প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।নীলাচরের সূর্যাস্ত যেন এক টুকরো স্বর্গ। লাহা বলল, ‘এমন সূর্যাস্ত দেখলে মন চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে যায়।’ সবাই কিছুক্ষণ চুপ ছিল। সুহানা বলল, ‘এমন সুন্দর মুহূর্ত খুব কম আসে, যা কোনো ক্যামেরায় বন্দি করা যায় না।'”
“ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, পাহাড় আমাদের এক টুকরো শান্তি দিয়ে গেল। আনসার বলল, ‘এবারের মতো বিদায়, নীলগিরি। তবে আমরা আবার আসব।'””নীলাচরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমরা টেরই পাইনি। ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল, আর মেঘ যেন আমাদের জড়িয়ে ধরছিল। এমন সময় হিমু বলল, ‘এক কাপ গরম চা হলে কী ভালো হতো!’নয়ন সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিল, ‘চা তো খাবই, সঙ্গে কিছু ভারী নাস্তা হলে মন্দ হয় না।’ সবাই তার কথায় মাথা নাড়ল। কিন্তু লাহা আশপাশে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে কি চা-নাস্তা পাওয়া যাবে? পাহাড়ের চূড়ায় তো কেবল মেঘ পাওয়া যাচ্ছে!'”নীলাচরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও আশেপাশে কোনো তেমন খাবারের দোকান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হিমু একটু হতাশ হয়ে বলল , ‘এখন চা আর নাস্তার স্বপ্নই দেখতে হবে মনে হচ্ছে । সোহানা তখন মজা করে বলল, ‘তোমরা এসব চিন্তা বাদ দাও। পটিয়ায় ফিরে চিকেন নান খাবে, সব দুশ্চিন্তা চলে যাবে!’ আমরা তার কথা শুনে হেসে ফেললাম।
নীলাচরের শীতল বাতাস আর মেঘের মাঝেই আবার গাড়িতে চড়ে পটিয়ার দিকে রওনা দিলাম। পটিয়ায় পৌঁছে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন নানের স্বাদ নিতে নিতে সবাই বলল, ‘সোহানা, তোর কথাই ঠিক! এটাই আমাদের শান্তি এনে দিল।’
রাতে ফিরে যাওয়ার সময় সবাই মিলে বলছিল, ‘আজকের দিনটা ছিল মনে রাখার মতো—প্রকৃতি, মজা আর বন্ধুত্বের মিশ্রণে ভরপুর। নাস্তা শেষে প্রথমেই সোহানা চলে গেল। তার চলে যাওয়ার সময় আমরা সবাই হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। কিছুক্ষণ পর হিমু আর আনসারও বলল, ‘আমাদেরও এবার উঠতে হবে।’ তাদের চলে যাওয়ার সময় লাহা মজা করে বলল, ‘তোমরা এত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলে তো পুরো মজাটাই শেষ হয়ে যায়!’
এরপর তানি আর নিহাও ধীরে ধীরে নেমে পড়ল। চারপাশ যেন একটু ফাঁকা লাগতে শুরু করল। তখন লাহা চুপ করে বলল, ‘এই বুঝি বিদায়।’ তার কথায় আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। সবার চলে যাওয়ার মুহূর্তটা এতটাই নীরব আর আবেগময় ছিল যে কারও মুখে আর কোনো কথা ছিল না। সেই দিনের সব আনন্দময় মুহূর্ত হঠাৎ যেন এক গভীর শূন্যতায় ঢেকে গেল।”
“শেষমেশ নয়ন, জমির, আর লাহাও বিদায় নিতে শুরু করল। একে একে সবাই চলে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন পুরো দিনের মধুর মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিদায়ের সময় লাহা হেসে বলল, ‘আবার দেখা হবে, বন্ধুরা!’ আর নয়ন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই ভ্রমণটা আমরা কখনো ভুলব না। সবাই চলে যাওয়ার পর মনে হলো, এই ভ্রমণ শুধু পাহাড় বা প্রকৃতির নয়, এটি ছিল আমাদের বন্ধুত্বেরও এক অনন্য উদযাপন। প্রাণবন্ত দিনটি আমাদের মনে চিরকাল অমলিন থাকবে।”
লেখক পরিচিতি :
ফাতেমাতুজ জোহুরা তানিয়া
ঠিকানা : কলেজ রোড,চকবাজার, চট্টগ্রাম।
ই মেইল : fatimatuzzohoratania@gmail.com