ইউক্যালিপটাস বাংলাদেশের এক পরিচিত গাছ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Eucalyptus. এটি Martaceae পরিবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে ইউক্যালিপটাসের বিস্তার রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা, চীন, ভারত, এবং আফ্রিকার বিশাল এলাকাজুড়ে এই গাছের চাষ হয়ে থাকে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে সিলেটের মালনীছাড়া চা বাগানে ছায়া প্রদানের জন্য প্রথমবারের মতো ইউক্যালিপটাস লাগানো হয়।
তবে দীর্ঘদিন ধরে এই গাছকে ঘিরে কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যা বিজ্ঞানের আলোকেই বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
ইউক্যালিপটাস: প্রকৃতির বন্ধু নাকি শত্রু?
বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই ইউক্যালিপটাসের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ শোনা যায়। যেমন:
- এটি মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি শোষণ করে।
- মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।
- গাছের পাতা কোনো প্রাণী খায় না।
- পাখি বা পতঙ্গ বসে না।
- জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়।
তবে গবেষণা বলছে, এই অভিযোগগুলোর বেশিরভাগই ভুল তথ্য বা অপপ্রচার। উদাহরণস্বরূপ, Center for Science and Environment (CSE) এর গবেষণা অনুযায়ী, ইউক্যালিপটাসের পানি শোষণের হার অনেক কম। ইউক্যালিপটাসের প্রতি কেজি বায়োমাস তৈরিতে মাত্র ৭৮৫ লিটার পানি লাগে, যেখানে বাবলা গাছের জন্য প্রয়োজন ১৩২৩ লিটার এবং ধানের জন্য ২৫০০-৩০০০ লিটার।
ইউক্যালিপটাস বনাঞ্চলের ভূমিকা: বন গবেষণার তথ্য মতে, এই গাছ মাটির উপরিভাগের পানিই শোষণ করে এবং গভীর ভূগর্ভস্থ স্তরে প্রভাব ফেলে না।
ইউক্যালিপটাস নিয়ে গবেষণার ইতিবাচক দিক
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে ইউক্যালিপটাসের তিনটি প্রজাতি—Eucalyptus camaldulensis, E. brassiana, এবং E. tereticornis—ভালো জন্মায়।
- ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন: এই গাছ কম বৃষ্টিপাতেও টিকে থাকতে পারে।
- কার্বন শোষণ: এটি পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণে কার্যকর।
- বায়োমাস উৎপাদন: দ্রুত বেড়ে ওঠায় কাঠ, জ্বালানি, এবং কাগজ শিল্পে এটি অত্যন্ত উপযোগী।
গবেষণাগুলোতে উল্লেখ রয়েছে যে ইউক্যালিপটাসের পরিবেশবান্ধব ভূমিকা, বিশেষ করে কার্বন শোষণ ও মাটির ক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ।
মিথ্যা প্রচারণার পেছনের কারণ
১৯৮০-এর দশকে ভারতের গুজরাটে ইউক্যালিপটাস নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দরিদ্র কৃষকদের জমিতে এই গাছ লাগানোর পর কৃষি উৎপাদন কমে যায়। এ থেকেই গাছটির বিরুদ্ধে পরিবেশগত ক্ষতির গুজব ছড়ায়।
আফ্রিকার উরুগুয়েতে কাগজ শিল্পের জন্য ইউক্যালিপটাসের ব্যবহার নিয়ে পানি সংকটের অভিযোগ উঠে। তবে এই সব অভিযোগের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
ভারতে ইউক্যালিপটাস বিতর্ক: ২০১৫ সালে ভারতের ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনাল ইউক্যালিপটাসকে পরিবেশবান্ধব ঘোষণা করে।
ইউক্যালিপটাস চাষের বাস্তব অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে চাষ হওয়া ইউক্যালিপটাস গাছ:
- স্কুল, কলেজ, বসতবাড়ি, ও অফিসে শোভা পাচ্ছে।
- গাছটির কাঠ ব্যবহার হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল বায়োমাস তৈরিতে।
- গবেষণায় প্রমাণিত যে এটি দেশের জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন: ইউক্যালিপটাসের উপকারিতা
উপসংহার
ইউক্যালিপটাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ও পরিবেশবান্ধব গাছ, যা শুধু মিথ্যা প্রচারণার শিকার। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও তথ্য প্রচারই পারে এই ভুল ধারণাগুলো দূর করতে।
পরামর্শ:
যেসব এলাকায় বৃষ্টিপাত কম (৪০০ মিমি-এর নিচে), সেসব এলাকায় ইউক্যালিপটাস লাগানো ঠিক নয়। তবে দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে এটি সঠিকভাবে চাষ করা সম্ভব।
ইউক্যালিপটাস নিয়ে নতুন গবেষণা