কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন হলো এমন এক প্রযুক্তি যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন সিস্টেম মূলত কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট এবং কোয়ান্টাম সুপারপজিশন নামের প্রকৃতির দুটি চমৎকার ও অদ্ভুত নিয়মের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়।
প্রথমেই সহজ করে বলা যাক সুপারপজিশন নিয়ে। প্রচলিত ডিজিটাল পদ্ধতি কাজ করে বাইনারি বিট নিয়ে। যার মান শূন্য বা ১ হতে পারে। কিন্তু কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন কাজ করে কিউবিট নিয়ে। এই কিউবিট হলো মূলত একটি অতিক্ষুদ্র কণার এমন এক অবস্থা, যা একই সঙ্গে দুটো দশায় থাকতে পারে। অর্থাৎ ওই কণার ভেতর ০, ১ এবং ০ ও ১ এর একটি মিশ্র সম্ভাবনাময় দশা থাকতে পারে। একই সঙ্গে থাকা অবস্থাটিই হলো কিউবিটের তৃতীয় দশা বা সুপারপজিশন। একটি কিউবিটকে একবার পর্যবেক্ষণ করা হলেই সেই সুপারপজিশন বা কোয়ান্টাম দশাটি কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়। তখন এটি সাধারণ তথ্যে পরিণত হয়। কোয়ান্টাম যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই কিউবিট তাই একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছে। আর কোয়ান্টাম যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই কিউবিটের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে আলোর কণা ফোটন।

আবার কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে দুটি ফোটন কণা এমনভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়, যার ফলে একটির অবস্থায় পরিবর্তন ঘটালে অপর কণাটির মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে সেই পরিবর্তনের প্রভাব দেখা যায়। এমনকি দুটো কণার মাঝে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরত্ব থাকলেও এই প্রভাব কাজ করে তাৎক্ষণিকভাবেই। ব্যাপারটাকে তুলনা করা যায় দুটো জাদুর বাক্সর সঙ্গে । ধরুন, দুটো বাক্সের ভেতর দুটো ঘূর্ণায়মান মুদ্রা আছে। সুপারপজিশনের ধারণা অনুযায়ী, প্রতিটি বাক্সের ভেতর একইসঙ্গে দুই ধরনের মুদ্রার তিনটি দশাই আছে। অর্থাৎ মুদ্রার হেড বা টেইল এবং একই সঙ্গে দুটি অবস্থার মিশ্রণ। এখন একটি বাক্স খোলামাত্রই থেমে যাবে মুদ্রার ঘূর্ণন। সেই সঙ্গে নষ্ট হয়ে যাবে মুদ্রার সুপারপজিশন। এখন একটি বাক্সে যদি দেখা যায় মুদ্রার হেড উঠেছে, সেক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে দেখা গেল অন্য বাক্সটিতে থাকা মুদ্রার সুপারপজিশন নষ্ট হয়ে গেছে এবং তাতে পাওয়া গেছে মুদ্রার টেইল বা বিপরীত অংশ। অথচ বাক্সটি খুলে দেখার আগ পর্যন্ত ভেতরে থাকা মুদ্রাটি কিন্তু নিজেও জানে না যে সে কোন অবস্থায় আছে। অর্থাৎ কোয়ান্টাম এনটেঙ্গলমেন্ট প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনোভাবে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে।
কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনে তথ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে ওই মুদ্রার স্থানে ব্যবহার করা হয়েছে আলোর কণা বা ফোটন। ফোটনগুলোর মধ্যে এনট্যাঙ্গলমেন্ট বা এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি করে সেগুলোকে অপটিক্যাল ফাইবার বা ফ্রি-স্পেস লিংক-এর মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থান থেকে পাঠানো হয় চীনের তৈরি এ প্রযুক্তিতে।
কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনে মূলত সুপারপজিশন অবস্থায় থাকা অনেকগুলো এনটেঙ্গল ফোটন তৈরি করা হয। এরপর জোড়া ভেঙে সেই ফোটনগুলো হয় দুই প্রান্তে। একে বলে কোয়ান্টাম কী ডিস্ট্রিবিউশন। এ প্রক্রিয়ায় ফোটন কণার বিন্যাস থেকে পাওয়া যায় একটি এনক্রিপশন কী বা তথ্যের মূল চাবি। যদি কোনো হ্যাকার তথ্য চুরির চেষ্টা চালায় তবে সিস্টেম তা শনাক্ত করতে পারে এবং তাৎক্ষণিকভাবেই কোয়ান্টাম চাবির তথ্য নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ বাক্স খোলার আগেই যদি মুদ্রাটিতে যদি দেখতে পান হেড বা টেইল উঠেছে। তাতে পরিষ্কার হয় যে, কেউ একজন মাঝপথে বাক্সটি খুলে মুদ্রাটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছে।
বর্তমানে সুরক্ষিত ডেটা ট্রান্সফার, ব্যাংকিং সিকিউরিটি, এবং সামরিক যোগাযোগে ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে হ্যাকিং প্রতিরোধী ইন্টারনেট এবং সুরক্ষিত নেটওয়ার্কও তৈরি করা সম্ভব। আবার এ প্রযুক্তির আরেকটি সুবিধা হলো এটি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বা রেডিও তরঙ্গের ওপর নির্ভর করে না।
২০১৬ সালে চীন উৎক্ষেপণ করে বিশ্বের প্রথম কোয়ান্টাম স্যাটেলাইট। প্রাচীন চীনের বিখ্যাত দার্শনিক ও যুক্তিবিদ মোচির নামে স্যাটেলাইটটির চীনা নাম রাখা হয় মোচি এবং ইংরেজিতে ‘মিসিয়াস’। এটি পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে আলোর কণা বা ফোটনের মাধ্যমে ভূমিতে স্থাপিত রিসিভারে তথ্য পাঠাতে পারে।
মোচি স্যাটেলাইটের মিশনের নাম হলো কোয়েস বা কোয়ান্টাম এক্সপেরিমেন্ট অ্যাট স্পেস স্কেল। কোয়েসের কাজ হলো এনটেঙ্গল ফোটন পেয়ার বা জোড়ায় জোড়ায় সম্পর্কযুক্ত ফোটন কণা তৈরি করে পৃথিবীর দুই প্রান্তে পাঠানো। এটাই হলো কোয়ান্টাম কি ডিসট্রিবিউশন। এতে করে একটি পুরোপুরি র্যানডম সংখ্যা বা সংখ্যার বিন্যাস মুহূর্তেই হাতে পাচ্ছে দুই প্রান্তের দুটি রিসিভার। ২০১৬ সালে উড্ডয়নের পর টানা এক বছরেরও বেশি সময় সফলভাবে কোয়ান্টাম যোগাযোগের গবেষণায় কাজে লেগেছে কোয়েস।
২০১৭ সালে মোচি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বেইজিং থেকে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা পর্যন্ত ৭ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে কোয়ান্টাম এনক্রিপ্টেড তথ্য বিনিময়ের সফল পরীক্ষা করা হয়। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় সফল কোয়ান্টাম যোগাযোগ।
চীন শুধু মহাকাশেই নয়, মাটিতেও তৈরি করেছে বৃহৎ কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক। বেইজিং থেকে সাংহাই পর্যন্ত ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ কোয়ান্টাম যোগাযোগ লাইন স্থাপন করেছে। সেখানেও একই পদ্ধতিতে এনটেঙ্গল ফোটন তৈরি করে তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এনক্রিপটেড কি বা নিরাপদ তথ্য আদানের চাবি।
চীনের এই নেটওয়ার্ক প্রতিদিন হাজারো নিরাপদ বার্তা আদান-প্রদান করে, যা বর্তমান যুগের সাইবার নিরাপত্তার জন্য নতুন মাইলফলক।
চীন এখন পুরো পৃথিবীজুড়ে একটি গ্লোবাল কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করছে। এই নেটওয়ার্ক চালু হলে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে সম্পূর্ণ নিরাপদ যোগাযোগ সম্ভব হবে, যা বাণিজ্য, সামরিক যোগাযোগ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নিয়ে আসবে দারুণ সব পরিবর্তন।
কোয়ান্টাম কমিউনিকেশনের চ্যালেঞ্জ
যদিও এটি একটি অসাধারণ প্রযুক্তি, তবুও এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করতে দরকার ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি। আবার দীর্ঘ দূরত্বে কার্যকারিতা বজায় রাখতে হলে একটি কণার কোয়ান্টাম অবস্থা বজায় রাখাও কিন্তু কঠিন কাজ।
তবে চীনের এই অগ্রগতি দেখে ইতোমধ্যে আমেরিকা, ইউরোপসহ অন্যান্য দেশও কোয়ান্টাম গবেষণায় বিনিয়োগে উৎসাহ পেয়েছে।
কৃতজ্ঞতা: সিএমজি বাংলা