সামনে নাকি মহামন্দা। জিনিসটা কী তা বোঝার আগেই দেখা যাবে ডিমের হালি দুইশ টাকা হয়ে গেছে। বুঝতে বুঝতে দেখবেন মুরগি আর বাজারে নেই। কারণ ক্রেতা নেই। পকেটে টাকা নেই তো, বাজারেও কমতে থাকবে সাপ্লাই। খরচ কমাতে কমাতে একটা পর্যায়ে দেখা যাবে দামটা আর মুখ্য নয়। উৎপাদনেও নামবে খড়গ। অনেক খামারি আর ব্যবসায়ীও পথে বসবেন নিশ্চিত।
সুতরাং উপায়? উপায় একটাই। তা হলো আমাদের চিরচেনা প্রচলিত ‘অপচয়ের অর্থনীতি’র দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
একবার ভাবুন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যত খরচগুলো করেন, সেগুলোর কোনটা কোনটা আপনার জীবনের জন্য একেবারে আবশ্যক? মানে যেগুলো না হলে আপনার বাঁচা-মরা নিয়ে টানাটানি লেগে যাবে? খটকা লাগলো? এই খটকা তাড়ান আগে। কোনটা আসলেই দরকার আর কোনটা অপচয় সেটা বুঝতে শিখুন। একেবারে পাই টু পাই। এখানে বিস্তর আলোচনার সুযোগ নেই। কারণ এত আলোচনার জন্য এই ওয়েবসাইটের প্রকাশক আমাকে সম্মানি যে দিতে পারবেন না তা আগেই বলে দিয়েছেন (তিনি বিষয়টা আপনাদের মানে পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন)।
আসল কথায় আসি। বিস্তর আলোচনা হবে। ধারাবাহিকভাবেই বলবো। তার আগে আজকের মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট শেয়ার করা যাক।
১। বারান্দায় যাদের দুই চিলতে জায়গা আছে তারা টবে শাক-সবজি লাগান। মানিপ্ল্যান্ট ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছপালা আপাতত ধনীদের জন্য বরাদ্দ থাক। ফল ধরবে এমন সবজিও আপাতত বাদ দিন। কারণ তাতে অনেক সময় লাগে। আবার বারান্দার টবে বড় বড় মিষ্টি কুমড়াও ধরবে না। সুতরাং শাকই ভরসা। বীজ পুঁতলেই যেন বেরিয়ে আসে পুঁই আর মিষ্টি কুমড়া। মিষ্টি আলুর শাক কিন্তু হু হু করে বাড়ে। যত্ন লাগে না। পানি দিলেই হলো। আর শাকটাও বিশ্বাস করুন, দারুণ স্বাদ।
টব তো ওয়ান টাইম বিনিয়োগ। আর মাটি তো ঘরের কাছে আশেপাশে খুঁজলেই পাবেন। একটু লাজ-লজ্জা ঝেড়ে নিয়ে কোথা থেকে মাটি নিলেই হলো। যাদের খুব সমস্যা হবে, তারা নার্সারিতে গিয়ে এক বস্তা নিয়েই আসুন। তাতে অবশ্য কিছু খরচ পড়েই যায়।
গাছের জন্য সার নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে। ঘরের ফেলে দেওয়া চা-পাতাই দিন। আর মাছ ধোয়া পানিও কিন্তু অনেক ভালো সারের কাজ করে। ৩৫-৪০ টাকা দিয়ে কেজিখানেক ইউরিয়াও চাইলে কিনে ফেলতে পারেন অনলাইনে অর্ডার করে। রাসায়নিক বলে নাক সিঁটকানোর কী দরকার। কৃষকরা অহরহই এ সার দিয়ে লকলকে শাক-লতাপাতা ফলাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
বারান্দার জন্য সবুজ শাক হিসেবে শখ করে আবার কলমি বা পালং লাগানোর দরকার নেই। কারণ তাতে জায়গায় পোষাবে না। বরবটিও কোনো কাজের সবজি নয় এক্ষেত্রে।
মাসে অন্তত চার-পাঁচদিন ঠিক করুন, বারান্দার ওই লাউ-মিষ্টি কুমড়া শাক বা পুঁই লতার তরকারি দিয়েই ভাত খাবেন। তাতে শরীরের লাভ, পকেটেরও।
২। দুচারটে পরিবার একজোট হয়ে যান। কলিগকে সঙ্গে নিন বা আশেপাশে থাকে এমন কেউ। ৪-৫টি পরিবার জোট বাঁধলেই হলো। নিয়ম করে বাই রোটেশন একদিন একজন চলে যান পাইকারি বাজারে। বাজার করুন পাইকারি দরে। জানেন কিনা, পাইকারি বাজারে যে বেগুন ৪০ টাকা, সেটাই কিন্তু খুচরা বাজারে ৮০ টাকা। কিন্তু পাইকারিতে কিনতে হয় কমপক্ষে ৫ কেজি কিংবা যাকে বলে এক পাল্লা। তো ৫টি পরিবার একজোট হলেই কিন্তু কাজ সারা। কষ্ট করে একজন একদিনের বাজারের দায়িত্বটা নিলে, কিংবা সপ্তাহের বাজার একজোট হয়ে করলেই টাকা বাঁচবে অন্তত ৪০ ভাগ।
৩। যাবতীয় প্যাকেট-জাত খাবার বয়কট করুন। প্যাকেটজাত খাবার যা আছে সবই ঘরে বানানো বা খোলা কিনতে পাওয়া যায়। স্রেফ ব্র্যান্ড আর মোড়কের কারণে বাড়তি টাকা কেন ঢালবেন? আর প্রসেস করা হাবিজাবি একেবারেই বন্ধ করে দিন না।
৪। অফিসগামী বা তরুণদের বলছি— দুটো পুদিনা পাতা, এক চিমটি আদা আর সামান্য লেবু চেপা চা দশ টাকা দিয়ে না গিলে ফ্লাস্ক ব্যবহার করুন। বন্ধু বা কলিগদের নিয়ে রুটিন করুন, আজ আমি ফ্লাস্কে করে রং চা আনবো, কাল আপনি আনবেন, পড়শু উনি আনবেন। ব্যস, দশ দশ করে এমন শত শত টাকা বেঁচে যাবে। কানে কানে বলি, দোকানের ওই দশ টাকার রং চায়ের পেছনে খরচ কিন্তু ৩ টাকাও পড়ে না।
৫। ঘরের বারান্দায় খাঁচা রেখে তাতে ১০-১২টা মাদি কোয়েল পালন করুন। মাদি কোয়েলের গলার দিকে ফুটি ফুটি কালো ছোপ দাগ থাকে। আর ডিম পাড়া কোয়েল কিনা তা জেনে কিনুন। ১০টা পাখির জন্য প্রতিদিন ২০০ গ্রাম খাবার লাগবে। ২০০ গ্রাম খাবারের দাম সর্বোচ্চ ১২টাকা। ১০টা কোয়েল দিনে গড়ে ৬টা করে ডিম দেবে (বছরে একটা কোয়েল ডিম দেয় ৩০০টা)। সেই হিসাবে একটা ডিমের দাম পড়বে ২ টাকা করে। গন্ধটা সহ্য করুন। পরিষ্কারের কাজটা নিজেই করুন। মহামন্দার এই সময়ে গন্ধ-টন্ধ বিষয় না।
৬। যতটা সম্ভব মাংস কম খান। ২০-৩০ বছর আগে মানুষ সপ্তাহে বা মাসে হয়তো ১-২ দিন মাংস খেতো। বাজারে গিয়ে ছোট মাছ, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস এসব খান। তাতে মাছের খামারিদের সুদিন আসবে। এসব মাছের উৎপাদনও কমবে না, দামও বাড়বে না। গরু-ছাগলের মাংস যতটা সম্ভব কমিয়ে দিন।
৭। এমন একটা কিছু শখের কাজ করুন, যা থেকে কিছু না কিছু টাকা আসবে। আর যারা ঘরে বসে একটা কিছু করার কথা ভাবছেন তারা একদম ছোটখাট বিনাপুঁজির ব্যবসা শুরু করুন। যেমন ধরুন, রুটি বানানো (ফ্রোজেন নয়), লন্ড্রির কাজ, সেলাই ইত্যাদি। এই মন্দার সময় পাকিস্তানি লনের ব্যবসার চিন্তা বাদ দিন তো।
৮। বিকালের নাস্তায় বাইরে খাওয়াকে হারাম করে দিন। আলু সেদ্ধ করে লবণ দিয়ে নাস্তা করেছেন? এটা খেলে তো ভাই মরে যাবেন না। উল্টো আপনার একগাদা ভিটামিন চাহিদা পূরণ হবে। বুকে হাত রেখে বলুন, বাইরের পোড়া তেলে ভাজা সিঙ্গাড়া ভালো? নাকি বাসায় হালকা লবণ ছিটিয়ে আলু সেদ্ধ খাওয়া ভালো?
৯। মাটির ব্যাংকে টাকা জমাবেন না। বেশি থাকলে জায়গা-জমি কিনুন। গয়না না কিনে ভালোমানের গোল্ডবার কিনে রাখুন। সঞ্চয়পত্রও কিনতে পারেন। এতে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্তত টাকার পরিমাণ কিছুটা বাড়বে।
আরও অনেক লেখার ছিল। আজ এক লেখায় সব নয়। আরেকটা পোস্ট আসবে এ নিয়ে। তার আগে বিনীত অনুরোধ, লেখাটি দরকারি মনে করলে শেয়ার করবেন। আর এই ওয়েবসাইটের জন্য বখশিস দিতে চাইলে দয়া করে ই-মেইল করুন— news@matinews.com এ।