সোশ্যাল অ্যাংজাইটি আমাদের অনেকের বিরাট সমস্যা। বিশেষ করে অপরিচিত অনেকের সামনে কথা বলা, প্রেজেন্টেশন দেওয়া বা কোথাও মঞ্চে কিছু বলতে গিয়ে আমরা অনেকেই এই সমস্যায় ভুগি। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম টেড টক-এ দেওয়া মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ড. ফ্যালন গুডম্যান জানালেন কী করে কমাতে হবে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি তথা সামাজিক উদ্বেগ।
থেরাপিস্ট হিসেবে কেউ এলে আমার একটা প্রশ্ন থাকত—আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? একটি মাত্র লক্ষ্য ঠিক করা কঠিন বটে। কেউ তার সারা জীবন কাটিয়ে দেয় সেই লক্ষ্যের সন্ধানে, কেউ সেটার নাগালই পায় না। কিন্তু এক দিন এক মেধাবী তরুণী বলল, তার জীবনের লক্ষ্যই হলো অন্য কারও নজরে না আসা। মানে সে সোশাল অ্যাংজাইটিতে ভুগছে। সামাজিক উদ্বেগ (সোশ্যাল অ্যাংজাইটি) এতটাই মারাত্মক!
সোশ্যাল অ্যাংজাইটির মূলে আছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়। আমরা তখন বেশি ভাবি যে, অন্যরা আমাকে কীভাবে দেখছে সেটা নিয়ে। আমরা রুমে ঢুকেই চোখ বোলাতে শুরু করি- এখানে আমাকে প্রত্যাখ্যান করার মতো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা। এর পরই স্বস্তি খুঁজি পাই সমর্থন, হাসি, মাথা নাড়ানো, এসবের ভেতর। এই যে সামাজিক উদ্বেগ, এটার একটা কারণ আছে। এটি আমাদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। কীভাবে? এ ভয় আমাদের সামাজিক সূক্ষ্ম কিছু নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে চলতে শেখায়, যাতে আমাদের আচরণ বাকিদের সঙ্গে খাপ খায় এবং যাতে আমরা প্রত্যাখ্যাত হব না। এটা একদিক দিয়ে ভালো কারণ এটি আমাদের সামাজিক বানায়।
প্রত্যাখ্যান আদতে ভালো কিছু নয়। তবে এ অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যেকেরই হয়। দেখা গেল আমরা বন্ধুদের কোনো দল থেকে বাদ পড়ছি, স্বপ্নের চাকরিটা পেলাম না ইত্যাদি। তবে এটি তখনই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন এ উদ্বেগ সোশ্যাল অ্যাংজাইটি তখন ডিজঅর্ডারে পরিণত হয়। তখন এটি আপনি যে জীবনটা যাপন করতে চান, সেটা করতে দেয় না। কেউ যখন সামাজিক উদ্বেগজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তখন অন্যরা তাকে কী করে যাচাই করছে বা কঠোরভাবে মূল্যায়ন করছে কিনা এসব ভাবনায় আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এর পর ওই ব্যক্তি তার জীবনটাকেই এমনভাবে গড়ে তুলতে চায় যেন সে অন্যের লক্ষ্যবস্তু না হয় কিংবা তাকে নিয়ে সমালোচনা করার মতো বিষয় যেন না থাকে।
বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষ কোনো না কোনো সময় সোশ্যাল অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত হয়। শুধু আমেরিকাতেই সংখ্যাটা ১২ শতাংশ। এবং প্রচলিত হওয়া সত্ত্বেও, এটি নিয়ে ব্যাপকভাবে ভুল বোঝাবুঝি ও মিথ রয়ে গেছে।
প্রথমটি হলো, এমন সমস্যায় যারা ভোগে, তারা নাকি একা থাকলেই ভালো থাকে। এটা মোটেও সত্য নয়। আমার ল্যাবের গবেষণাতেই দেখেছি, সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিতে আক্রান্তরাও স্বাভাবিক মানুষদের মতো সুস্থ ও শক্তিশালী সামাজিক সম্পর্ক গড়তে চায়। তারা রোবটিক এলিয়েন নয়। তারা যখন সামাজিকীকরণের ভেতর দিয়ে যায়, তখন তারা ঠিকই ব্যাপারটা উপভোগ করে। অন্যের সংস্পর্শে তারা আরও সুখী হয়। কারণ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ কিন্তু মানসিক চাপযুক্ত নয়। কেউ হয়তো তার বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক উদ্বেগ বোধ করে, কিন্তু প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে নয়। কেউ হয়তো অপরিচিতের সঙ্গে মিশতে উদ্বেগ বোধ করে, কিন্তু সহকর্মী ও প্রতিবেশীর সঙ্গে নয়।
আরেকটা বিষয় হলো—সোশ্যাল অ্যাংজাইটি মানেই শুধু জনসম্মুখে কোনো পারফরম্যান্স দেখানোর ভয় নয়। সামাজিক উদ্বেগ নিয়ে ভোগা অনেকেই আছে যারা কিনা অভিনয়, মডেলিং বা খেলাধুলার মতো ক্যারিয়ারে বেশ ভালো করছে।
আরেকটা ভুল ধারণা হলো, এই সোশ্যাল অ্যাংজাইটি আপনাতেই চলে যায় ও ক্ষতিকর নয়। আপনি স্নাতক হলেই ভয়ভীতি চলে যাবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। এমনকি এ সামাজিক উদ্বেগ আপনার জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রভাব রাখতে সক্ষম। শখ থেকে শুরু করে ক্যারিয়ারেও প্রভাব ফেলে এ সামাজিক উদ্বেগ।
আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন বেশি সংযুক্ত, তবুও আমরা আগের চেয়ে একাকী আরও বিষণ্ন ও উদ্বিগ্ন। আমাদের সামাজিকীকরণের অফুরন্ত সরঞ্জাম রয়েছে। তবুও আমরা একটি ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক সংযোগ দেখতে পাচ্ছি।
এ উদ্বেগ নিয়ে কথা বলার এখনই সময়। শুরুতেই শনাক্ত করাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ১৪তম জন্মদিনের আগে এটা ধরতেই পারে না। বয়সের সঙ্গে এর সমস্যা আরও বাড়তেই থাকে। এ থেকে তৈরি হতে পারে আরও মানসিক সমস্যা।
কিন্তু সামাজিক উদ্বেগ শুধু কয়েকটি সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেই বের করা যায়। যেমন—‘আপনার প্রত্যাখ্যানের ভয় কি আপনার সবচেয়ে খারাপ ভয়গুলোর একটি?’ এ সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের কোনো পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে না। প্রাথমিক শনাক্তকরণ প্রোগ্রামগুলোকে আমরা আমাদের বিদ্যমান কাঠামোতে সংযুক্ত করতে পারি। স্কুলে কাউন্সেলিং এবং প্রাথমিক যত্নের মাধ্যমেই এটি সম্ভব।
আরেকটি করণীয় হতে পারে সামাজিক সাহস বাড়ানো। এর অর্থ হলো আগে থেকেই জেনে রাখা যে আপনার প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কা কিছুটা হলেও আছে। সামাজিকভাবে সাহসী হওয়ার আরেক অর্থ হলো আপনার নিজের মূল্য জানা এবং সেসব ব্যক্তি ও দলকে খুঁজে বের করা যারা আপনাকে গ্রহণ করবে এবং মিটিং বা মঞ্চে কথা বলার সময় ধরে নিতে হবে যে ‘প্রত্যাখ্যান’ কোনো এক কোনায় লুকিয়ে আছে।