

তাসনীম সিদ্দিকা
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ফসলি জমির পরিমাণ ক্রমশ কমছে। অন্যদিকে, খাদ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহারে মানবদেহে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদনের টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি হিসেবে অ্যাকুয়াপনিক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
অ্যাকুয়াপনিক্স একটি অত্যাধুনিক কৃষি পদ্ধতি, যেখানে মাছ এবং সবজি একসঙ্গে চাষ করা হয়। মাছের বর্জ্য পদার্থ গাছের জন্য পুষ্টি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আর সেই পুষ্টি শোষণ করা পানি পুনরায় মাছের জন্য নিরাপদ হয়ে ফিরে আসে। বাংলাদেশে অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতির গবেষণা ও ব্যবহার এখনও সীমিত। তবে ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম এ পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি তার বাড়ির ছাদে তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, শিং মাছসহ বিভিন্ন মাছ এবং ৮ প্রজাতির শাকসবজি চাষ করেছেন।
ড. সালাম বলেন, ‘অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে মাছের ট্যাংকের পানি সঞ্চালন করে সবজির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করা হয়। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমে মাছ ও গাছ একসঙ্গে বেড়ে ওঠে। মাছের বর্জ্যে থাকা নাইট্রোজেনজাতীয় উপাদান সাধারণত ক্ষতিকর হলেও এটি ব্যাকটেরিয়া (নাইট্রোসোমনাস ও নাইট্রোব্যাক্টের) দ্বারা ভেঙে গাছের জন্য পুষ্টিতে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় মাছের বর্জ্য থেকে উৎপন্ন নাইট্রোজেন উপাদান পরিবেশবান্ধব পুষ্টিতে পরিণত হয়। এতে বাড়তি সার বা কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। ফলে গাছ সহজেই প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে।
অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে ছোট ছোট ট্যাংক ও পাইপলাইন ব্যবহার করা হয়। মাছের ট্যাংক থেকে পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি সংগ্রহ করে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা গাছের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। পানির অপচয় হয় না এবং পরিবেশ দূষণও রোধ হয়। ঝামা ইটের মতো বিশেষ মাধ্যম ব্যবহার করা হয়, যা উপকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ড. সালামের অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে চাষ করা সবজির মধ্যে কলমি শাক, শিম, শসা, পেঁপে ছাড়াও স্ট্রবেরি, চেরি এবং স্কোয়াস উৎপাদন করা সম্ভব। এর সঙ্গে ফিলিপাইনের আখও চাষ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে কোনো রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপাদান যেমন খাবার সোডা ও ডিমের খোসা ব্যবহার করা হয়। এগুলো ছত্রাকনাশক এবং ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণে সহায়ক। এসব ফল ও সবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করায় এগুলোর পুষ্টিগুণ ও স্বাদ উন্নত।
ড. সালাম আরও জানান, প্রতিটি মাছের ট্যাংকে বা কন্টেইনারে প্রায় ৬০-৭০টি মাছ রাখা হয় এবং প্রতিদিন মাছের দেহের ওজনের ৩-৪% খাবার দিতে হয়। ফসল গাছগুলো খাড়া প্লাস্টিক কন্টেইনারে রাখা হয়, যাতে কম জায়গায় বেশি ফসল উৎপাদন সম্ভব।
অ্যাকুয়াপনিক্সের বড় সুবিধা হলো এটি এককালীন বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদি ফলন নিশ্চিত করতে পারে। ড. সালাম জানান, উন্নত দেশগুলোতে এই পদ্ধতিতে তিন বছরের মধ্যে বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসে। এই পদ্ধতিতে এক টাকা বিনিয়োগে তিন টাকা লাভ হয়। তিন বছরের মধ্যে বিনিয়োগ ফেরত আসে। পদ্ধতিটি সারাবছর ফসল ও এক থেকে দেড় বছরে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। মাছের চাষ থেকে নিয়মিত আয় এবং শাকসবজি উৎপাদন সারাবছর অব্যাহত থাকায় এ পদ্ধতিকে লাভজনক বলা যায়। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি জনপ্রিয় করা গেলে কৃষকদের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতিতে জমির প্রয়োজন নেই। ছাদে বা সীমিত জায়গায় ভাসমান কন্টেইনারে গাছ চাষ করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে পানির অপচয় হয় না, কারণ পুনঃব্যবহারযোগ্য পানির মাধ্যমে গাছ ও মাছ উভয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করা হয়।
অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কৃষিজমি সংকট এবং রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতি কমানোর টেকসই সমাধান হতে পারে। জায়গার সাশ্রয় ও পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতি বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অ্যাকুয়াপনিক্স পদ্ধতি নিয়ে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে এটি কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে বলে মনে করেন ড. আব্দুস সালাম।
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়