সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী: বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে ধান চাষের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন গৌরবজ্বল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঙালি খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও, ভাত এখনো বাঙালির প্রধান খাবার হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। ধান এবং চালের পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে নিরন্তর বিভিন্ন ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-গবেষকবৃন্দও এর ব্যতিক্রম নয়। এরই মধ্যে বাকৃবির রঙিন চাল নিয়ে গবেষণা নতুন আলো ছড়িয়েছে।

বাকৃবির ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকিরের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল রঙিন চালের খাদ্যগুণ, পুষ্টিমান এবং চাষপদ্ধতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে “উৎপাদন, গুণমান এবং স্বাস্থ্য উপকারের জন্য রঙিন চালের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ এবং মূল্যায়ন” প্রকল্পের আওতায় তিন বছর ধরে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গবেষক দলের প্রধান হিসেবে অধ্যাপক ড. মো. ছোলায়মান ফকির ছাড়া আরও ছিলেন অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর হোসেন-২ এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ও সাগরিকা খাতুন। সম্প্রতি প্রধান গবেষক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন।
রঙিন চাল সাদা চালের তুলনায় পুষ্টিগুণে অনেক এগিয়ে। এতে থাকা বিভিন্ন উপাদান খাদ্যতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রোটিন, আঁশ ও খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ রঙিন চাল সাদা চালের তুলনায় রঙিন চালের ব্রাণে ২-৩ গুণ বেশি আয়রন এবং জিঙ্ক রয়েছে। অ্যান্থোসায়ানিন এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধ, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। ভিটামিন বি ও ফাইটো-কেমিক্যালস দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ডায়াবেটিস ও স্থূলতা কমাতে সহায়তা করে।

রঙিন চালের চাষ পদ্ধতি সাদা চালের মতোই সহজ। এটি আমন মৌসুমে প্রধানত চাষ হয়। তবে বোরো মৌসুমেও চাষ করা সম্ভব। বেলে, দোআঁশ এবং কাদা মাটি এই চাষের জন্য উপযুক্ত যার প্রতি হেক্টরে ৩-৩.৫ টন ফলন পাওয়া যায়। তবে রঙিন চাল অতিরিক্ত রাসায়নিক সার সহ্য করতে পারে না এবং রোগবালাইয়ের প্রতি সংবেদনশীল। তাই ফলন সাদা চালের তুলনায় কম। তবে, ফলন তুলনামূলক কম হলেও রঙিন চালের বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় কৃষকেরা লাভবান হতে পারেন।
রঙিন চাল শুধুমাত্র পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ নয়, এতে রয়েছে ঔষধি গুণাবলী। এতে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। রঙিন চালের আঁশ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। খাদ্য তালিকায় রঙিন চালের অন্তর্ভুক্তিকরণ ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। তাই বলা যায়, রঙিন চাল ঔষধি গুণে অনন্য।
রঙিন চাল বর্তমানে বাজারে সাদা চালের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হয়। বিশেষত এর পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণাবলীর কারণে উচ্চবিত্ত এবং স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের মধ্যে এর চাহিদা বাড়ছে।
প্রধান গবেষক ড. মো. ছোলায়মান আলী ফকির মন্তব্য করে বলেন, “রঙিন চাল দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি এটি পুষ্টিগুণেও অনন্য। এ ধান চাষে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন এবং দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পুষ্টিহীনতা দূর করতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”
রঙিন চাল শুধু সাধারণ খাদ্য নয়, এটি পুষ্টিগুণ এবং স্বাস্থ্য উপকারের কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের খাদ্যশৃঙ্খলে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, এমনকি ক্যান্সারের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে এটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী,
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।